'১৯৭১ ॥ ভেতরে বাইরে' এবং কিছু কথা
অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী
বিগত ২ সেপ্টেম্বর এ কে খন্দকারের '১৯৭১ : ভিতরে-বাইরে' বইটির প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। অনেকটা রবাহত হয়ে আমি সে উৎসবে উপস্থিত ছিলাম। সঠিক সময়ের আগেই পৌঁছে দেখলাম বড় যোদ্ধারা ও লেখকগণ সামনের সব ক'টি আসন দখল করে কিংবা সতীর্থদের জন্য সংরক্ষণ করে বসে আছেন। বেশ একটু পেছনে বসে আলোচনা শুনতে শুরু করলাম। স্বভাবতই এই আলোচনায় এ কে খন্দকার একজন বক্তা থাকবেন, কিন্তু তিনি যে প্রথম বক্তা হবেন তা অবশ্যই আশা করিনি। তিনি বক্তব্য রাখলেন এবং সব বিচারে তাঁর বক্তব্যটি সংক্ষিপ্ত ছিল। তাঁর বক্তব্যের অংশবিশেষ কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা পরদিন তুলে ধরেছে।
বক্তৃতা শোনার পূর্বেই আমি সুলভ মূল্যে বইটি কিনে নিয়েছিলাম এবং পড়তে শুরু করেছিলাম। পড়তে গিয়েই আমার চোখ এক জায়গায় থেমে গেল। খন্দকার সাহেব লিখেছেন, 'আমি এই বই লেখার জন্য উদ্বুদ্ধ হয়েছি মূলত তরুণ প্রজন্মের ইতিহাস জানার আগ্রহ থেকে। তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে চায়, অথচ সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাবে তারা বিভ্রান্তিতে পড়ে যাচ্ছে। সত্য ও মিথ্যাকে তারা আলাদা করতে পারছে না। আমার এই বই তাদের জন্য (পৃষ্ঠা-১১)। অর্থাৎ নতুন প্রজন্মের বিভ্রান্তি নিরসনের জন্য মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছর পর তাঁর এই বই। তিনি মুক্তিযুদ্ধে ২৮ মে ১৯৭১ সাল থেকে অংশ নিয়েছেন। ডেপুটি চীফ অব স্টাফের পদমর্যাদা লাভ করেছেন। এই ডেপুটি চীফ অব স্টাফের বঙ্গানুবাদ হচ্ছে উপপ্রধান সেনাপতি। তাহলে ওসমানী ছিলেন চীফ অব স্টাফ। বাস্তবে কিন্তু তা নয়। ওসমানীকে কেউ কেউ আজও সর্বাধিনায়ক হিসেবে উল্লেখ করে আনন্দ পান কিংবা নিজের অবস্থানকে উচ্চতর করেন। কিন্তু খন্দকার সাহেব তাঁর গ্রন্থে কর্নেল বা জেনারেল পদবীসহ ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি বলে সর্বত্র উল্লেখ করেন। তাঁর পরের অবস্থানে রইলেন কর্নেল রব যিনি একজন গণপ্রতিনিধিও ছিলেন। কর্নেল রবের সামরিক মর্যাদা খন্দকার সাহেবের থেকে কম থাকলেও তাঁকে টপকিয়ে রব সাহেব চীফ অব স্টাফের পদটি পেয়ে যান। খন্দকারের লেখায় মনে হয়েছে এ ব্যাপারে তিনি বরাবরই বিক্ষুব্ধ ছিলেন। মনে হয়েছে যে, কর্নেল রব ছিলেন ঢাকের বায়া আর পুরো যুদ্ধকালে অর্থাৎ ২৮ মে থেকে যুদ্ধের সমাপ্তি পর্যন্ত তিনি কর্নেল রবের সব কাজই করেছেন। সে সুবাদে তিনি নিজকে উপপ্রধান সেনাপতি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং এ যাবত লেখালেখিতে তাঁর নাম কখনও ডেপুটি চীফ অব স্টাফ বা কখনও উপ-প্রধান সেনাপতি হিসেবে দেখে এসেছি।
