যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি ডেমোক্র্যাট ও মুসলিম ভোটার তালিকাভুক্তি প্রকল্পের চেয়ারওম্যান নাজদা আলম ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের বোস্টনে একটি সরকারি সমাজকল্যাণবিষয়ক দপ্তরে কর্মরত। দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে ডেমোক্রেটিক দলের জন্য কাজ করছেন তিনি। মুসলিম ভোটার তালিকাভুক্তি প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের
পক্ষে কাজ করছেন। যুক্তরাষ্ট্রে আড়াই মিলিয়ন তালিকাভুক্ত মুসলিম ভোটারের মধ্যে তিনি ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যে প্রায় ১৫ হাজার ভোটারকে তালিকাভুক্ত করেছেন। সম্প্রতি নিউ হ্যাম্পশায়ারে এ বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে সরাসরি কথা হয়েছে হিলারি ক্লিনটনের। তাঁর এ কাজে খুশি হয়েছেন হিলারি। তিনি বলেছেন, 'আই নিড ইউ' নাজদা। তোমার মতো বাংলাদেশি আমার প্রয়োজন। মার্কিন নির্বাচন নিয়ে কালের কণ্ঠ'র সঙ্গে কথা হয় নাজদা আলমের। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন কালের কণ্ঠ'র নিউ ইয়র্ক প্রতিনিধি সাবেদ সাথী
কালের কণ্ঠ : যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘদিন ধরে মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে আপনি জড়িত রয়েছেন। বোস্টন এলাকায় বাংলাদেশি ডেমোক্র্যাট হিসেবে আপনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। আপনার দল ও মার্কিন রাজনীতির কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলুন।
নাজদা আলম : এক দিনে বা হঠাৎ করেই যুক্তরাষ্ট্রে মূলধারার রাজনীতিতে প্রবেশ করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। এর জন্য অনেক পরিশ্রম ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। আমি এ দেশে আসার পর অনেক কষ্ট করেছি। লেখাপড়ার পাশাপাশি রাজনীতি নিয়ে চর্চা করেছি। বলতে পারেন, যুক্তরাষ্ট্রে তৃণমূল থেকেই শুরু করেছি এ দেশের রাজনীতি। এর ফলে ডেমোক্রেটিক দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারাও আজ আমাকে চেনেন। এক দশক ধরে আমি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থীদের পক্ষে মুসলিম ভোটার সংগ্রহের কাজ করছি। ২০০৮ সালেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ওবামার জন্য তাঁর নির্বাচনী কাজ করেছি। এবার খুব আনন্দের সঙ্গেই কাজ করছি হিলারি ক্লিনটনের জন্য।
কালের কণ্ঠ : আপনি কি মনে করেন ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট পদের জন্য মনোনয়ন দৌড়ে টিকবেন?
নাজদা আলম : এ ব্যাপারে একটি কথা না বললেই নয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনী মনোনয়ন দৌড়েও আমি দেখেছিলাম হিলারির পক্ষে মার্কিন নাগরিকদের গণজোয়ার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বারাক ওবামাই পেয়েছেন দলীয় মনোনয়ন। বাংলাদেশ কিংবা এশিয়ার দেশগুলোর মানুষ আর যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের মানসিকতার মধ্যে একটা বিরাট পার্থক্য রয়েছে। ধরুন আমাদের দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী, সংসদের স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেতা—সবাই মহিলা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে মহিলাদের নির্বাচিত করার প্রক্রিয়া এখনো শুরু হয়নি। এর মূল কারণ হচ্ছে, একজন মহিলাকে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নির্বাচিত করার মানসিকতা এখনো যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে জন্মায়নি। কিন্তু এবার মহিলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের একটা প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। একটা পরিবর্তন দেখতে চায় মার্কিনিরা।
কালের কণ্ঠ : আপনি মুসলিম ভোটার তালিকাভুক্তি প্রকল্প নিয়ে কাজ করছেন? যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম ভোটাররা ডেমোক্রেটিক দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী দুই প্রার্থীর কাকে সমর্থন করছে বলে আপনি মনে করেন?
নাজদা আলম : যুক্তরাষ্ট্রে তালিকাভুক্ত আড়াই মিলিয়ন মুসলিম ভোটারের মধ্যে আমি ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যে প্রায় ১৫ হাজার ভোটারকে তালিকাভুক্ত করেছি। এসব মুসলিম ভোটারের মধ্যে বেশির ভাগ হিলারিকেই ভোট দেবে। কারণ হিলারি ক্লিনটন আর বার্নি স্যান্ডারসের রাজনৈতিক ইতিহাসে অনেক পার্থক্য রয়েছে। হিলারির রাজনৈতিক যোগ্যতা বার্নি স্যান্ডারসের চেয়ে অনেকাংশেই বেশি। এ দেশের গণমাধ্যম তাদের মনগড়া জরিপ দেখিয়ে বার্নি স্যান্ডারসকে টেনে ওপরে এনেছে। এ ছাড়া আর কিছুই না। তবে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছেন বার্নি। আমি হিলারিকে কাছ থেকে দেখেছি, কথা বলেছি। হিলারিকে আমার কাছে খুব সাদামাটা মনে হয়েছে। বিশেষ করে তিনি শিশুদের খুব ভালোবাসেন। শুধু তা-ই নয়, হিলারিকে সব বয়সী মানুষই পছন্দ করে।
কালের কণ্ঠ : হিলারি ক্লিনটন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে প্রবাসী বাংলাদেশি বা বাংলাদেশের মানুষ উপকৃত হবে বলে মনে করেন কি?
