দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলিম লীগের নেতৃত্বেই যে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়- এ তথ্য সর্বজনজ্ঞাত। কিন্তু মুসলিম লীগই দ্বিজাতিতত্ত্ব নামক অপতত্ত্বটির প্রথম প্রবক্তা- এমন কথা বলাটা কোনোমতেই সঠিক নয়। সঠিক তথ্য ও সত্যের অবহিতির জন্য অবশ্যই সংস্কারমুক্ত দৃষ্টিতে ইতিহাস-পরিক্রমায় মনোযোগী হতে হবে। উনিশ শতকের 'বঙ্গীয় রেনেসাঁস' বলা হয় যাকে- যাকে নিয়ে সংস্কৃতিচিন্তকদের অন্তহীন বিতর্কের এখনো অন্ত পাওয়া যায়নি- সেই রেনেসাঁসের ভেতরেই উপ্ত হয়েছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের বীজ।
না, বঙ্গীয় রেনেসাঁসের স্রষ্টা ও পোষ্টাদের কেউই সাম্প্রদায়িকতাবাদী ছিলেন না। বরং তাঁরা সবাই ছিলেন অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনার ধারক ও বাহক। নানাভাবে সেই চেতনার প্রসার ও প্রতিষ্ঠা ঘটানোই ছিল তাঁদের বিরামহীন প্রয়াস। কিন্তু ভুললে চলবে না যে তাঁরা সবাই এসেছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে। কারণ বিভিন্ন সামাজিক-ঐতিহাসিক ঘটনা-পরম্পরায় হিন্দু সমাজের উচ্চ বর্ণের কিছু মানুষের সমবায়েই কলকাতা নগরীতে একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছিল। সেই মধ্যবিত্তরা আধুনিক শিক্ষা লাভের সূত্রে আধুনিক ধ্যানধারণার সঙ্গে সংযুক্ত হয় এবং তাঁদের হাতেই দেশের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির ঘটে নবায়ন। এই নবায়নেরও ভিত্তিতে ছিল নবায়নকারীদের সাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য- অর্থাৎ হিন্দু ঐতিহ্য। হিন্দু মনীষীরাই হন সে সময়কার আধুনিকতার নকিব, হিন্দু পুরাণেরই পুনর্জন্ম ঘটে তাঁদের সৃষ্ট আধুনিক সাহিত্যে, 'হিন্দুমেলা'ই তখন জাতীয় মেলার পরিচিতি ধারণ করে। অর্থাৎ জাতিত্ব আর হিন্দুত্ব একীভূত হয়ে যায়, হিন্দুর বাইরে আর কারো সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার এই জাতিত্বের ধারণার ভেতর ঠাঁই পায় না। সচেতনভাবে অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী হয়েও বঙ্গীয় রেনেসাঁসের প্রবক্তারা যে নিজেদের অজান্তেই সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ জাতীয় চেতনার বদলে সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদের পত্তন ঘটিয়েছিলেন এবং এভাবে তাঁরাই দ্বিজাতিতত্ত্বের বীজ রোপণ করে ফেলেছিলেন- এমন কথা বললে খুব একটা ভুল হবে কি?