বইটিতে এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন যে, তিনি ১৯৪৭ সালে ম্যাট্রিক পাস করে সে সালে রাজশাহী সরকারী কলেজে ভর্তি হন। ১৯৬৩ সালে তিনি ৩৪ বছর বয়সে উইং কমান্ডার সাইফুর মীর্জার ছোট বোন ফরিদা মীর্জার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ১৯৫১ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পাকিস্তানে চাকরি করেন এবং পাকিস্তানে অবস্থানকালে পাকিস্তানী কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ভাল ব্যবহার পেয়েছেন (পৃষ্ঠা ২০)। মুক্তিযুদ্ধে উপপ্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করলে পাকিস্তানীরা তাঁর ভাইদের ধরে নিয়ে যায়। তাদের কাছ থেকে তাঁর খোঁজ খবর নিলেও তাঁদের কোন ক্ষতি বা তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেননি, এমনকি তাঁকে কাজে দ্রুত পুনঃ যোগদানের তাগিদ দিয়ে তাঁদের ভাইদের বাড়ি পাঠিয়ে দেন (পৃষ্ঠা-২১৩)। সেদিক দিয়ে তিনি সৌভাগ্যবান কেননা মুক্তিযুদ্ধে আমাদের জানমাল, সহায় সম্বল, ইজ্জত সম্ভ্রমের প্রভূত ক্ষতি হয়েছিল।
খন্দকার সাহেব ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানে এলেও সে সময় গণঅভ্যুত্থান বা বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে তেমন কোন ধারণা তাঁর ছিল না। এমনকি ছাত্রাবস্থায় বাঙালী জাতীয়তাবাদের উন্মেষ লগ্ন ও সূতিকাগার ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিল বলে মনে হয় না। পাকিস্তান আমলে তিনি ও তাওয়াব পূর্ব পাকিস্তানের জ্যেষ্ঠ বৈমানিক ছিলেন। এই তাওয়াবই বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর চাঁদতারা মার্কা পতাকা চেয়েছিলেন যদিও তাঁর পত্নী ছিলেন জার্মান। খন্দকার সাহেব ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারতের যুদ্ধে সার্বক্ষণিক ককফিটে অবস্থান করেন, বীরত্বপূর্ণ অপারেশনে অংশ নেন কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে কোন একটি অপারেশনে তিনি ব্যক্তিগতভাবে অংশ নেননি। তাঁর মূল দায়িত্বটা ছিল প্রশাসনিক, পরামর্শমূলক, সংযোগ সমন্বয়কারী ও প্রশিক্ষণদাতার। এমন দায়িত্ব আমি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনীর হয়ে পালন করি। প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগ দিয়ে ৭ এপ্রিল থেকেই পূর্বে গঠিত বিএলএফ বা শ্রদ্ধাভরে নামাঙ্কিত মুজিব বাহিনীর পুনর্গঠন শুরুর কাজে আত্মনিয়োগ করি। খন্দকার সাহেব মুজিব বাহিনীর নামকরণে জেনারেল এসএস ওবানের ভূমিকা দেখেছেন।
এবারে মূল প্রসঙ্গের অবতারণা করছি যদিও খন্দকার সাহেবের প্রদত্ত বক্তব্যের অংশবিশেষ পত্রিকায় এসেছে। সহৃদয় পাঠক তা দেখে নিতে পারেন (৩ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোসহ আরও কিছু পত্রিকা)।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন- 'সত্যকে মিথ্যা ও মিথ্যাকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রতিযোগিতা এখনও চলছে।' বিষয়টি মাথায় রেখে প্রকৃত ঘটনা লেখার চেষ্টা তিনি করেছেন। তিনি বলেন, 'যে জাতি সত্যকে লালন করতে পারে না, প্রকৃত ইতিহাসকে যারা বিকৃত করে সেখানে সত্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না' (প্রথম আলো, ৩ সেপ্টেম্বর)। তাই তিনি সত্য প্রকাশে অনড় থাকার পরামর্শ দেন এবং কোন রকম ভ-ামি, অতিরঞ্জনকরণ বা প্রকৃত ঘটনার বিকৃতি কখনও ক্ষমার যোগ্য হবে না বলেও উল্লেখ করেন। তাঁর বক্তব্যে তুমুল করতালির সঙ্গে আমিও হাত সংযোজিত করি। কিন্তু কিয়ৎক্ষণ পরে ডাক্তার সারোয়ার আলীর বক্তব্যে আমার সত্য নিয়ে খটকা