নাজদা আলম : হিলারি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে অবশ্যই প্রবাসীসহ বাংলাদেশের মানুষ উপকৃত হবে। বাংলাদেশিদের ব্যাপারে তাঁর অনেক ধারণাও রয়েছে। কখনো তাঁর সঙ্গে কথা বলার তেমন সুযোগ হলে বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ অন্যান্য বিষয়ে কথা বলব। ইচ্ছা করলে তাঁরা ক্লিনটন ফাউন্ডেশন থেকেও বাংলাদেশের মানুষের জন্য সাহায্য করতে পারেন। কিন্তু সময় নিয়ে এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে বসে কথা বলতে হবে। সম্প্রতি নিউ হ্যাম্পশায়ারে নির্বাচনী প্রচারাভিযান বা প্রাইমারিতে এলে তাঁর সঙ্গে মাত্র ৩০ সেকেন্ড কথা হয়েছে আমার। এ সময় বাংলাদেশ বা প্রবাসীদের ব্যাপারে কোনো কথা বলার সুযোগই হয়নি। আমি ডেমোক্রেটিক দলের হয়ে মুসলিম ভোটার তালিকাভুক্তির জন্য যে কাজ করছি, শুধু এ বিষয় নিয়েই কথা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে আড়াই মিলিয়ন তালিকাভুক্ত মুসলিম ভোটারের মধ্যে আমি প্রায় ১৫ হাজার ভোটারকে তালিকাভুক্ত করেছি। এ খবর শুনে তিনি অত্যন্ত খুশি হয়েছেন। এ সময় তিনি আমাকে বলেন, 'আই নিড ইউ' নাজদা। তোমার মতো বাংলাদেশি আমার প্রয়োজন। হিলারি প্রেসিডেন্ট হলে বাংলাদেশের মানুষের উন্নয়নের জন্য কাজ করতে আমি ব্যক্তিগতভাবেই তাঁকে অনুরোধ জানাব।
কালের কণ্ঠ : একজন বাংলাদেশি মুসলমান মহিলা হয়ে ডেমোক্রেটিক দলের সভা বা সেমিনারে গিয়ে কখনো কোনো সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন?
নাজদা আলম : কোথাও তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। তবে যেহেতু আমি হিজাব পরি না, অনেকেই আমাকে অমুসলিম মনে করে। তাদের কাছে আমি বাংলাদেশি হিসেবে পরিচয় দিই। বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করে আমি নিজেকে গর্বিত মনে করি। আমি আরো গর্বিত, একটি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি। রিপাবলিকান দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিমদের নিয়ে নানা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করছিলেন তখন আমি একমাত্র বাংলাদেশি মুসলিম, তাঁকে টুইট করে এসব বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছিলাম। তিনি শুধু মুসলিমদের কটাক্ষ করেননি, এ দেশের স্প্যানিশসহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীকেরও কটাক্ষ করেছেন।
কালের কণ্ঠ : আপনি কবে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন এবং কত দিন ধরে মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত?
নাজদা আলম : আমার স্বামীসহ আমরা যুক্তরাষ্ট্রে এসেছি ১৯৮২ সালে। তখন আমরা শিক্ষার্থী ছিলাম। গ্রিনকার্ড পাওয়ার পর অপেক্ষা করেছিলাম এ দেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য। নাগরিকত্ব পাওয়ার পর ১৯৯৩ সাল থেকে মূলধারার রাজনীতি অর্থাৎ ডেমোক্রেটিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
কালের কণ্ঠ : মার্কিন নির্বাচন নিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে আপনার কী প্রত্যাশা?
নাজদা আলম : প্রত্যাশা বলতে, আমি প্রবাসী বাংলাদেশি ভাই-বোনদের অনুরোধ করব বর্তমান মার্কিন নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় হিলারি ক্লিনটনকে সমর্থন করে তাঁর জন্য কাজ করার। একই সঙ্গে মূলধারার রাজনীতিতেও সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানাব। হিলারি প্রেসিডেন্ট হলে বাংলাদেশসহ বাংলাদেশিরা উপকৃত হবে। তাঁর জন্য আমাদের আরো কাজ করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : এবার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে একটি প্রশ্ন করি, বাংলাদেশে আপনার বাড়ি কোথায়?
নাজদা আলম : আমার বাড়ি বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলায়। লেখাপড়া টাঙ্গাইল শহরেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেছি। আমার স্বামী শামস আলম পেশায় একজন ব্যাংকার। তিনি ম্যাসাচুসেটসের লিডার ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট। বর্তমানে ম্যাসাচুসেটসে কর্মরত। আমাদের দুটি সন্তান রয়েছে। মেয়ে সামা আলম এবং ছেলে সামুয়েল আলম। তারা দুজনই এ দেশে লেখাপড়া করছে।
কালের কণ্ঠ : আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
নাজদা আলম : কালের কণ্ঠকেও ধন্যবাদ।