নগর নির্বাচনের বাহাত্তর ঘন্টার মধ্যে ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ নিয়ে শুনানীর ঘোষণায় মনে হয়েছিলো এবার শেখ হাসিনা সরকারকে তুলাধুনা করা হবে। তদুপরি স্পীকার হিসাবে প্রথমে যে তিনজনের নাম এসেছিলো তারা কেউই সরকারকে রেখে ঢেকে কথা বলবেন এমনটা আশা করা যাচ্ছিলো না। বৃহস্পতিবার বেলা চারটের পর শুনানি বা হিয়ারিং শেষ হলে বোঝা গেলো, 'যত গর্জে তত বর্ষে না'। মার্কিন কংগ্রেসের ফরেন রিলেসন্স কমিটির 'বিভক্ত বাংলাদেশি রাজনীতি ও ধর্মীয় উগ্রতা' শীর্ষক এ শুনানী তড়িঘড়ি করে ডাকা হয়। পূর্বাহ্নে চেয়ারম্যান ম্যাট সালমন-এর বক্তব্যে অশনি সংকেত থাকলেও শেষরক্ষা হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশে নৈরাজ্য বিরাজমান। অনেকদিন ধরে দেশটি রাজনৈতিক লাইন বরাবর বিভক্ত এবং ২০১৪-এর নির্বাচনের পর সহিংসতা বহুগুন বেড়েছে, অযথা মানুষ মরছে। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে চরমপন্থী ইসলামী
জঙ্গীবাদ
ভায়োলেন্স ছড়াচ্ছে। এমনধারা চললে ২০০৭-এর মত সামরিক অভ্যুথানের সম্ভবনার কথাও আসে। তারমতে, এসব বিষয়ে আলোকপাত করতেই এই শুনানী।
এদিক থেকে দেখলে নগর নির্বাচন আলোচ্য বিষয়বস্তুর মধ্যে ছিলোনা, কিন্তু ২০১৪-এর ৫ই জানুয়ারীর নির্বাচন ছিলো। 'কান টানলে মাথা আসে', ২০১৪-এর নির্বাচনের সাথে সাথে ২৮শে এপ্রিলের নগর নির্বাচনও বারবার এসেছে। ২০১৪-এর নির্বাচন গ্রহনযোগ্য ছিলো তা যেমন কেউ বলেননি, তেমনি কেউ বলেননি যে সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হয়েছে। সবাই একবাক্যে নগর নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির কথা বলেছেন, অথবা প্রতিবাদ করেননি। প্রায় সবাই বলেছেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংঘাত চলতে থাকলে ইসলামী জঙ্গীবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে
।
আলামত হিসাবে
চাপাতির আঘাতে অভিজিত ও অশিকুরের মৃত্যু
র কথা উল্লেখিত হয়েছে।
হিন্দু আমেরিকান ফাউন্ডেশনের জয় কানসারা
একটু এগিয়ে
বলেছেন, 'গুলির মত চাপাতির আঘাতে সাথে সাথেই কারো মৃত্যু
হয়না।
অভিজিতের ওপর হামলার সময় পুলিশ কাছেই দাড়ানো ছিলো, অথচ কিছুই করেনি, পুলিশ ব্যর্থ।'
আমাদের দেশে অনেকেই মনে করেন, এসব শুনানী-টুনানী অর্থহীন। আপাত: দৃষ্টিতে তা-ই, কিন্তু এর একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব থাকে। এটা বেশ উচ্চ্-পর্যায়ের শুনানী এবং ওয়াশিংটনের নীতি-নির্ধারক মহলের কর্মীরা এতে উপস্তিত থাকেন এবং তারা যা রিপোর্ট করেন, সাধারনত: নেতারা সেইমত কাজ করেন। যেমন, কংগ্রেসওমেন গ্রেস মেং জিএসএ সম্পর্কে বলেছেন, বাংলাদেশ সরকার গার্মেন্টস ক্ষেত্রে অনেক কিছুই করেছেন, কিন্তু শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা বা কাজের পরিবেশ উন্নয়নে ব্যর্থ হয়েছেন। একথার অর্থ এই যে, বাংলাদেশ আপাতত: জিএসএ সুবিধা পাবেনা। শুনানীতে পাঁচজন বক্তার কেউই বলেননি যে, বাংলাদেশকে জিএসএ সুবিধা থেকে বঞ্চিত রাখাটা ঠিক হচ্ছেনা! মনে রাখা দরকার, যারা বক্তা ছিলেন, তারা কেউ আমাদের সরকারী কর্মচারী নন, বা তাদের কারো রক্তচক্ষুকে তোয়াক্কা করতে হয়না, তারা যা ভালো বুঝেন, তা-ই বলেন। সিটিং গভর্নমেন্টের প্রশংসা করতে এগুলো হয়না, সুতরাং --।
