বাংলাদেশকে দেয়া এই সুবিধা স্থগিত রাখাই যথাযথ, কারণ বাংলাদেশ তার শ্রমিকদের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রমিক অধিকার বাস্তবায়নে কোন পদক্ষেপই নিচ্ছে না।-প্রেসিডেন্ট ওবামা
বাংলাদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের উপর চালু থাকা জিএসপি সুবিধা স্থগিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। (খবরের লিংক)
গতকাল (২৭ জুন, ২০১৩) সিনেট কমিটি এই সিদ্ধান্তের কথা জানায়। সিনেটের সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হবার দুমাস পর এই স্থগিতাদেশ কার্যকর হবে। ছয় মাস পর সিনেট বৈঠকে তা পর্যালোচনা করা হবে।
জিএসপি কি?
জেনারেলাইজেশন সিস্টেম অব প্রেপারাইজেশন (জিএসপি), যার অর্থ হল 'পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার'।
জিএসপি সুবিধাপ্রাপ্ত দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকরা কোন প্রকার শুল্ক ছাড়াই পণ্য আমদানি করতে পারে। শুল্ক দিতে না হলে পণ্যের মূল্য কমে যায়; ফলে, প্রতিযোগিতামূলক উন্মুক্ত বাজারে ব্যবসায় করতে সুবিধা হয়। এটিই জিএসপি'র বড় সুবিধা।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রদও জিএসপি ও বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প:
বাংলাদেশে উৎপাদিত গার্মেন্টস পণ্যের ২৩% যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানী করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্য উল্লেখ করার মত কোন জিএসপি সুবিধা যুক্তরাষ্ট্র থেকে পায় না। যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকরা ১৭% শুল্ক পরিশোধ করে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে গার্মেন্টস পণ্য আমদানি করে।
ফলশ্রুতিতে বর্তমানে, যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা স্থগিত করলে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের উপর আর্থিকভাবে তেমন কোন নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।
জিএসপি সুবিধা স্থগিতকরণ ও বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পসহ রপ্তানী বাণিজ্যে এর প্রভাব:
বাংলাদেশী পণ্যের আমদানীর উপর যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা স্থগিত করেছে। বাংলাদেশে শ্রমিকদের কর্মস্থলের নিরাপত্তার অভাবের কারণ দেখিয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
সাময়িকভাবে, জিএসপি সুবিধা স্থগিত করার কারণে আর্থিকভাবে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের উপর তেমন কোন বড় প্রভাব পড়বে না। তবে, জিএসপি সুবিধা বাতিলের ফলে বাংলাদেশ ক্ষতির সন্মুখীন হবে অন্য জায়গায়; সেটি হল: ইমেজ সংকট তথা, গুডউইল সংকটে ভুগবে বাংলাদেশ। আর এর ফলে ভবিষ্যতে হয়ত: আমরা বিশাল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির সন্মুখীন হতে যাচ্ছি।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে দেয়া জিএসপি সুবিধা স্হগিতের কারণ হিসেবে বলছে, বাংলাদেশের কারখানার পরিবেশ শ্রমিকবান্ধব নয়। এতে করে বাংলাদেশ ব্যবসায়িক ইমেজ সংকটে পড়বে এবং এর সূদূরপ্রসারী ফলাফল ভয়াবহ। বাংলাদেশের রপ্তানীযোগ্য সবকটি শিল্পই ভবিষ্যতে রপ্তানী বাণিজ্যে ক্ষতির সন্মুখীন হতে পারে।
বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের অবস্থা বর্তমানে খুব নাজুক। দেশের এক-তৃতীয়াংশ গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ হয়ে আছে। তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন, রানা প্লাজা ধস, শ্রমিক অসন্তোষ, ঘন ঘন শ্রমিক বিক্ষোভ, গ্যাস-বিদ্যুত সংকটসহ নানা কারণে যখন দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত গার্মেন্টস সেক্টর বেশ খারাপ সময় পার করছে, ঠিক তখনই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কারখানার পরিবেশ শ্রমিক-অবান্ধব অভিযোগ করে জিএসপি সুবিধা স্থগিত করেছে। আর এতে করে রপ্তানী বাণিজ্যে সৃষ্টি হবে ইমেজ সংকট। কারণ, শ্রমিকের জীবনের বিনিময়ে উৎপাদিত পণ্য ক্রয়ে অনিচ্ছুক ইউরোপ-আমেরিকা-প্যাসিফিকের ক্রেতারা; ব্যাপারটি অনেকটা ব্লাড ডায়মন্ড ইফ্যাক্টের মত। ফলশ্রুতিতে, অদূর ভবিষ্যতে 'ক্রেতার ক্রয়ে অনিচ্ছার' কারণে যদি বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানী বাণিজ্যে সংকট দেখা যাবার সম্ভাবনা প্রবল।