কয়েক দশক পরে মুসলিম সম্প্রদায়ের ভেতর একটি মধ্যবিত্ত গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হিন্দুত্বের বিপরীতে তাদের ভেতর দেখা দেয় মুসলিম সাম্প্রদায়িক চেতনার প্রাবল্য। সচেতনভাবেই এ চেতনাকে তারা লালন ও পোষণ করতে থাকে। এরই পরিণামে মুসলিম সম্প্রদায়কে একটি স্বতন্ত্র জাতিরূপে চিহ্নিত করে মুসলিম লীগের দ্বিজাতিতত্ত্ব-ভিত্তিক পাকিস্তান আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে এবং অচিরেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটে। কিন্তু মুসলিম লীগ তো দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রচারে সোচ্চার হয়ে ওঠে ১৯৪০ সাল থেকে। অথচ একটু আগেই লক্ষ করেছি যে উনিশ শতকে হিন্দুরাই স্বরূপত হিন্দুত্বভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্বের বীজ রোপণ করেছিল। বিশ শতকের শুরুতেই মুসলিম লীগের পাশাপাশি উগ্র হিন্দুত্ববাদীরাও 'হিন্দু মহাসভা' নামক প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক সংগঠনটির জন্ম দেয়। মুসলিম মধ্যবিত্ত মুসলিম স্বাতন্ত্র্য চেতনায় উদ্বুদ্ধ থেকেও ১৯৪০ সালের আগে স্পষ্ট ভাষায় মুসলমানদের একটি স্বতন্ত্র জাতিরূপে ঘোষণা দেয়নি। এ বিষয়ে তারা বোধ হয় কিছুটা দ্বিধাগ্রস্তই ছিল। হিন্দু মহাসভা কিন্তু এর আগেই কোনোরূপ লুকোছাপা না করে বলতে থাকে যে ভারতের হিন্দুরাই একটি জাতি এবং এই হিন্দু জাতির ওপরই থাকবে দেশের শাসনভার। এই দলটির নেতা বিনায়ক দামোদর সাভারকর ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বরে হিন্দু মহাসভার নাগপুর অধিবেশনে প্রকাশ্যেই ঘোষণা দিলেন, 'উই দ্য হিন্দুজ আর আ নেশন বাই আওয়ারসেলভস।'
হিন্দু মহাসভার এ রকম স্পষ্ট ঘোষণায় মুসলিম লীগ দলটির বেশ সুবিধাই হয়। তাদের সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব তখন কেটে যায়। এ দলটি তখন স্পষ্ট ভাষায় প্রচার করতে থাকে যে 'দ্য মুসলিম আর আ নেশন'। জিন্নাহ সাহেব বিভার্লি নিকলস নামক একজন ইংরেজ লেখকের সঙ্গে আলাপচারিতায় পাঁচটি শব্দে গ্রথিত এই বাক্যটিকে পাকিস্তানের 'ভাইটাল প্রিন্সিপল' বা মূল মর্ম বলে আখ্যায়িত করেন। এই মূল মর্মের ভিত্তিতেই ভারতের মুসলিম জাতির জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এবং ১৯৪৭ সালে সেই রাষ্ট্রের জন্ম। পশ্চিমাঞ্চলে পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও এক হাজার মাইলেরও বেশি দূরত্বে অবস্থিত পূর্বাঞ্চলে পূর্ব বাংলা- এই কয়টি প্রদেশ নিয়ে নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের পত্তন। ব্রিটিশ শাসনমুক্ত ভারতবর্ষের বিশাল অঞ্চলটি অবশ্য, স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানের বাইরে থেকে যায়, গঠিত হয় স্বাধীন গণতান্ত্রিক ভারতরাষ্ট্র। পাকিস্তানে ক্ষমতার আসনটি সাম্প্রদায়িকতাবাদী মুসলিম লীগের দখলে থাকলেও নতুন ভারতরাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন হলো অসাম্প্রদায়িক ভাবনার বাহকরূপে পরিচিত কংগ্রেস- সাম্প্রদায়িক হিন্দু মহাসভা নয়। কারণ সাম্প্রদায়িকতার প্রবল জোয়ারের মুখেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামটি পরিচালিত হয়েছিল সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ও সেক্যুলার ভাবনার অনুসারী রাজনীতিকদের নেতৃত্বেই।
