Tapan Roy added 11 new photos.
· Dhaka ·
সোনারগাঁয়ের পানাম ও মসলিনের কথকথা
সোনারগাঁয়ের পানাম নগরের বিলাসবহুল ইমারতাদির অবশেষ এবং পারিপার্শ্বিক ছড়ানো ছিটানো পুরাকির্তীর ধ্বংসাবশেষ বহন করছে এর গৌরবময় ঐতিহ্য। ক্ষমতার পালাবদলে এর রাজনৈতিক গুরুত্বের হ্রাস বৃদ্ধি হলেও শুধুমাত্র মসলিনের জন্য এই জনপদের বানিজ্যিক গুরুত্ব ছিল সেই আদিকাল হতে উনবিংশ শতক পর্যন্ত। পানামের দক্ষিণেই খাসনগর দিঘি। নাম হতে অনুমিত, এই দিঘি তীরবর্তী খাসনগর ছিল সর্বোৎকৃষ্ট মসলিন 'খাস' উৎপাদনে প্রাণকেন্দ্র তথা 'খাস মলমল কুঠি'।
৫০ মিটার দীর্ঘ মসলিনকে একটি দিয়াশলাই বাক্সে পুরে রাখার কিংবদন্তী তো বহুল প্রচলিত। শুধু কিংবদন্তী নয়, ঐতিহাসিকভাবেই আদিকাল হতেই মসৃনতম, কোমলতম এবং সবচাইতে মিহি কাপড় হিসাবে স্বীকৃত হয়ে আসছে ঢাকাই মসলিন। প্রাচীন ব্যাবিলনীয় ও এসিরিয় সভ্যতার সময়েও ঢাকার বস্ত্র ছিল জগৎ সমাদৃত। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে রোমক অভিজাত রমনীদের একান্ত কাংখিত বস্ত্র ছিল মসলিন যখন সম্রাট নিরোর সভাসদ ও লেখক Petronius মসলিনকে উল্লেখ করেন হাওয়ায় বুনা বস্ত্র (ventus textilis:woven wind) হিসাবে।
সোনারগাঁওয়ের মসলিনের মসলিনের সমতূল্য উৎকৃষ্ট কাপড় দুনিয়ার আর কোথাও নেই বলে মন্তব্য করেন চতুর্দশ শতকের পর্যটক ইবনে বতুতা। আর এতো মিহি কাপড় কী করে বানানো সম্ভব, বিস্ময় প্রকাশ করেন ১৪০৬ সালের চীনা পর্যটক মাহুয়ান। পারস্যের রাজদূত মোহাম্মদ আলী বেগ পারস্যের শাহকে উপঢৌকন দানের জন্য ক্ষুদ্র এক খানা নারকেলের মালার মধ্যে পুরে নিয়ে আসেন ৬০ হাত দীর্ঘ মসলিন। পুরাকাল হতে মধ্যযুগ পর্যন্ত যখন যে পর্যটক এতদঞ্চলে এসে ছেন, অবধারিত ভাবে তাঁর দৃষ্টি প্রথমে পড়েছে মসলিনের উপর।
মসলিনের কদর হয় আকাশ্চুম্বি যখন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের রাজারাজরা নবাবদের আভিজাত্য ও ফ্যাশনসচেতনতা ওঠে তুঙ্গে। ষোড়শ শতকে আকবরের সময় যখন মোঘল সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয় সমগ্র উত্তর ভারতে; শিল্পকলা, সঙ্গীত, কাব্য - লাভ করে চরম উৎকর্ষতা। দরবার আলো কিত করছেন নবরত্নের মিয়া তানসেন আর বীরবলরা। মসলিন রূপ পায় মোঘলদের পোষাক আশাকের অপরিহার্য বস্ত্র হিসাবে।
প্রিয়তমা মহিষী নূরজাহানের মনোরঞ্জনে মসলিনের জন্য সম্রাট জাহাঙ্গীরকে মসলিনের জন্য ব্যয় করতে হতো অজস্র অর্থ। শাহজাহান ও ঔরঙ্গজেবের আমলে বেগম মহলে হয় মসলিনের একাধিপত্য।