বাধে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ খন্দকার সাহেব ক্যান্টনমেন্টে বসে শুনেছেন। তিনি লিখেছেন: '৭ মার্চের ভাষণের দিন ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের পরিস্থিতি বেশ স্বাভাবিক ছিলÑসবাই ব্যস্ত ছিল নিজ নিজ কাজে' (পৃষ্ঠা-৩১)। লক্ষণীয় যে এই নিজ নিজ কাজে ব্যস্তদের নিয়ে তিনি অতর্কিত হামলা করে বিনা রক্তপাতে স্বাধীনতা অর্জনে প্রত্যাশী ছিলেন। তিনি ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে বলেন যে, 'বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণেই মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল তা আমি মনে করি না। এই ভাষণের শেষ শব্দ ছিল 'জয় পাকিস্তান।' সত্যি কথা কি সেখানে দুটো শব্দ ছিল। তিনি যদি একই সঙ্গে জয় বাংলা ও জয় পাকিস্তান শব্দ গুচ্ছ ব্যবহার করতেন তা হলে তাঁর পেশাজীবীর সততা, সৈনিকের সততা, যোদ্ধার সততা ও একজন নির্মোহ রাজনৈতিক ব্যক্তির সততা কিছুটা হলেও প্রকাশ পেত, কারণ তাঁর দু'জন সহযোগী আগে এমন কথা বলেছেন। তবে মনে হয় তাঁর আসল মতলব ছিল ঐসব মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবীর বক্তব্য খ-ন যারা ৭ মার্চের ভাষণেই প্রকারান্তরে স্বাধীনতার আহ্বান ছিল বলে নিশ্চিত। আসলে তিনি বুঝাতে চেয়েছেন, যে বক্তব্য 'জয় বাংলা' দিয়ে শেষ হয়, তাতে কি স্বাধীনতার আহ্বান না পাকিস্তান রক্ষার অভিপ্রায় ব্যক্ত থাকে? যাঁরা বঙ্গবন্ধুর ভাষণে জয় বাংলা ও জয় পাকিস্তান শুনেছেন তাঁরা হলেন বিচারপতি হাবিবুর রহমান ও শাজাহান সিরাজ। এই দু'জন ছাড়া ১০ লাখ শ্রোতার কেউই এমন শব্দগুচ্ছ শুনেননি; তাঁরা শুধু জয় বাংলা শুনেছেন। শাজাহান সিরাজ রেস কোর্সে উপস্থিত হয়ে শুনলেন যে, বঙ্গবন্ধু জয় বাংলা-জয় পাকিস্তান বলে তাঁর ৭ মার্চের ভাষণ শেষ করেন। তাঁর এমন উচ্চারণের প্রয়োজন ছিল। কেননা সেটা তাঁর মন্ত্রী হবার কাজে লেগেছে।
এই সমালোচনা আমার ছিল, কেউ পড়েছেন কিনা জানি না। হাবিবুর রহমানের বক্তব্যের সমালোচনাও আমিসহ অনেকে করেছেন। এ কথার প্রতিধ্বনি সারোয়ার আলীর বক্তব্যে অর্থাৎ খন্দকার সাহেবের বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে শুনেছি। সারোয়ার আলী যুক্তি ও দালিলিক প্রমাণ দিয়ে বলতে চেয়েছেন খন্দকারের এই বক্তব্যটি বিতর্কের সূচনা করবে। একই কথা দু'একজন আলোচক অতি দুর্বলভাবে উত্থাপন করার প্রয়াস যে পাননি তা নয়। সামনের সারিতে উপবিষ্ট একজন শ্রোতা এ ব্যাপারে কিছু বলতে গিয়ে বসে যেতে বাধ্য হন এবং আসন ছেড়ে চলে যান। আমরা কয়েকজনও ওসমানীর নামের সঙ্গে 'সর্বাধিনায়ক' শব্দটি উচ্চারিত হলে মৃদু প্রতিবাদ করি এবং সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে উপস্থিত থেকে ৭ মার্চে যা শুনেছিলাম তা বলতে সুযোগ খুঁজেছিলাম।