বক্তাদের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশী ইলিনয়েস ভার্সিটির অধ্যাপক আলী রিয়াজ, নিজের যোগ্যতায় তিনি ওয়াশিংটনে জায়গা করে নিয়েছেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে ওখানে তার চেয়ে ভালো আর কে জানে। যুদ্ভাপরাধীদের বিচারের পক্ষে ২০১৩ সালের ২০শে নভেম্বরের হিয়ারিং-এ তার স্পস্ট অবস্থান ছিলো। আলী রিয়াজ সংলাপের কথা বলেছেন। নগর নির্বাচন বা ২০১৪ সালের নির্বাচন সম্পর্কে তার ভাষণে অনেকে হয়তো খুশি হবেন না, সম্ভবত: তিনি সেটা জানেন এবং জানেন বলে পরক্ষনেই বলেছেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্টানিকতা না পেলে এসব বন্ধ হবেনা। তিনি এও বলেছেন, গণতন্ত্রের পরিসর কমছে এবং এর পরিনতি শুভ নয়। আমাদের দেশে গত দুই বছর ধরে যা চলছে, তাতে পক্ষে বলার মত খুব বেশি কিছু কি আছে? এই শুনানিতে আলী রিয়াজ বেশ সংকুচিত ছিলেন বলেই মনে হয়েছে এবং তিনি সমাপনী বক্তব্যও দেননি।
হিয়ারিং-এ ফরেন রিলেশন্সের সিনিয়র ফেলো এলিসা আয়ার্স ব্লগার হত্যা প্রসঙ্গে
বলেন যে,
ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশে একসাথে ৫শ বোমা ফুটেছিলো এবং তখনকার পরিস্থিতির চেয়ে এখন অবস্থা ভালো। তবে তিনি এও বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতি অর্থনীতির প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। তিনি দুইটি বড় দলের মধ্যে সমঝোতার প্রসঙ্গও আনেন। ইউএস-বাংলাদেশ বানিজ্য এসোসিয়েশনের সভাপতি স্টিভেন ডি ফেলিসি বলেছেন, অশান্ত রাজনৈতিক পরিস্তিতি সত্বেও বাংলাদেশের উন্নয়ন চোখে পড়ার মত। তিনি অর্থনৈতিক উন্নয়নে সুস্থ রাজনীতির অপরিহার্যতা তুলে ধরতে ভুল করেননি। এতে বিচার বহির্ভূত হত্যার কথা এসেছে। সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রসঙ্গ এসেছে। মানবাধিকার, হত্যা, গুম, অরাজকতা, ভোট কারচুপি সই এসেছে। অর্থাৎ আমাদের যা কিছু খারাপ, সবই এসেছে। একটি দেশ নিয়ে যত বেশি হিয়ারিং হবে আমাদের ভাবমুর্ক্তি ততটাই ম্লান হবে। এই হিয়ারিংও ব্যতিক্রম নয়। এই হিয়ারিং-এ মুখ্য যেটা উঠে এসেছে তা হলো, রাজনৈতিক সন্ত্রাস না কমলে বা সুস্থ রাজনৈতিক পরিস্থিতি না থাকলে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ মাথাচাড়া দেবে। এও বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, জামাত সম্পর্কে মার্কিন অবস্থান মোটেও পাল্টায়নি।
তাই সমাপনী বক্তব্যে ফরেন রিলেশন্সের সিনিয়র ফেলো এলিসা আয়ার্স-এর কথা সবাইকে ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে
দিয়েছে।
সম্ভবত: জয় কানসারার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, জামাতকে নিষিদ্ধ করা বা সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত করাটা ঠিক হবেনা, কারণ জামাত গতানুগতিক রাজনীতিক প্রক্রিয়ার অংশীদার এবং জামাত যে সন্ত্রাস করছে এর সুনিদির্স্ট কোন প্রমান নাই। পূর্বাহ্নে জয় কানসারা তার সুপারিশে বেশ স্পস্ট করে বলেছিলেন, দেশে জামাতকে নিষিদ্ধ করা, এদেশে সন্ত্রাসী দল হিসাবে তালিকাভুক্ত করা দরকার। তিনি বলেন, জামাতের নেতৃবৃন্দ যারা সন্ত্রাসের সাথে জড়িত তাদের আমেরিকায় ঢোকা নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। তিনি বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের সরজমিন চিত্র তুলে ধরে যেকোন সাহায্যের সাথে মানবাধিকার ও সংখ্যালঘু নিরাপত্তার শর্ত জুড়ে দেয়ার পক্ষে মত দেন। হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের লিসা কার্টিজ এবারকার