তবু হিন্দু মহাসভার মতো হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো যে তাদের কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকেনি, বরং প্রতিনিয়তই তারা যে তাদের শক্তিকে সংহত করতে করতে মহাশক্তিধর হয়ে উঠেছে, তারই সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেল স্বাধীনতালাভের ৬৭ বছর পর ২০১৪ সালে বিজেপি নামক কট্টর হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীটির প্রবল প্রতাপে ভারতের ক্ষমতার মঞ্চটি দখল করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে। সেকালের হিন্দু মহাসভারই পরিণত রূপ একালের বিজেপি বা ভারতীয় জনতা পার্টি।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে হিন্দু মহাসভার হিন্দুত্ববাদী চিন্তা ও কর্ম মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলনকে প্রতিহত করতে তো পারেইনি, বরং মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাকে অধিক পরিমাণে শক্তিমন্ত ও পাকিস্তান সৃষ্টিকে অনিবার্য করে তুলেছে। বাস্তবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পর সেই রাষ্ট্রটিকে ধ্বংস করার জিগির তুলে সারা উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক অশান্তি জিইয়ে রাখার অপকর্মটিও করেছে হিন্দু মহাসভা ও তার সহযোগীরাই। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন হিন্দু মহাসভা ১৯৪৭ সালেই এক প্রস্তাবে ঘোষণা করে, 'ভারত এক ও অবিভাজ্য। যত দিন না বিচ্ছিন্ন অংশগুলোকে আবার মূল ভারত ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়, তত দিন শান্তি অধরা হয়েই থাকবে।' অর্থাৎ সেই সাতচল্লিশ সাল থেকেই হিন্দু মহাসভা পাকিস্তানবিরোধী প্রচারণার মাধ্যমে একটা 'যুদ্ধ যুদ্ধ' ভাব সৃষ্টি করে রাখে এবং সর্বপ্রকারে শান্তি প্রচেষ্টার বিরোধিতা করতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫০ সালে পাকিস্তান ও ভারতে সাম্প্রদায়িক অশান্তি প্রশমনের উদ্দেশ্যে প্রণীত নেহরু-লিয়াকত চুক্তির বিরুদ্ধে হিন্দু মহাসভাকে তৎপর হয়ে উঠতে দেখি। ১৯৫০ সালের আগস্ট মাসে ভারতের পার্লামেন্টে নেহরু-লিয়াকত চুক্তি বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। ভারত ও পাকিস্তানে উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানে এই চুক্তি যে বিশেষ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু তাঁর বক্তৃতায় সে বিষয়টিই স্পষ্ট করে তুলতে চেয়েছিলেন। নেহরুর বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানের জন্য যে প্রস্তাব উত্থাপন করেন সেটি ছিল এ রকম- ভারত ও পাকিস্তানের পুনর্মিলন ঘটাতে হবে অথবা দুই দেশের সংখ্যালঘু বিনিময় কিংবা ভারত ও পাকিস্তানের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। শ্যামাপ্রসাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে নেহরু অত্যন্ত যুক্তিসংগতভাবেই বলেছিলেন যে এই প্রস্তাব কার্যকর করা মানেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা, যা একান্তভাবেই অনুচিত ও অসম্ভব।
শ্যামাপ্রসাদ ও তাঁর সহযোগীরা এরপর তাঁদের তৎপরতা আরো বিস্তৃত ও বহুমুখী করে তোলেন। একসময় হিন্দু মহাসভাকে 'জনসংঘ' নামে রূপান্তর করা হয় এবং পরে অন্যান্য কট্টর হিন্দুত্ববাদীকে সঙ্গে নিয়ে জনসংঘই পরিণত হয় ভারতীয় জনতা পার্টিতে (বিজেপি)। বিজেপি তো শ্যামাপ্রসাদের চিন্তা ও কর্মের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারকে নিষ্ঠার সঙ্গেই এগিয়ে নিয়ে চলছে।