তারপরের আলোচক ছিলেন অধ্যাপক আলী রিয়াজ। তাঁর বক্তব্য পরদিনের প্রথম আলো পত্রিকায় নিবন্ধ আকারে এসেছে এবং বিদগ্ধ পাঠক হয়ত তা পড়েছেন। তবে তাঁদের কারও বক্তব্যে খন্দকার সাহেব উত্থাপিত প্রসঙ্গসমূহ সঠিকভাবে আলোচিত হয়নি। তাঁর উত্থাপিত প্রসঙ্গগুলো ছিল বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার কথা বলেননি, তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা বা অর্জনের কোন লক্ষ্য, কৌশল বা কর্মসূচী গ্রহণ করেননি; তিনি ২৬ মার্চ কস্মিনকালেও স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি, যুদ্ধকালে তাজউদ্দীন আহমদ ছাড়া অন্যরা ছিলেন নিষ্কর্মা, কলহে বা বিলাস ব্যসনে ব্যস্ত; যুদ্ধের ব্যাপারে অনিবেদিত ও অজ্ঞাত, ভারতীয়দের অনীহা বা দোদুল্যমানতা, যোদ্ধা সংগ্রহে আওয়ামী লীগের প্রাধান্য, মুজিব বাহিনীর দৌরাত্ম্য, তাঁকে টপকিয়ে জেনারেল রবকে চীফ অব স্টাফ নিয়োগ বা তাঁকে সমর কাউন্সিলের প্রধানের পদ না দেয়া। প্রসঙ্গত তিনি চীফ অব স্টাফের দায়-দায়িত্ব বর্ণনা করেন এবং যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত সে দায়িত্ব পালন করেই সম্ভবত তিনি উপপ্রধান সেনাপতি অভিধা গ্রহণ করেন।
মুজিব বাহিনী সম্পর্কে মিথ্যা, কল্পিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কথা থাকলেও যুদ্ধকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকাবস্থায় মুজিব বাহিনীর একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে উসখুস ছাড়া টু-শব্দটি করার আমার অবকাশ ছিল না। তবে আলী রিয়াজ যখন তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করলেন যে, মুজিব বাহিনী নিয়ে বহু কথা হলেও তা নিয়ে শীর্ষ নেতারা কোন ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থ লেখেননি। এ কথা শুনে আমি আলী রিয়াজকে সাবেক সহকর্মীর দাবি নিয়ে একটি চিরকুট পাঠাই এবং তাতে উল্লেখ করি যে, মুজিব বাহিনীর ওপর ১৯৯৭ সালে মুদ্রিত আমার লেখা একটি গ্রন্থ আছে। তিনি চাইলে আমি তাঁকে বইটি দিতে পারি। তিনি মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিলে আমি বইটি বাসা থেকে আনিয়ে তাঁকে দেই। ভুল সংশোধন করে বলছি বইটি ১৯৯৮ সালে বই আকারে প্রকাশিত হলেও তার অনেক কিছু প্রবন্ধ বা নিবন্ধ আকারে এর আগ থেকে প্রকাশিত হয়। আমি আশা করেছিলাম যে তিনি অনুষ্ঠানের মাঝেই তাঁর এই ভুলটা সংশোধন করবেন। তিনি তা করেননি। পরের দিন তাঁর নিবন্ধে তা খুঁজে বেড়াই; কিন্তু তাঁর কিছু খুঁজে পাইনি। তবে তাঁর নিবন্ধে কতিপয় মূল্যবান কথা এসেছে। তিনি খন্দকারের বইটিকে আকর গ্রন্থ হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করেছেন। শেখ মুজিব যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন খন্দকারের মতো তিনিও দালিলিক প্রমাণ দাবি করেন ও মুক্তিযোদ্ধা এবং নেতৃত্বের অনৈক্য, কোন্দল ও ভেতরকার দ্বন্দ্ব বিষয়ে খন্দকারের ভাষ্যের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেন। তাজউদ্দীন আহমদের বদলে অন্য নেতৃত্ব হলে বাংলাদেশ স্বাধীনই হতো না বলে তিনি মন্তব্য করেন।
প্রধান অতিথি হিসেবে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের বক্তব্যের অনুরণন আমার কানে আগেও বেজেছে। তিনি শারমিন আহমদ প্রণীত তাজউদ্দীন : নেতা ও পিতা (২০১৪) গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবে যা বলেছেন তার কিছুটা পুনরাবৃত্তি এখানে ঘটেছে। তবে শারমিনের বইয়ের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো তিনি পিতার স্বকণ্ঠ কথা বা বক্তব্যের চেয়ে চাচাদের ওপর বড্ড নির্ভর করেছেন। রাত নয়টায় তাজউদ্দীন সাহেব