সর্বোৎকৃষ্ট মসলিন 'মলমল খাস' তৈরী হতো শুধুমাত্র সম্রাটের জন্য। ১ গজ বহরের ১০ গজ মলমল খাস মসলিনের ওজন আট তোলা ছ আনা, মূল্য ১০০ টাকা। অতি সূক্ষ এই পুরো বস্ত্র খন্ড টেনে নেয়া যেতো ক্ষুদ্র এক অঙ্গুরীর ছিদ্র দিয়ে। এর ব্যয় নির্বাহের জন্য বাংলায় প্রবর্তন করা হয় বিশেষ জায়গীর প্রথা 'সরকার আলি '। 'খাস মলমল' ছাড়াও নবাব ও সুবেদারগন নজরানা ও উপঢৌকন স্বরূপ অন্য যে মসলিন এই অর্থ ব্যয়ে প্রেরণ করতেন, তার নাম পরে 'সরকার আলি'।
শাহজাহান ও ঔরঙ্গজেবের আমলে মসলিন একাধিপত্য পায় বেগম মহলে। 'মলমল খাস' যেন বাইরে যাতে না পারে, জারী হয় বাদশাহী ফরমান। এর তুলা বাছাই, সুতা প্রস্তুত হতে বস্ত্র বুনন, প্রতি পর্যায়ে কঠোর মান নিয়ন্ত্রণ ও অন্য কোথাও যেন তা যেতে না পারে, এ জন্য 'মলমল খাসকুঠি'তে নিয়োগ থাকতো মোঘল সুবাদারের দারোগা সহ পুরো এক দপ্তর।
মসলিনের পার্থক্য করা হতো সূক্ষ্মতা, বুননশৈলী আর নকশার পার্থক্যে। এরই প্রেক্ষিতে কাব্যিক অর্থবহ সব নাম দেওয়া হয় মসলিনের। তৃণ ভূমিতে ছড়িয়ে দিলে শিশিরসিক্ত দূর্বা দল বলে ভ্রম হত বলে নাম দেয়া হয় 'শবনম' ফার্সিতে যার মানে হচ্ছে 'ভোরের শিশির'। পরীক্ষাচ্ছলে নবাব আলীবর্দি এক খানা 'শবনম' ঘাসে বিছিয়ে দিলে ঘাস ভেবে গরু উদরস্থ করে ফেলে এই বস্ত্র খন্ড।
জলের সাথে মিশে থাকলে বোঝাই যায়না কাপড় আছেত, এতো টাই স্বচ্ছ। এর নাম 'আব-রাওয়ান'; আব-জল, রোয়ান- প্রবাহিত হওয়া। ঔরঙ্গজেব দুহিতা জেব-উন-নেসা এই কাপড় পরে পিতার সমুখে গেলে পিতা তাঁকে আব্রুহীনা বলে ভর্ৎস্যনা করলে কন্যা জবাব দেন, 'তবু তো আমি সাত প্রস্থ কাপড় পরিয়াছি।'
ইউরোপে Regency Era তে, অপরিহার্য রাজকীয় পরিধেয়ের মর্যাদা পায় মসলিন। ফ্রেঞ্চ দিগ্বিজয়ী নেপোলিয়ন বোণপারটের ভগ্নি পউলিন বোনপারটের পছন্দ ছিল শুধু ই মসলিন। অষ্টাদশ শতকে ফ্রেঞ্চ সাম্রাজ্ঞী জ্যাকুলিন মসলিন প্রবর্তন করলে রাজকীয় স্টাইল হিসাবে পরে স্থান করে নেয় ব্রিটিশ রাজ পরিবারে। সুচিক্কন বস্ত্রের অন্তরাল হতে আপন অঙ্গরাগ প্রকাশের জন্য বিকল্প ছিলনা মসলিনের। বিশেষ এক ধরণের বস্ত্র নিয়ে বিশ্ব জুড়ে এরকম ক্রেজ এর আর নজির নেই ইতিহাসে।
মসলিনের স্বর্ণযুগের পড়তির দিকে বিলেতের "মর্নিং ক্রনিকল" পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী ১৮৫১ সালে লন্ডনে আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে প্রেরিত হাবিবুল্লাহ তাঁতির বোনা দশ গজ লম্বা একখন্ড মসলিনের ওজন ছিল মাত্র তিন আউন্স ! তারও পর ১৮৬২ তে বিলেতের প্রদর্শনীতে ঢাকাই মসলিন সর্বশ্রেষ্ঠ মর্মে স্বীকৃত হয়। ওয়াটসন সাহেবের ভাষ্য ছিল "With all our machinery and wondrous appliances, we have hither to been unable to produce a fabric which for fineness and utility can equal the 'woven air' of Dacca."