এরই মধ্যে যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করে ফেলে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস) নামক তথাকথিত 'অরাজনৈতিক' সংগঠনটি। এই কট্টর মৌলবাদী হিন্দু সংগঠনটি অচিরেই ভারতের হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদী রাজনীতির অভিভাবক ও নিয়ন্ত্রকে পরিণত হয়। আরএসএসেরই সহযোগী ও সহমর্মী হয়ে দেখা দেয় 'বিশ্ব হিন্দু পরিষদ', 'শিবসেনা' কিংবা 'বজরং দল'-এর মতো কতগুলো হিংস্র হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী। ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজেপির অভূতপূর্ব বিজয় আসলে আরএসএসেরই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক হওয়া। গুজরাটের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিই ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হয়েছেন বটে, কিন্তু এই নরেন্দ্র মোদির আসল পরিচয় হলো, তিনি আরএসএসেরই দীক্ষিত ও পরীক্ষোত্তীর্ণ শিষ্য। দীর্ঘকাল তিনি গুরুগৃহে থেকে (অর্থাৎ আরএসএসের অন্তর্গত হয়ে ও তাঁরই একান্ত অনুগত ও অনুগৃহীত শিষ্যরূপে শিক্ষাগ্রহণ করে) গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হন এবং সাফল্যের সঙ্গে মুসলিম নির্যাতনের মাধ্যমে গুরুর পরম সন্তুষ্টি লাভ করেন। গুরুর এই সন্তুষ্টির ফলেই তাঁর প্রমোশন- অর্থাৎ গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থেকে ভারতরাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী।
না, নরেন্দ্র মোদির ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রাপ্তি কেবল আরএসএসের সন্তুষ্টির ফলেই ঘটেনি। এর পেছনে বিশেষ সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে ভারতের বৃহৎ বুর্জোয়া গোষ্ঠী। প্রশ্ন হতে পারে, বৃহৎ বুর্জোয়ারা হঠাৎ করে এমন হিন্দুত্ববাদী হয়ে গেল কী করে? তারা কি 'শেষের সেদিন ভয়ংকর'-এর কথা ভেবে ধর্মচর্চায় মন দিয়েছে, এবং আরএসএসের কাছে দীক্ষা গ্রহণে প্রবৃত্ত হয়েছে?
উত্তরে বলতে হয়, ব্যক্তিগতভাবে অন্যদের মতো বৃহৎ বুর্জোয়াদেরও যে কেউ হিন্দুত্ববাদী কিংবা যেকোনো ধরনের ধর্মবাদী হতে পারে, কিন্তু শ্রেণিগতভাবে কখনো ধর্মবাদী বা অধর্মবাদী হয় না, সব কিছুর ওপরে তারা শ্রেণিস্বার্থবাদী। শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনে তারা যেকোনো সময়ে যেকোনো রূপ ধরতে পারে, যে কারো পৃষ্ঠপোষক হতে পারে, যে কাউকে ঘাড়ে তুলে নিতে পারে অথবা যে কারো ঘাড়ে চড়ে বসতে পারে। যেকোনো ধর্ম (রিলিজিয়ন বা ধর্মতন্ত্র) নিয়েও তারা তেমনই করতে পারে। সমাজে বা রাষ্ট্রে যে গোষ্ঠী শাসনক্ষমতা করায়ত্ত করে বসে, তাদের সম্পর্কে খ্রিস্টের জন্মের ২০০ বছর আগে ইতালির দার্শনিক সেনেকা যা বলেছিলেন তার মূলকথাটা এ রকম- রাষ্ট্রের প্রকৃত শাসক বা কর্তৃত্বশীল গোষ্ঠী কোনো বিশেষ ধর্মের অনুসারী বা বিরোধী কোনোটিই হয় না, ধর্মকে তারা ব্যবহার করে তাদের নিজেদের স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার রূপে। এতাবৎকাল ধরে সব দেশের কর্তৃত্বশীলরাই এমনটি করে এসেছে। ভারতের বর্তমান বুর্জোয়ারাই বা তার ব্যতিক্রম হবে কেন?