চলে আসার পরও স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া যেতে পারে কিংবা বিভিন্ন মাধ্যমে দেয়া হয়েছে তার উল্লেখও শারমিনের বইতে আছে। ৭ মার্চের ভাষণ বা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে পরিমিত আলোচনাসহ প্রফেসর আনিসুজ্জামান মুজিব বাহিনীর প্রসঙ্গেও কথা বলেছেন। এসব আগেও তিনি উদ্ধৃত আকারে মইদুল হাসান বা অন্যদের বই থেকে তুলে ধরেছেন। তবে তিনি একটি নতুন তথ্যের অবতারণা করেছেন যার ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে। তিনি বলেছেন, '১৯৭১-এর অক্টোবর মাসে আগরতলা গিয়ে তিনি একটি লিফলেট হাতে পান। মুজিব বাহিনীর নামে প্রচারিত এই লিফলেট পাকিস্তানকে এক নম্বর, বামপন্থীদের দুই নম্বর ও তাজউদ্দীন সরকারকে তিন নম্বর শত্রু উল্লেখ করে সবাইকে উৎখাতের আহ্বান ছিল বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। মুজিব বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা ও নীতিনির্ধারক হিসেবে অতি কাছে এই আগরতলায় থেকেও আমি এ ব্যাপারে অবগত ছিলাম না; যদিও বামপন্থীদের সঙ্গে দু'একটি সংঘাত ও সংঘর্ষ এবং তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে মুজিব বাহিনীর শীর্ষ কয়েকজনের মন কষাকষির কথা আমার জানা ছিল। এই সব প্রসঙ্গে আমি 'মুক্তিযুদ্ধ ও মুজিব বাহিনী' গ্রন্থে কিংবা 'এক দেহ দুই প্রাণ' (২০০৬) গ্রন্থে উল্লেখ করেছি।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ অনেকেই অনেকভাবে দিয়েছেন, আমিও দিয়েছি। ১৯৭১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের সঙ্গে প্রথম মুখোমুখি আলোচনা ও পরে টেলিফোনে আলোচনার পর বঙ্গবন্ধু সশস্ত্র যুদ্ধে দেশ স্বাধীন করার সিদ্ধান্ত আমার এবং শেখ ফজলুল হক মণির কাছে ব্যক্ত করেন। ভারতে যে তিনি ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা আগেই রেখেছিলেন তাও আমাদের জানালেন। খন্দকার সাহেবও এমন ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা ছিল বলে মেনে নিয়েছেন। তাজউদ্দীন সাহেব যে তথ্য-বিভ্রান্তির কারণে চিত্ত সুতারের সঙ্গে প্রথমবার দেখা করতে না পারলেও দ্বিতীয় দফায় বঙ্গবন্ধু মনোনীত সেই চিত্ত সুতারের সঙ্গে মুজিব বাহিনীর নেতাদের নিয়ে একত্রে বসেছিলেন সে কথা অনেক গ্রন্থে আছে। আমি এই তথ্য বহু লেখায় ও বক্তব্যে উপস্থাপন করেছি। বঙ্গবন্ধু ট্রেনিং, অর্থায়ন ও সার্বিক ব্যবস্থার জন্য চিত্ত সুতারের কথা উল্লেখ করে ইতোমধ্যে কি কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তার উল্লেখ করেন। বঙ্গবন্ধুর কথার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ৩ মার্চ পূর্বাহ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সভা মোজাফফর চৌধুরীকে দিয়ে আহ্বান করিয়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আমি স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপন করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু'জন শিক্ষক সমর্থন করলে তারস্বরে আমি তা ঘোষণা করি। এ দু'জন শিক্ষক উপাচার্য হিসেবে অবসর নিয়েছেন এবং বর্তমানে বেঁচে আছেন। তাঁদের নাম দুর্গাদাস ভট্টাচার্য ও শহীদ উদ্দিন আহমদ। আর একটি প্রশ্ন. তাজউদ্দীন