বাংলাদেশের রপ্তানী করা মোট গার্মেন্টস পণ্যের ৫৭% ইউরোপের বাজারগুলোতে রপ্তানি করা হয়। বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে তেমন জিএসপি সুবিধা না পেলেও ইউরোপে প্রায় শতভাগ জিএসপি সুবিধা পেয়ে থাকে। শ্রমিক-অবান্ধব পরিবেশের অভিযোগ এনে যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা স্থগিতকরণ ইউরোপের জিএসপি সুবিধাকে নেগাটিভলি প্রভাবিত করতে পারে; যা বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের রপ্তানী বাণিজ্যের উপর জন্য অনেক বড় এলার্মিং।
বাংলাদেশ আমেরিকায় যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করে তার মাত্র ০.৫% পণ্যের উপর জিএসপি সুবিধা পায়। গত বছরের হিসেবে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ২৬ লক্ষ ডলার শুল্ক রেয়াত পেয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধাপ্রাপ্ত এইসব পণ্য তালিকায় আছে কুটির শিল্প ও নানাবিধ ক্ষুদ্র শিল্প। যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করার কারণে, বাংলাদেশের কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পের রপ্তানী বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
গতবছর যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানী করা গার্মেন্টস পণ্যের মূল প্রায় ৫০০ কোটি ডলার; এর জন্য আমেরিকান-আমদানিকারকদের শুল্ক পরিশোধ করতে হয়েছে প্রায় ৭৩ কোটি ২০ লক্ষ ডলার। জিএসপি সুবিধা স্থগিত করার কারণে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পপণ্যের রপ্তানী বাণিজ্যের উপর বর্তমানে তেমন প্রভাব না ফেললেও ভবিষ্যতে ব্যাপক নেগেটিভ প্রভাব ফেলবে; এমনটি আশংকা করাটাই স্বাভাবিক [ব্লাড ডায়মন্ড ইফ্যাক্ট]।
যুক্তরাষ্ট্রের দেখাদেখি ইউরোপও যদি জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে দেয়, তাহলে বাংলাদেশের রপ্তানী বাণিজ্য ও গার্মেন্টস শিল্পের জন্য দুর্দিন অপেক্ষা করছে। কারণ, বাংলাদেশ ইউরোপে গতবছর ১২০০ কোটি ডলারের গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানী করেছে, যার প্রায় পুরোটাই জিএসপি সুবিধার আওতাধীন। এছাড়া, ইউরোপের সাথে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানী বাণিজ্য সর্ম্পক, যার সিংহভাগই জিএসপি সুবিধা পায়। যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করে ইউরোপও যদি জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে, তবে, বাংলাদেশের রপ্তানী বাণিজ্য ব্যাপক ক্ষতির সন্মুখীন হবে।
এখানে সবচেয়ে বড় আতঙ্কের ব্যাপারটি হল, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে আনীত অভিযোগ। বারাক ওবামা তাঁর বক্তব্যে, বাংলাদেশের শ্রম-পরিবেশ শ্রমিক-বান্ধব নয় বলে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন আর এতে করে বাংলাদেশের শ্রম-বাজার নিয়ে নেতিবাচক ভাবমূর্তিটি আরো প্রবলভাবে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। ক্রেতারা ভাববে, বাংলাদেশে শ্রমিকদের অধিকার নেই। আর এর প্রভাবটাই পড়বে সবখানে। হৃাস পাবে আমাদের গার্মেন্টস পণ্যসহ সামগ্রিক রপ্তানী বাণিজ্য; যার আল্টিমেট ফলাফল বাংলাদেশের অর্থনীতির ধসের মধ্য দিয়ে দেখা যাবে।
বর্তমানে উদ্ভূত এই সংকট হতে পরিত্রাণ পেতে হলে, শিল্প মালিক ও বাংলাদেশ সরকারকে একযোগে কাজ করতে হবে। এমুহুর্তে দ্রুত যে কাজটি করতে হবে, তা হল, বাংলাদেশের শিল্প-কারখানাগুলোর পরিবেশ শ্রম-বান্ধব হিসেবে গড়ে তোলার কাজ শুরু করা। সরকার একটি সেল গঠন করতে পারে, যার কাজ হবে, বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ ও শ্রমিকের জন্য বৈরী পরিবেশের শিল্প-কারখানাগুলো সনাক্ত করা ও শ্রম-বান্ধব হিসেবে গড়ে তোলার দিক-নির্দেশনা দেয়া এবং তদারকি করা।
ভবিষ্যতে রপ্তানী বাণিজ্যে ধস তথা, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির আসন্ন সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে, বাংলাদেশ সরকারকে এসব বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশের শিল্প-কারখানাগুলোতে শ্রম-বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির পাশাপাশি আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে ব্যাপক প্রচারণার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
[পূর্বে লেখাটি ফেসবুকে নোট হিসেবে প্রকাশিত]
__._,_.___