সালিসের সিদ্ধান্তের পর থেকে রবীন্দ্রর পরিবারে বিরাজ করছে আতঙ্ক
সালিসের সিদ্ধান্তের পর থেকে রবীন্দ্রর পরিবারে বিরাজ করছে আতঙ্ক। ছবি : কালের কণ্ঠ
KalerKantho, ঢাকা, বুুধবার ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪: ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার পাশে নান্দাইল। এই নান্দাইল উপজেলার কচুরি গ্রামের একপাশে সিংপাড়া। পাড়াজুড়ে ১০-১২টি হিন্দু পরিবারের বাস। তারা বাপ-দাদার আমল থেকে বংশ পরম্পরায় সেখানে বাস করে আসছে। সম্প্রতি সালিসে একটি সিং পরিবারকে ভিটাবাড়ি বিক্রি করে গ্রাম ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হিন্দু তরুণের সঙ্গে মুসলমান কিশোরীর সম্পর্কের জের ধরে গ্রাম্য সালিসে এমন রায় দেওয়া হয়েছে। এ জন্য দুই মাস সময় বেঁধে দিয়েছেন মাতব্বররা।
নান্দাইল উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে কচুরি গ্রাম। মঙ্গলবার সকালে ওই গ্রামে গেলে মোটরসাইকেলের শব্দ শুনে সিং সম্প্রদায়ের ছেলে-বুড়োসহ আশপাশের লোকজন ছুটে আসে। তারা সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়ে। কেউ কেউ হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। ক্ষুব্ধ তরুণদের থামানোর চেষ্টা চালান বয়স্করা। এ থেকে বোঝা যায়, তাদের মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে। গ্রামবাসী জানায়, ভিটেমাটি বেচতে বলা হয়েছে রবীন্দ্র চন্দ্র সিংকে (৬৫)। তিনি পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। এদিক-সেদিক লক্ষ্য করে চোখেমুখে আতঙ্ক নিয়ে তিনি বলেন, 'আমারার কী দোষ? আমি তো এই ভিটা নিয়া বাপ-দাদার সময় থাইক্যা এখানে আছি। অহন এই ভিটা বেছলে যাইয়াম কই? ছ্যাড়ায় যদি দোষ করে, তা অইলে তার বিচার অউক।'
রবীন্দ্র সিং জানান, তাঁর দুই ছেলে এক মেয়ে। ছোট ছেলে চঞ্চল সিং (২২) কিশোরগঞ্জের একটি কলেজে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে পড়েন। দরিদ্র পরিবার হওয়ায় পড়াশোনার খরচ জোগানোর জন্য ছুটির সময় বাড়িতে এসে টিউশনি করেন। এ অবস্থায় প্রতিবেশী মুসলমান পরিবারের সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রীর (১৪) সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। একপর্যায়ে দুজন বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। তখন মেয়ের পরিবারের পক্ষ থেকে অপহরণের অভিযোগ তোলা হয়।
গ্রামের লোকজন জানায়, অপহরণের অভিযোগ থানায় জমা দেওয়ার পর উভয় পক্ষ নান্দাইল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মালেক চৌধুরীর দ্বারস্থ হয়। চেয়ারম্যান চঞ্চলের পরিবারকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ছাত্রীকে ফেরত দেওয়ার শর্তে অভিযোগটি তখনকার মতো নথিভুক্ত না করতে পুলিশকে বলেন। রবীন্দ্র সিং জানান, এরপর মাতব্বররা সিদ্ধান্ত দেন, ছেলের অপকর্মের জন্য বাবাকে আশপাশের চারটি গ্রামে গিয়ে ছোট-বড় প্রত্যেকের সামনে কান ধরে ও হাতজোড় করে ক্ষমা চাইতে হবে। এ ছাড়া সালিস বসিয়ে ছেলেকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আবেদন করতে হবে। এই সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে তিনি তাই করেন। এর পর থেকে তিনি মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে যান।
গ্রামের লোকজন জানায়, মেয়েটি উদ্ধারের পর তার পরিবারের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ ছেলেটির বাড়িতে যায়। তখন পুলিশের সামনে মেয়ে পক্ষের লোকজন রবীন্দ্রর বাড়িসহ পাশের বাড়িতে হামলা চালায়। তারা সাতটি গরু, একটি টেলিভিশন ও একটি ছাগল লুট করে নিয়ে যায়। পরে গরুগুলো ফেরত দেওয়া হলেও অন্য জিনিস পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় গত ২২ ডিসেম্বর দিলালপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক মো. রইছ উদ্দিনের বাড়িতে সালিস বসে। ওই সালিসে উপস্থিত একাধিক ব্যক্তি জানায়, মাতব্বররা চঞ্চলকে দুই ঘণ্টার মধ্যে গ্রাম ছাড়ার নির্দেশ দেন। নির্দেশ পেয়ে চঞ্চল গ্রাম ছাড়েন। পরে আরেক নির্দেশে চঞ্চলের বাবাকে দুই মাসের মধ্যে বাড়িঘর বিক্রি করে গ্রাম ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। বৃদ্ধ রবীন্দ্রকে সহযোগিতা করার অপরাধে সালিসে সিংপাড়ার নির্মল সিং, সুশীল সিং, মন্টু সিং, সুজিত সিং ও লক্ষ্মণ সিংকে ১০ হাজার টাকা করে মোট ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
সালিসের আয়োজক মো. রইস উদ্দিন বলেন, 'গ্রামের লোকজনের সর্বসম্মতিক্রমে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সালিসের আয়োজন করা হয়। উপজেলা চেয়ারম্যানও সালিসে উপস্থিত ছিলেন।' অপহরণের ঘটনায় আইনের সহায়তা না নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'উপজেলা চেয়ারম্যান দায়িত্ব নেওয়ায় মামলা করা হয়নি।' চঞ্চল সিং অভিযুক্ত হলে তাঁর বৃদ্ধ মা-বাবা ও পরিবারকে কী অপরাধে বাস্তুচ্যুত করা হবে-জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'মা-বাবা থাকলে কুপুত্র এখানে আসবেই। এ অবস্থায় বড় ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। তাই ভিটেমাটি বিক্রির কথা বলা হয়েছে। জমির ভালো দাম নির্ধারণ করেই তাঁকে দেওয়া হবে। কেউ না নিলে আমি এই জমি ক্রয় করব।'
মেয়ের চাচাতো ভাই মো. আহাদ বলেন, 'পুরো পরিবার ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যাওয়াই উপযুক্ত শাস্তি।' সিংরুইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, 'আমাকে না জানিয়ে সালিস বসানো হয়েছে। একটা বেআইনি সিদ্ধান্ত চাপানো হয়েছে রবীন্দ্র সিংয়ের ওপর। এটা অমানবিক ও অত্যন্ত দুঃখজনক।'
নান্দাইল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল মালেক চৌধুরী স্বপন বলেন, 'তাৎক্ষণিক উত্তেজনা প্রশমিত করতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি একটু শান্ত হলে নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।' এ বিষয়ে নান্দাইল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. হারুন-আর-রশিদ বলেন, 'আমি ছুটিতে আছি। থানায় এসে খোঁজ নেব কোন দারোগা সেখানে গিয়েছিলেন।' ময়মনসিংহ জেলা জজ আদালতের আইনজীবী এমদাদুল হক মিল্লাত বলেন, 'সালিসকারী ফয়সালা দিতে পারে; কিন্তু শাস্তি দিতে পারে না। এটা বেআইনি। সংশ্লিষ্ট পরিবার আদালতের শরণাপন্ন হতে পারে।'
SitangshuGuha 646-696-5569
__._,_.___