সাহেব কোন্্ ভিত্তিতে দিল্লী যাবার আগেই চিত্ত সুতারের বাড়ি খুঁজতে গিয়েছিলেন। কোন আলোচনা না হলে বা সিদ্ধান্ত না থাকলে তিনি তাঁকে খুঁজতে যাবেন কেন? চিত্ত সুতার নাম বদলিয়ে ভারতে অবস্থান করছিলেন বলে তিনি প্রতিবেশীদের কাছে জিজ্ঞেস করে প্রথম দফায় তাঁর খোঁজ পাননি। আগেই বলেছি পরবর্তীতে তিনি সেখানে উপস্থিত হয়ে চিত্ত সুতারসহ মুজিব বাহিনীর নেতাদের সাক্ষাত পান। প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ডাক্তার আবু হেনাও পূর্বাহ্নে এই ট্রেনিংয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এই ট্রেনিং প্রাপ্তির ব্যবস্থা যে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধের সিদ্ধান্ত ও প্রস্তুতি ছাড়াই রেখেছিলেন তা কোন অবস্থাতেই মনে করার সঙ্গত কারণ নেই।
প্রকাশনা অনুষ্ঠানের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বইটির লেখক হিসেবে মইদুল ইসলামকে চিহ্নিত করেছিলেন। আমরা তার ভুলটির ইঙ্গিত করলে তিনি তা সংশোধন করেন। তবে তিনি যে মইদুল হাসান দ্বারা আক্রান্ত ও আপ্লুত তা বোঝা গেল। তিনি আরও লিখবেন বলে জানান দিয়ে গেছেন। তাঁর লেখার অপেক্ষায় রইলাম। তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন এবং আমি তাঁর অধীনে কিছুদিন সহকারী প্রক্টরের দায়িত্ব পালন করি। যুদ্ধকালে তিনি কোন ভূমিকা পালন করেছেন বলে আমার জানা নেই।
প্রকাশিত গ্রন্থের বিস্তারিত রিপোর্ট প্রথম আলোতে থাকলেও তার ওপর প্রথম লিখিত প্রতিক্রিয়াটি হচ্ছে জনকণ্ঠের। জনকণ্ঠের সংবাদ শিরোনামটি ছিল 'এ কে খন্দকারের বই নতুন অস্ত্র হিসেবে হাতে নিচ্ছে শিবির-বিএনপি।' এমন একটি বোধ আমার মনেও জাগ্রত হয়েছিল ২ তারিখ রাতেই। সেই রাতেই বইটি সম্পূর্ণ পড়ি। আমার তাৎক্ষণিক মনে হলো 'মানুষ ভাবে এক, করে ভিন্ন জিনিস, আর ফলাফল হয় আরও ভিন্নতর'। খন্দকার সাহেব নতুন প্রজন্মের হাতে সঠিক, নির্ভেজাল, অতিরঞ্জনবিহীন, খাঁটি ইতিহাস তুলে দেবার প্রয়াসে যা তুলে দিলেন তা 'কানার হাতে কুড়াল' বই আর কি? তিনি জাতির অপকার করলেন; কিন্তু আমার অশেষ উপকার করলেন।
তিনি মুক্তিযুদ্ধে কেন এলেন, কবে এলেন, কি ভূমিকা পালন করলেন তা তাঁর লেখায় জানতে পেরে আমি তাৎক্ষণিক একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি বীর উত্তম উপাধি ও স্বাধীনতা পদকের জন্য আবেদন জানাব। কেননা, স্বায়ত্তশাসন, স্বাধীনতার সংগ্রাম বা স্বাধীনতা আন্দোলন বাদ দিলেও মুক্তিযুদ্ধে খন্দকার সাহেব যে ভূমিকা পালন করেছেন আমার ভূমিকা তার চেয়ে বেশি। তদুপরি আমি ২৮ মে পর্যন্ত অপেক্ষা না করে, পিছুটানে আক্রান্ত না হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকাবস্থায় প্রথমে প্রতিরোধ যুদ্ধ, পরে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের কোন প্রতিদান ছাড়াই নিরন্তর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে জড়িত আছি। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে অস্ত্রের আগেই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে পত্রিকার সম্পাদনা করেছি। এ সব করেছি বেতন-ভাতা ছাড়া, জীর্ণ-শীর্ণ বস্ত্র পরে, হাতের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে কিংবা অনাহারে বা অর্ধাহারে কাটিয়ে।