নিজেদের স্বার্থের অনুকূল বিবেচনা করেই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস অনুসৃত ও ঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষতাকে বৃহৎ বুর্জোয়ারা সমর্থন জুগিয়েছে এবং বেশ কিছুদিন কংগ্রেসের হাত ধরেই সে স্বার্থ তারা অনেক পরিমাণে হাসিলও করে নিয়েছে। একপর্যায়ে সেই কংগ্রেস দলটির ভেতরে যখন ঘুণ ধরে যায়, জনগণ যখন সে দলটির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং ধর্মনিরপেক্ষতাবিরোধী বিজেপি অনেক শক্তিমন্ত হয়ে ওঠে, বৃহৎ বুর্জোয়ারাও তখন ধর্মনিরপেক্ষতাকে ছিন্ন চটিকার মতো ছুড়ে ফেলে দিয়ে বিজেপির হিন্দুত্বের তরণীতে উঠে বসে। এখানে বসেও তারা তাদের শ্রেণিস্বার্থ ষোলো আনাই আদায় করে নিচ্ছে। বিজেপি যে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বোঝাপড়ার এবং এতাবৎকাল ধরে অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতিকে বহাল রাখার পথ ধরে চলছে, তেমনটিই তো স্বাভাবিক। কারণ এ ক্ষেত্রে বৃহৎ বুর্জোয়ার সঙ্গে তার স্বার্থ এক ও অভিন্ন।
অন্যদিকে বিজেপি দেশের অভ্যন্তরে হিন্দুত্ববাদের যে চাষবাস করে যাবে, তাতে স্বার্থের সঙ্গে সংঘাত সৃষ্টি না হলে বৃহৎ বুর্জোয়া তার নাক গলাবে না। অর্থাৎ বিজেপির রাজত্বকালে দেশটিতে পুঁজিবাদী শোষণ ও ধর্মতন্ত্রী সাম্প্রদায়িকতা পরস্পর হাতে হাত রেখে চলবে। বলা যেতে পারে, ২০১৪ সালে প্রতিক্রিয়ার রাহু ভারতের প্রগতির সূর্যকে গ্রাস করে ফেলেছে।
তবে মনে রাখা প্রয়োজন, বিষয়টি মোটেই একমাত্রিক নয়। নির্বাচনে বিজেপির নিরঙ্কুশ বিজয়ে ভারতের জনগণ নিশ্চয়ই বোবা-কালা বা অন্ধ হয়ে যায়নি। প্রগতির সূর্যও অবশ্যই চিরকালের জন্য প্রতিক্রিয়ার রাহুগ্রস্ত হয়ে থাকবে না। জনগণ বরং এখন আপন অধিকার সম্পর্কে আরো বেশি সচেতন হয়ে উঠছে, নিজেদের ভেতরকার বিভেদ-বিসংবাদ পরিহার করে শোষকদের বিরুদ্ধে ক্রমেই যে তারা সংহত ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠবে, প্রগতির পালেই যে জোর হাওয়া লাগবে, তার প্রমাণ এখনই পাওয়া যাচ্ছে। ক্ষমতার গদিতে বসেই বিজেপি যে রেলের ভাড়া বৃদ্ধি করেছে, দ্রব্যমূল্যও অনেক বেড়ে গেছে, এর বিরুদ্ধে জনগণ সোচ্চার হয়ে উঠেছে। এরই মধ্যে নরেন্দ্র মোদির সরকার সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি খেয়েছে সরকারি কাজের সর্বক্ষেত্রে হিন্দি ভাষার ব্যবহারকে বাধ্যতামূলক করতে গিয়ে। সরকার এ সম্পর্কে নির্দেশ দিয়ে একটি 'পরিপত্র' জারি করার সঙ্গে সঙ্গেই অহিন্দিভাষী জনগণ এর তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে। সেই প্রতিবাদের মুখে সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে।
বিজেপির দিল্লিতে গদিনশিন হওয়ার ফলেই ভারতের সব রাজ্যে তার নিরঙ্কুশ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়নি। বিশেষ করে অহিন্দিভাষী সব কটি রাজ্যেই তো বিজেপিবিরোধীদের প্রতাপান্বিত অবস্থান। সেই অবস্থানে থেকেই সেই সব রাজ্যের জনগণ তাদের সমস্যা-সংকটের সমাধানের পথ বেছে নেবে, প্রগতির অভিমুখেই চলবে তাদের পথযাত্রা। হিন্দিভাষী রাজ্যের জনগণও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোকে রুখে দাঁড়াবেই। হিন্দি ও হিন্দুত্বের মৌতাতে কেউই তাদের দীর্ঘকাল আচ্ছন্ন রাখতে পারবে না। কারণ ইতিহাসের গতি প্রগতির অভিমুখেই। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সব দেশে সব যুগেই প্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতার ঢাল খাড়া করে রাখে, তাতে কিছুকালের জন্য প্রগতি প্রতিরুদ্ধ হয় অবশ্যই। তবে সে রকম প্রতিহত হওয়া নিতান্ত 'কিছুকালের' জন্যই, চিরকালের জন্য তো নয়ই, এমনকি দীর্ঘকালের জন্যও নয়। অর্থাৎ কখনো 'পোহাবে না যাহা তেমন রাত্রি নাই।'