হিয়ারিং-এ বাংলাদেশ সরকারের সবচেয়ে কট্টর সমালোচনা করেছেন, তিনি বলেছেন, 'আন্তর্জাতিক মহল শেখ হাসিনার একনায়ক শাসন প্রতিরোধে কিছু না করলে বা করতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সন্ত্রাস আরো বাড়বে এবং জঙ্গিরা এর সুযোগ নেবে। তিনি ভারতকে দিয়ে শেখ হাসিনাকে চাপ দেয়ার পরামর্শও দেন এবং সালাহউদ্দিন আহমদের প্রসঙ্গ টেনে হাজার হাজার বন্দী বিরোধী নেতা-কর্মীকে মুক্তি দিতে যুক্তরাষ্ট্রকে চাপ দিতে বলেন। মিস কার্টিজ আইসিটি নিয়েও বিরূপ মন্তব্য করেন। তিনি একথাও বলেন, দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক সংঘাত ২০০৭-এর মত একটি সামরিক অভ্যুথানকেও ডেকে আনতে পারে, যা আগে চেয়ারম্যানের মুখেও উচ্চারিত হয়েছে।
প্রশ্নোউত্তর পর্যায়ে চেয়ারম্যান বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রশংসা করে বলতে গিয়ে ৬.২% জিডিপি'র কথা উল্লেখ করেন এবং বলেন, যা এখন আমেরিকারও নেই। পরক্ষণে তিনি মি: ফেলিসির কাছে জানতে চান বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা সম্পর্কে। মি: ফেলিসি জানান, ২০০৭-২০১২ অগ্রগতি ছিলো চমত্কার, ২০১৪ থেকে খারাপ, গার্মেন্টস অর্ডার এখন বাংলাদেশ থেকে অন্যত্র যাচ্ছে এবং সিকিউরিটি নিশ্চিত না হলে বা সমস্যা অব্যাহত থাকলে অবস্থার অবনতি হবে। এসময় বাংলাদেশের জিডিপি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওই সংখ্যা তিনি বিশ্বাস করেন না। তিনি আরো বলেন, আমার ভয়, রাজনৈতিক অবস্থার উন্নতি না হলে অর্থনীতির উন্নয়নও হবেনা। এসময় চেয়ারম্যান তাকে আবারো প্রশ্ন করেন, এ
অবস্থায়
বাংলাদেশের উন্নয়নের সম্ভবনা কতটুকু? তিনি উত্তর দেন ৫০:৫০। জয় কানসারা তখন পুনরায় ফ্লোর নিয়ে বাংলাদেশে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যর্থতার কথা তুলে ধরেন এবং বলেন, আওয়ামী লীগের উচিত হবেনা হিন্দুদের শুধু ভোটব্যাংক হিসাবে ব্যবহার করা।
আওয়ামী লীগ নেতারা হিয়ারিং-এ যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু তাদের করার কিছুই ছিলোনা। আমাদের দুতাবাসের কর্মীরা সাধারনত: উপস্তিত থাকেন, এবারও ছিলেন। তাদেরও করার কিছু
ছিলোনা।
তবে আমাদের রাষ্ট্রদূত চেয়ারম্যানের কানে কানে বলার প্রয়াস পেয়েছেন যে, এবার সুন্দর নির্বাচন হয়েছে। এসব হিয়ারিং কেন হয়, কিভাবে বক্তা সিলেক্ট হন বা কারা এতে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ নেন, তা আমাদের দুতাবাস বা সরকার কখনো মাথা ঘামান না, বা ঘামাতে চাননা। এবারকার হিয়ারিং-এ একসময় চেয়ারম্যান বলেছেন, আমাদের ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূত আমাদের মতের প্রতিফলন ঘটিয়ে ২৮শে এপ্রিলের নির্বাচন সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন। আমরা জানি মার্কিন রাষ্ট্রদূত নির্বাচনের প্রশংসা করেননি।
প্রশ্ন হলো,
মাতব্বরের সাথে ফাইট করে কি লাভ!
ইদি আমিন, নরিয়েগা ফাইট করে মরেছেন। ঘনঘন হিয়ারিং কিসের সংকেত কে জানে।
এই হিয়ারিংএ খালেদা জিয়া কতটা লাভবান হবেন তা জানিনা, কিন্তু দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ক'দিন আগে ঢাকার একটি পত্রিকা নগর নির্বাচন সম্পর্কে হেডিং করেছিলো, 'আওয়ামী লীগ জিতেছে, গণতন্ত্র হেরেছে'। হিয়ারিং-এর পর অনুরূপ হেডিং 'বিএনপি-জামাত জিতেছে, বাংলাদেশ হেরেছে' করলে কেমন হয়?
শিতাংশু গুহ, কলাম লেখক।
নিউইয়র্ক, ১লা মে ২০১৫।