পূর্বে বলেছি, খন্দকার সাহেব তাঁর বইতে কর্নেল রবকে অথর্ব ছাড়া অন্য কিছু বলতে বাকি রাখেননি। অথর্ব রব সাহেব বীর উত্তম খেতাব পেয়েছেন? খেতাবপ্রাপ্তদের নির্বাচন ও সর্বশেষ পর্যালোচনা কমিটির প্রধানও খন্দকার সাহেব ছিলেন। তিনি রব সাহেবকে কি বীরত্বের কারণে আর নিজে কোন্ বীরত্বের কারণে বীরউত্তম খেতাব নিলেন, সে প্রশ্ন জাতি করবেই। তিনি বিমানবাহিনী প্রধান ছিলেন, রাষ্ট্রদূত ছিলেন, মন্ত্রী ছিলেন, স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন। সবই পেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে আমার চেয়ে কম ভূমিকার জন্য। আমাকে এ পর্যায়ে এসে তো আর কোন বাহিনী প্রধান করা যাবে না কিংবা মন্ত্রিত্বও দেয়া যাবে না, তবে ১৯৭৩ সালে বীরউত্তম খেতাব দেয়া গেলে কিংবা ২০১১ সালে স্বাধীনতা পদক দেয়া গেলে আমাকে কেন এ সব এখন দেয়া যাবে না? আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, ৪৩ বছর পর বক্তৃতা, বিবৃতি বা লেখায় মিথ্যা, বানোয়াট, কল্পিত ও অতিরঞ্জিত তথ্য দিয়ে ইতিহাস বিকৃতি করব না, বঙ্গবন্ধুকে অবমাননা বা অবমূল্যায়ন করব না, মুক্তিযুদ্ধে রাজনীতিকদের অবদান কিঞ্চিতকর করব না, অবমূল্যায়ন করব না বা আমাদের যোদ্ধাদের দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় শ্রেণীতে টেনে নামাব না, মীমাংসিত বিষয়াদি নিয়ে বিতর্কের সূচনা করে কানার হাতে সময়ে কিংবা অসময়ে কুড়াল তুলে দেব না।
খন্দকার সাহেবের বইটি না পড়েই সংসদে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয়েছে। আমি বইটি আগাগোড়া পড়ে ও সংসদে প্রতিক্রিয়া দেখে তাৎক্ষণিক লিখতে বসলাম। এসব প্রতিক্রিয়া দানকারী অনেকের সঙ্গে আন্দোলন, সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের কাজে ছিলাম। বিনীতভাবে বলতে চাই এমন সব কথা শুধু খন্দকার সাহেব এই প্রথম বলেননি। তিনি 'মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর কথোপকথনে' (২০০৯) এমন কথা পূর্বেও বলেছেন। আমরা তা এড়িয়ে গেছি। এড়িয়ে যাবার ফলাফল হচ্ছে সুচ থেকে ফাল। আমি এ যাবত এমন কিছু গ্রন্থের সন্ধান পেয়েছি যাদের কাজই হলো বঙ্গবন্ধুকে কিঞ্চিতকর করা, মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করা, যোদ্ধাদের ভূমিকাকে খাটো করা, মিত্রদের বিরুদ্ধে তিক্ততা ও ভিত্তিহীন বক্তব্য প্রকাশ করা এবং নিজেকে জাহির করা। এই সব গ্রন্থ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে লাভ হবে না। এ কথা অর্থমন্ত্রী মহোদয় বলার আগেই আমি লিখেছি। আপনারা আপনাদের কথা গুছিয়ে বলুন, অন্যদের সঙ্গে তথ্য আদান প্রদান করুন, থিংক ট্যাংক গঠনে নেতৃত্ব দিন; জাতির কাছে মিথ-মিথ্যাচারিতা বা ইতিহাস বিকৃতির যথোপযুক্ত জবাব দিন। আমি এ ব্যাপারে প্রস্তুত। আমার হাতে জয় বাংলা- জয় পাকিস্তান প্রসঙ্গ, মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা ও মুজিব বাহিনী নিয়ে বেশকিছু তথ্য রয়েছে। অচিরেই আমি সেগুলো গুছিয়ে প্রকাশের জন্য দেব। সত্যি কথা কি এ কে খন্দকারের বইটি আমাকে জাগিয়ে তুলতে সহায়তা করেছে।
৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক