বার্গম্যানের বাড়াবাড়ি!
উদ্ভূত এক আবদারের কথা লিখেছেন কথিত ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান। তিনি সেই লোক যে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে অনেক সমালোচনামূলক নিবন্ধ লিখেছেন এবং বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালকে বিতর্কিত করার ব্রত নিয়ে বহির্বিশ্বে অপপ্রচার করছেন। এর কারণে একবার ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিতও হয়েছেন।
তার এরচেয়েও বড় পরিচয় তিনি স্বনামধন্য আইনজীবী ড. কামাল হোসেনের মেয়ের জামাই এবং আরেক স্বনামধন্য মানবাধিকারকর্মী ব্যারিষ্টার সারাহ হোসেনের স্বামী। তার পারিবারিক পরিচয় তাকে বাংলাদেশ সম্পর্কে উদ্ধত্য আচরণ করতে উৎসাহী করছে কিনা জানি না।
ঢাকায় বসে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বার বার লিখে আলোচিত এই তথাকথিত সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী কয়েকটি ব্লগে তার একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেন ১৩ অক্টোবর ২০১৫। এটি আলজাজিরা ইংলিশ অনলাইন প্রকাশ করার পর ঢাকার মিডিয়ারও দৃষ্টি আকর্ষীত হয়।
ওই প্রতিবেদনের মূল কথা হচ্ছে পাঁচ পাকিস্তানি নাগরিক- পাকিস্তানের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মিয়া সুমরু, জাতীয় পরিষদের সাবেক সদস্য এবং সাবেক মন্ত্রী ইশাক খান খাকওয়ানি, ডন মিডিয়া গ্রুপের চেয়ারপারসন আম্বার হারুন সায়গল এবং অন্য দুজন ব্যবসায়ী যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির রায়ে দণ্ডিত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে চান। তারা সবাই নাকি দাবি করেছেন, ১৯৭১ সালের এপ্রিলে সংঘটিত যে চারটি ঘটনার জন্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে সে সময় তিনি করাচিত অবস্থান করছিলেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার চলাকালে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী একই কথা বললেও তা গ্রহণ করেনি আদালত। আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন।
এদের একজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী মুনীব আর্জমান্দ খান বলেন যে তার সাক্ষ্য 'আদালতের পুরো বিচার প্রক্রিয়াকেই বদলে দেবে।'
তিনি বলেন, বাংলাদেশে পাকিস্তানের হত্যাযজ্ঞ শুরুর চারদিন পর ২৯ মার্চ তিনি তার স্কুলের বন্ধু সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে করাচি বিমানবন্দর থেকে গ্রহণ করেন এবং আম্বার হারুনের বাসায় নিয়ে যান। এর তিন সপ্তাহ পর তিনি তাকে লাহোরের বিমানে তুলে দেন-যেখানে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী অধ্যয়নের জন্য যান।
সাকার লাহোরে পড়তে যাওয়ার এই গল্প যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হওয়ার আগে কোনোদিন কেউ শুনেনি। সে নিজেও বলেনি। শুধু বিচারকালে ট্রাইবুনালে তার উকিল এই কথা উল্লেখ করেছিলেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধ যখন শুরু হয় সাকা তখন কলেজের ছাত্র এবং নটরডেম কলেজে নাকি পড়াশোনা করতেন। ১৯৬৩ থেকে ৬৬ পর্যন্ত সাকার বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরী (ফকা) পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন এবং তমিজউদ্দিন খানের মৃত্যুর পর তিনি স্পিকারও হয়েছিলেন। ওই সময় তারা পিণ্ডিতে ছিলেন।
সাকা সেখানেই স্কুল পর্যায়ের লেখাপড়া করেছেন। ৬৬ সালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান মুসলিম লীগ থেকে ফকাকে বহিষ্কার করে। এরপর থেকে তারা চূড়ান্তভাবে পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশে ঢাকা-চট্টগ্রাম বাস করে আসছে। সাকা চট্টগ্রামে ছিলেন যুদ্ধকালীন পুরো সময়ে। সাকা এবং তার বাবা ফকার বন্দীশালায় শত শত লোকের মাঝে যারা ছিলেন আমিও তার একজন।