আমাদের প্রতিবেশী ভারতরাষ্ট্রের প্রগতি ও প্রতিক্রিয়ার দ্বন্দ্ব নিয়েই এতক্ষণ ধরে বাগ্বিস্তার করলাম। সেই সঙ্গে উপমহাদেশের নিকট-অতীতের ইতিহাসও একটু ছুঁয়ে গেছি। এখন প্রয়োজন আলাদাভাবে আমাদের স্বদেশ অর্থাৎ বাংলাদেশের সমস্যা-সংকট ও প্রগতি-প্রতিক্রিয়ার দ্বন্দ্বের দিকটিতে দৃষ্টি দেওয়া। পরবর্তী লেখায় তেমনটিই করতে চেষ্টা করব।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সংগঠক
http://www.kalerkantho.com/feature/sub-editorial/2014/07/23/110006
Related:
Partition and Bengal: A book review of Joya Chatterji's 'The Spoils of Partition'
by A G Noorani, 25 February 2009
http://www.sacw.net/article696.html
Bengal Divided: Hindu Communalism and Partition, 1932-1947 (Cambridge South Asian Studies) by Joya Chatterji (Jun 30, 2002)
Whereas previous studies of the end of British rule in India have concentrated on the negotiations of the transfer of power at the all-India level or have considered the emergence of separatist politics amongst India's Muslim minorities, this study provides a re-evaluation of the history of Bengal focusing on the political and social processes that led to the demand for partition in Bengal and tracing the rise of Hindu communalism. In its most startling revelation, the author shows how the demand for a separate homeland for the Hindus, which was fuelled by a large and powerful section of Hindu society within Bengal, was seen as the only way to regain influence and to wrest power from the Muslim majority. The picture which emerges is one of a stratified and fragmented society moving away from the mainstream of Indian nationalism, and increasingly preoccupied with narrower, more parochial concerns.
- First book to consider events that led up to partition of Bengal and to examine the issue of Hindu communalism
- Breaks from traditional historical approach which concentrated on British policy on making up to Independence and Muslim separatism
- Author is of the new generation of South Asian scholars
The Spoils of Partition: Bengal and India, 1947-1967 (Cambridge Studies in Indian History and Society) by Joya Chatterji (Dec 10, 2007)
Bengal Partition Stories: An Unclosed Chapter
Despite numerous critical enquiries into the history, politics and social dynamics that contributed to the partition of Bengal, there remains a distinct lack of in-depth exploration into the personal experiences of those directly affected. Through oral histories, interviews and fictional retellings of the event and its aftermath, 'Bengal Partition Stories' seeks to fill this gap by unearthing and articulating the collective memories of a people traumatised by the brutal division of their homeland.
__._,_.___