সব দোষ বাঙালি মুসলমানের? অজয় দাশগুপ্ত কথা
সব দোষ বাঙালি মুসলমানের?
আমাদের অর্থনীতি :
অজয় দাশগুপ্ত
কথায় কথায় বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের সাম্প্রদায়িক বলাটা এখন রোগের মতো হয়ে গিয়েছে। মানে দেশে অনেক কিছু আগের মতো নেই। পচন ঢুকেছে মগজে। পচন মেধায়। পচন রাজনীতিতে, সংস্কৃতিতে। তার মানে কি এই যে, সব মানুষ সারাদিন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানদের বিরুদ্বে লড়াই করছে? রাজনীতি ও দেশ যারা চালায় তারা আজ দেশ ও সমাজকে এমন একটা জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে যেখানে বিশ্বাস ব্যাপারটাই নড়বড়ে। অথচ আপনি যদি ভালো করে চোখ মেলে দেখেন, রাজনীতি ও ধর্মান্ধতা সমার্থক না হলে মানুষের মন ও মননে এসবের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।
একটা সময় হিন্দুরা উচ্চপদে আসীন হতে পারত না। বিএনপি বা জামায়াতের শাসনামলে সুনীল গুপ্ত বা নিতাই বাবু কিংবা গয়েশ্বরের মতো দু-চারজন খয়ের খাঁ পোষার বাইরে তারা সংখ্যালঘুদের দূরে রাখত। এখন তো তা নয়। এদেশের প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। যার হাতে দেশের সর্বোচ্চ আদালত ও আইন বিচারের ভার তিনি নিজেই অমুসলিম। যখন তিনি সিডনি এসেছিলেন তার সঙ্গে সৌজন্যমূলক দেখা ও একসঙ্গে খাবার সুযোগ হয়েছিল। তার কথা ও আচরণে যে দৃঢ়তা তা কিন্তু একবারও প্রমাণ করে না তিনি সংখ্যালঘু হিসেবে ভীত বা শঙ্কিত। এখন পুলিশের বড় কর্তা সচিব বা দেশের প্রশাসনেও অমুসলিমদের সংখ্যা কম না। সামাজিকভাবে তাদের যে ভয় সেটা রাষ্ট্র দূর করতে পারেনি বা চায়নি। চাইলে অবশ্যই পারত। কারণ আমাদের দেশের মানুষের বসবাস বা জীবনযাপন এমন একে অন্যের উপর নির্ভরশীল। তাছাড়া বাড়ি-ঘর, জায়গা-জমি এমনকি জীবনও পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে। আমি কোনোভাবে বিশ্বাস করতে পারি না যারা আমাদের ছেলেবেলা থেকে বিয়ের সময় পর্যন্ত গায়ে খেটে টাকাপয়সা ধার দিয়ে বন্ধুর দায়িত্ব পালন করেছে, যারা আমাদের মা-বাবাকে নিজের মা-বাবার মতো সম্মান করেছে তারা আজ হিন্দু দেখলেই মারতে আসে। এখনো নব্বই শতাংশ মুসলিম বাঙালির দেশে অন্যরা ঘটা করে ধর্মীয় উৎসব করে, বিয়ে করে, সামাজিক অনুষ্ঠান করে। চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্রে দিনরাত মাইক আর ঢাক-ঢোলের শব্দে মুখরিত জায়গাটিতে যেসব সংখ্যাগুরু মানুষের থাকেন তাদের ধৈর্য ও সহনশীলতার জন্য জাতীয় পুরস্কার দেওয়া উচিত। কিন্তু তারপরও কোনোদিন সেখানে অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটেনি।