একথা আমি আগেও অনেকবার বলেছি এবং লিখেছি। স্বয়ং সাকাই আমাকে তুলে নিয়ে এসেছিল তার জিপে করে তাদের গুডস হিলের বাসায়। পরে জানে বেঁচেছিলাম, মরে গেছে ভেবে ফেলে দিলে। আমার এক আত্মীয় মিলিটারি নিয়ে সে বাড়িতে গিয়ে আমাকে উদ্ধার করলে। যারা যারা সাকার নির্যাতনের শিকার হয়েছে, হত্যা-নির্যাতন দেখেছে, তারা আদালতে গিয়ে বলে এসেছে সবই।
এখন বিচারের শেষ পর্যায়ে সুনির্দিষ্ট একটা সময়কে চিহ্নিত করে সাকার পাকিস্তানে থাকার বানানো গল্পের একটাই উদ্দেশ্য বিচারপ্রক্রিয়াকে বার বার প্রশ্নবিদ্ধ করা। তার বিরুদ্ধে যে হত্যামামলাগুলোর রায় হয়েছে সেগুলোর ঘটনাকাল ওই সময়টাতেই।
তাই এটাকে মোক্ষম বিষয় হিসেবে আনতে চাচ্ছে সাকার অনুসারীরা, তার পেইড এজেন্টটরা, ডেভিড বার্গম্যানরা। সাকা একবার ঢাকার নটেরডেম, একবার লাহোরের পাঞ্জাব ইউনির্ভাসিটি, আরেকবার লন্ডনের লিংকনস ইন (Lincoln's Inn) ইত্যাদিতে পড়াশোনা করার গল্প শুনে আসছি।
কিন্তু সাকা যে আসলে কি পাশ সেটাই জাতির কাছে পরিস্কার নয়। জাতীয় সংসদের নির্বাচনে তিনি পাঁচবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। শিক্ষাগত যোগ্যতা কখন কি লিখেছেন জানি না। তবে সর্বশেষ বার তিনি নিজেকে স্বশিক্ষিত দাবি করেছেন বলে পত্রিকায় এসেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নুরেমবার্গ ট্রাইবুনাল এবং টোকিও ট্রাইবুনাল ইত্যাদিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছিল। যুদ্ধাপরাধীরা ছিলো জার্মানি ও জাপানের লোক। ওই ট্রাইবুনালে অপরাধীদের পক্ষে-বিপক্ষে জাপান বা জার্মানির কোনও লোকের কোনও সাক্ষ্য ট্রাইবুনাল গ্রহণ করেনি।
সুতরাং ঢাকা ট্রাইবুনাল বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে কোনও পাকিস্তানির সাক্ষ্য কোনও যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে গ্রহণ করবে কেন? কারণ যুদ্ধটাইতো হয়েছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। সাকাতো পাকিস্তানিদেরই লোক। তাদের পক্ষ হয়েই স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করেছিল এবং স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের হত্যা করেছিল।
সুতরাং তার পক্ষে একজন পাকিস্তানিরও কথা বলার সুযোগ নেই। মানবাধিকারের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের কোনও সম্পর্ক নেই। নুরেমবার্গ ট্রাইবুনাল এবং টোকিও ট্রাইবুনাল- সব বিচারে কোথাও মানবাধিকারের প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি। কারণ তারা মানবতার শত্রু। এমনকি নুরেমবার্গ ট্রাইবুনাল এবং টোকিও ট্রাইবুনালের কোনও রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগও ছিল না।
কিন্তু ঢাকা ট্রাইবুনাল সে সুযোগ রেখেছে। ডেভিড বার্গম্যান একজন মানবাধিকার কর্মি দাবি করে মানবতার শত্রুদের পক্ষে ওকালতি করা বা দালালী করা অশোভনীয়। তার কার্যকলাপ বার বার তাই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে এদেশের মানুষের কাছে, আদালতের কাছেও।
আসলে সে মানবাধিকার কর্মি নাকি যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তোলার জন্য নিয়োজিত ভাড়াটিয়া? ডেভিড বার্গম্যান ভাল করেই জানেন বিচারের এই পর্যায়ে সাকার পক্ষে সাক্ষ্য দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। তারপরও বিচার প্রক্রিয়াকে বার বার বাধাগ্রস্থ করার সাকার পরিবারের খেলায় সে কেন প্রধান ক্রীড়ানক হচ্ছে প্রশ্ন উঠতে পারে।
ডেভিড বার্গম্যান, এখন মৃত্যদণ্ড কার্যকরের সময়, সাক্ষ্য নেওয়ার সময় নয়। ষড়যন্ত্র থেকে বিরত থাকুন। বাড়াবাড়ি থামান। আপনার মতো পেইড এজেন্ট-এর পক্ষে বুঝা সম্ভব নয় বাঙালি জাতি কত বড় আশা নিয়ে বসে আছে এই নরঘাতকের উপযুক্ত সাজা দেখার জন্য।
__._,_.___