স্বভাবতই প্রশ্ন আসে সেই আদিকাল থেকেই সূক্ষতম তন্তুজাত বিশ্ব সেরা মসলিন অন্য কোথাও না হয়ে ঢাকাতেই উৎপন্ন হত কেন। হাজার বছর ধরে বংশ পরম্পরায় প্রবাহিত ও শানিত দক্ষতা ছাড়াও রহস্য ছিল এতদঞ্চলের মাটি ও পানিকে ঘিরে।
ঢাকাস্থ ব্রিটিশ কমারশিয়েল রেসিডেন্ট জেমস টেলরের ১৮০০ সালের লেখায় আছে বিবরণ। বিশেষ ধরণের 'ফুটি কার্পাস' নামের তুলার চাষ হতে শুরু এ প্রক্রিয়ার। প্রতি বছর বন্যায় প্লাবিত হওয়া শুধুমাত্র ঢাকার দক্ষিণ পশ্চিমে ১২ মাইলের মতো মেঘনার তীরবর্তী জমিতে উৎপন্ন হতো এই তুলা। এই বিশেষ গুণাবলীর তুলা অন্যত্র উৎপাদনের অনেক উদ্যোগ নিলেও তা সফল হয়নি।
ঐতিহাসিক আবুল ফজলের 'আইন ই আকবরি' গ্রন্থে বর্ণিত সোনারগাঁয়ের কাটারসুন্দর গ্রামের বিশাল দিঘির জল ছিল এতোই স্বচ্ছন ও শুভ্র, এতে মলমল খাস মসলিন ধৌত করলে আসতো অতুলনীয় শুভ্রতা। এই দিঘির চার পাশেই বাস করত অসংখ্য তন্তুবায়। অনুমিত হয় ছবির 'খাস নগর দিঘি' ই কাটারসুন্দর গ্রামের সেই দিঘি। ঢাকা শহরের নারিন্দা হতে চার মাইল দূরবর্তী তেজগাঁও গ্রাম পর্যন্ত ছিল অনেক কুপের জলও ছিল কাটারসূন্দর গ্রামের দিঘির জলের মতোই অনন্য বৈশিষ্ঠের।
বাদশাহ, নবাব, দিওয়ান, রাজা রাজরা, এবং অভিনজাততম ব্যক্তিবর্গ ব্যতীত মসলিন ব্যবহার ছিল কল্পনাতীত। মসলিন কেন এতো মহার্ঘ্য আর কেন ই বা মসলিন বিলুপ্ত হল, মসলিন তৈরির সেই তাঁতিদের নির্যাতন ও বঞ্ছনার ইতিহাস, সে আরেক করুণ অধ্যায়।
সূত্রঃ বৃহত্তর ঢাকা জিলার ইতিহাস, যতীন্দ্রমোহন রায় ও কেদার নাথ মজুমদার।
Our Story of Dhaka Muslin, Khademul Islam
+7
https://www.facebook.com/photo.php?fbid=1330703676963504&set=pcb.1330705560296649&type=3
www.facebook.com Tapan Roy added a new photo. |