এ কথা বলছি না যে সমস্যা নেই। না থাকলে রামুর বুদ্ধমূর্তি টুকরো টুকরো হতো না। প্রায়শ দেবদেবীর ভাঙা মূর্তি দেখে মন খারাপ হতো না মানুষের। পূজা বা উৎসবের আগে আতঙ্ক থাকত না। শ্যামল কান্তিকে কান ধরাতে পারত না কেউ। সঙ্গে এটাও ভাবতে হবে মুসলমানদেরও কি একই সমস্যা পোহাতে হচ্ছে না? যতজন মুক্তচিন্তার মানুষ বলী হয়েছেন চাপাতির কোপে জান দিয়েছেন তাদের পরিচয় দেখুন। বেশির ভাগ সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের। বিষয়গুলো একতরফা না। এর পেছনে আছে সংখ্যালঘু ও প্রগতিশীল মুসলমান নিধনের গভীর ষড়যন্ত্র। কোনো রাজনীতি তার দায় নেয় না। তারা আমাদের নিয়ে খেলে, খেলায়। আর সে সুযোগে ভারতবিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতার ছদ্মবেশে হিন্দুদের বা সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর, সম্পদ লুট হয়। চাকরি দেওয়া হয় না। একসময় নিরাপত্তার অভাবে তারা দেশ ছেড়ে চলে যায়। এই কাজে আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা জামায়াত কারও উৎসাহ কিংবা আক্রোশের কমতি নেই। অথচ দায়টা গিয়ে পড়ে সাধারণ মুসলমানের উপর।
আমরা ভুলে যাই এদেশে এখনো নির্মলেন্দু গুণ আর মহাদের সাহাই বড় কবি। ভুলে যাই গয়েশ্বর বাবু যেভাবে শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে বলেন সেভাবে মওদুদ আহমেদরাও বলেন না। ভুলে যাই দাপট না থাকলেও প্রভাব প্রতিপত্তি অন্যদেরও কম না। আমরা যারা লিখি তাদের লেখা যারা ছাপেন তারাও মুসলমান। যেভাবে আমরা গড়পড়তা মুসলমানদের গালমন্দ করি, আক্রোশের শিকার করি, রাগে অভিমানে গায়ের ঝাল মেটাই তারা কি তা ধারণ করেন না? ফলে এ কথা বলার সুযোগ নেই সবাই সাম্প্রদায়িক বা একপেশে।
এই জাতির সংখ্যাগুরু মানুষরাই বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন। ওপার বাংলায় বাংলা ভাষার উপর বলৎকার হিন্দির নির্যাতনের পরও তারা টুঁ শব্দটি করে না। এদেশের সংখ্যাগুরুরাই আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি বলে কেঁদে বুক ভাসায়। আবার যদি পতাকা ও সঙ্গীতের উপর আক্রমণ আসে তারাই সামাল দেবে। দু-চারজন সংখ্যালঘু বাদে বাকিরা বলবেন দূর এদেশে আর হবে না এবং দেশ ছেড়ে চলে যাবেন। যাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই তারাই আঁকড়ে রাখবেন এই মাটিকে। আমার ব্যক্তিগত অভিমতে বাঙালি মুসলমানের বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা অকৃত্রিম। তারা মাইক্রো লেভেলে অসাধারণ। তবে সামাজিকভাবে মেক্রো লেভেলে তারা সমাজ ও রাজনীতি বা ধর্মের চাপে অসহায়। একশ্রেণির মানুষের সঙ্গে আছে জমি ও নারীর লোভ। তাই আসল জায়গায় হাত দিতে হবে। ঢালাও অভিযোগ বা তাদের পিঠ দেয়ালে না ঠেকিয়ে তাদের সঙ্গে থেকে লড়াই ও শুদ্ধতার কাজ করতে হবে। সংস্কৃতি এককালে তা করলেও এখন করছে না সেটাই ভয়ের। বাঙালি মুসলমানের যেন দোষের অন্ত নাই। আর বাকিরা সব ধোয়া তুলসী পাতা বা সাধুর দল। এ ভাবনা বন্ধ করতে হবে।
লেখক: সিডনি প্রবাসী, কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষক
__._,_.___