দীর্ঘ দিনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি ভুলে কলঙ্কমোচনের যে ইতিহাস রচিত করেছে বাঙালি জাতি, ২০১৬ সালের ১০ মে রাতে সেই পথে আরেক অধ্যায় রচিত হল। বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার মাস্টারমাইনড খ্যাত তত্কালীন
ছাত্রসংঘের শীর্ষ নেতা, জামায়াতে ইসলামীর আমীর, একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদারদের অন্যতম প্রধান সহযোগী কুখ্যাত আলবদর বাহিনীর প্রধান ঘৃণিত অপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকর করা হল।সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী গতকাল রাত ১২টা ১০ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ফাঁসিমঞ্চে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় এই যুদ্ধাপরাধীর। রায় কার্যকরের পর রাত দেড়টার দিকে কঠোর র্যাব ও পুলিশ পাহারায় নিজামীর মরদেহ তার গ্রামের বাড়ি পাবনার সাঁথিয়ায় পাঠানো হয়।
এদিকে নিজামীর ফাঁসি কার্যকরের খবর ছড়িয়ে পড়লে কারাগারের বাইরে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানরা আনন্দে মেতে ওঠেন। রাজাকারদের বিরুদ্ধে ও জয় বাংলা স্লোগানে তারা মুখরিত করে তোলেন গোটা এলাকা। ফাঁসি কার্যকরের খবরে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা উল্লাসে ফেটে পড়েন। মিষ্টি বিতরণ করা হয় দেশের বহু স্থানে। রাত সাড়ে ১২টায় সিনিয়র জেল সুপার মো. জাহাঙ্গীর কবির কারা ফটকে গণমাধ্যম কর্মীদের জানান মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড রাত ১২টা ১০ মিনিটে কার্যকর করা হয়েছে।
কারা সূত্র জানায়, ফাঁসি কার্যকরের সময় অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল মো. ইকবাল হাসান. ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি গোলাম হায়দার, ঢাকা জেলা প্রশাসক মো. সালাহ উদ্দিন, সিভিল সার্জন এম এ মালেক, ডিবি ডিসি শেখ নাজমুল আলম, কারা চিকিত্সক বিপ্লব কান্তি রায় ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তানভীর হোসেন আজীম উপস্থিত ছিলেন।
নিজামীর স্বজনদের শেষ সাক্ষাত: এর আগে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে নিজামীর পরিবারের সদস্যদের দেখা করার জন্য খবর দেয় কারা কর্তৃপক্ষ। রাত ৭টা ৫৫ মিনিটে তার স্বজনরা কারা ফটকে যান। তিনটি গাড়িতে আসা ২৬ জন স্বজন কারাগারের ভেতরে প্রবেশ করেন। এদের মধ্যে তার স্ত্রী, তিন ছেলে, ছেলের বউরা, এক মেয়ে, মেয়ে জামাই, নাতিসহ স্বজনরা ছিলেন। টানা ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট পর রাত ৯টা ৪০ মিনিটে বেরিয়ে যান তারা। কারাগারের ভেতরে দীর্ঘ সময় নিজামীর সঙ্গে কথা বলেন তারা। চলে যাওয়ার সময় গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি স্বজনরা।
কারা ও গোয়েন্দা সূত্র জানায়, স্বজনদের সাক্ষাত্ শেষে রাত ১০টার দিকে নিজামীকে গোসল করানো হয়। এরপর নামাজ আদায় করেন তিনি। কেন্দ্রীয় কারা মসজিদের পেশ ইমাম মনির হোসেন তাকে তওবা পড়ান। এর আগে একাধিক দফায় কারা চিকিত্সক তার শারীরিক পরীক্ষা করেন। রাত পৌণে ১২টার দিকে কনডেমড সেলে নিজামীকে আনতে জান পাঁচ জল্লাদ। পিছমোড়া করে তার হাত বেঁধে ফেলা হয়। এরপর রাত ১১ টা ৫৫ মিনিটের দিকে কুখ্যাত রাজাকার নিজামীকে ফাঁসির মঞ্চে নেয়া হয়। মঞ্চে এনে মুখমণ্ডলে জম টুপি পরিয়ে দেন দুই জল্লাদ। বেঁধে ফেলা হয় তার দু'পা।
কারাবিধি অনুযায়ী, ঠিক রাত ১২টা ১০ মিনিটে কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. জাহাঙ্গীর কবীর তার হাতে থাকা লাল রুমাল মাটিতে ফেললে জল্লাদ রাজু ফাঁসি মঞ্চের লিভার (লোহার তৈরি বিশেষ হাতল) টান দেন। এতে নিজামীর পায়ের নিচ থেকে কাঠের পাটাতন সরে যায়। কার্যকর হয় ফাঁসি। নিয়মানুসারে প্রায় ২০ মিনিট ঝুলিয়ে রাখার পর ফাঁসির মঞ্চ থেকে নামানো হয় নিজামীর মরদেহ। এরপর সিভিল সার্জনের উপস্থিতিতে তার স্পাইনাল কড ও হাত-পায়ের রগ কেটে দেন কারা চিকিত্সক। পরে লাশের ময়নাতদন্ত করেন ঢাকা জেলা সিভিল সার্জন।
মাহেন্দ্রক্ষণের অপক্ষোয় ছিল জাতি: নরঘাতক নিজামীর ফাঁসির রায় কার্যকর করার ঐতিহাসিক মুহূর্তের খবর জানতে দেশ-বিদেশের কোটি কোটি মানুষ সরাসরি টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখেন। কখন একাত্তরের গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যার মাস্টারমাইন্ড (পরিকল্পনাকারী) জামায়াতের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামীকে ফাঁসির রশিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে। রাত সোয়া ১২টায় একযোগে সবগুলো টিভি চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজে ভেসে ওঠে বহুল প্রত্যাশিত সেই সংবাদ: নিজামীকে ফাঁসির রশিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। এই সংবাদে উল্লাসে ফেটে পড়ে রাজধানীসহ সারাদেশের মানুষ। শাহবাগে 'গণজাগরণ মঞ্চে'র কর্মীরা স্লোগানে স্লোগানে মেতে ওঠে। এর আগে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামতেই রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়ক ও অলিগলিতে যান চলাচল কমে যায়।
রাজুর নেতৃত্বে ছিল পাঁচ জল্লাদ: মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকর করতে নেতৃত্ব দেন অভিজ্ঞ জল্লাদ রাজু। তাকে সহযোগিতা করেন জল্লাদ আবুল, মাছুম, মুক্তার ও জনি। গতকাল সন্ধ্যার পর ফাঁসির সর্বশেষ মহড়া সম্পন্ন করেন তারা। ফাঁসির রশির হাতল টানার দায়িত্ব পান অন্যদের চেয়ে অভিজ্ঞ জল্লাদ রাজু। যাকে গতকাল বিকেল তিনটায় কাশিমপুর কারগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়। জানা গেছে, একই মঞ্চে চলতি বছরের ২১ এপ্রিল রাতে দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরী ও আলী আহসান মুজাহিদের ফাঁসিও কার্যকর করেছিলেন জল্লাদ রাজু। এর আগে ১১ এপ্রিল রাতে আরেক জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরের দায়িত্ব পালন করেন জল্লাদ রাজু। রাজুও বিভিন্ন মামলায় যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া আসামি। তিনি ১৬ বছর ধরে কারাগারে আছেন। অন্য জল্লাদরাও বিভিন্ন মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে সাজা খাটছেন।
কারাগার ঘিরে কড়া নিরাপত্তা: গত দুই দিন ধরে পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন সড়কের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গেট ও আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা থাকলেও গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে তা আরো জোরদার করা হয়। কারারক্ষী, র্যাব ও পুলিশের সমন্বয়ে ওই এলাকায় তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়। এর সঙ্গে কারাগার এলাকায় সক্রিয় ছিলেন বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও। সন্ধ্যা সাতটার পর আশপাশের সড়কগুলোতে যান চলাচল সীমিত করে দেয়া হয়। গণমাধ্যমকর্মী ও স্থানীয় বাসিন্দা ছাড়া ওই সড়কে কাউকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। কারাগারমুখী সড়কগুলোতে বসানো হয় অতিরিক্ত তল্লাশি চৌকি। এছাড়া গভীর রাতে নিজামীর মরদেহ কারাগার থেকে বের করার আগ পর্যন্ত কারা ফটক থেকে শুরু করে চকবাজার, বংশাল, বেগম বাজার, বকশীবাজার ও চানখাঁরপুল এলাকার সড়কগুলোতে যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের লালবাগ জোনের উপকমিশনার মফিজ উদ্দিন আহমেদ জানান, কারাগার ও আশপাশের এলাকায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়। বিভিন্ন সড়কে তল্লাশি চৌকি বসিয়ে সন্দেহজনক গাড়িতে তল্লাশি করা হয়। কারাগারের আশপাশের ভবনগুলোর ছাদেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন ছিল। অন্যদিকে র্যাব-১০-এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইডিজ জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর জানান, রায় কার্যকরের আগে ও পরে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। যেকোনো ধরনের নাশকতা দমনে র্যাব প্রস্তুত রয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধা জনতার স্লোগানে মুখর কারাফটক: যুদ্ধাপরাধী নিজামীর ফাঁসির রায় কার্যকরের খবরে কারাফটকে বিজয় উত্সব করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানরা। 'মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড' নামের একটি সংগঠন কারাফটকের কাছাকাছি অবস্থান নেয়। তাদের হাতে ধরা ব্যানারে লেখা ছিল 'মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি, সারা বাংলার হাঁসি।' তারা স্লোগান দিতে থাকেন 'ফাঁসি হলো/ ফাঁসি হলো নিজামীর ফাঁসি হলো। জয় বাংলা।' জয়সূচক ভি-চিহ্ন দেখিয়ে তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরেন। আনন্দে অনেকে চিত্কার করেন। গভীর রাতে কারাফটক দিয়ে নিজামীর মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্স বের করার সময় জুতা নিক্ষেপ করে ও থুতু ছিটিয়ে ঘৃণা প্রকাশ করেন তারা। এ সময় বিক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষও তাদের সঙ্গে অংশ নেন।
দেশজুড়ে বিশেষ সতর্কতা: পুলিশ সদর দপ্তরের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, সাম্প্রতিক নানা পরিস্থিতিতে এমনিতেই সারাদেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক রয়েছেন। নিজামীর ফাঁসি কার্যকরকে কেন্দ্র করে তা আরও জোরালো করা হয়েছে। দেশের সব থানা পুলিশকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থেকে যে কোনো ধরনের নাশকতা দমনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গতকাল দুপুরেই ডিএমপির সকল থানার ওসি ও সব বিভাগের ডিসিদের সতর্ক অবস্থানে থাকতে নির্দেশ দেয় ডিএমপি সদর দফতর। অন্যদিকে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, ঢাকায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া কয়েকটি জেলায় বিজিবি সদস্যরা পুলিশ-র্যাবকে সহায়তা দিচ্ছে।
নিজামীর বিচার পরিক্রমা: ২০১০ সালের ২৯ জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের একটি মামলায় মতিউর রহমান নিজামীকে গ্রেফতার করার পর একই বছরের ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করে ট্রাইব্যুনাল। ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ২৩ নভেম্বর সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করেন নিজামী। ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে গত ৬ জানুয়ারি সংক্ষিপ্ত আকারে চূড়ান্ত রায় দেন আপিল বিভাগ। গত ১৫ মার্চ আপিল মামলাটির পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর ২৯ মার্চ রিভিউ আবেদন করেন নিজামী। ৫ মে এই রিভিউ খারিজ করে দিয়ে রায় ঘোষণা করেন আপিল বিভাগ।
গত বছর ২১ নভেম্বর রাতে একই অভিযোগে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এর আগে ২০১৪ সালের ১১ এপ্রিল জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। যুদ্ধাপরাধের মামলায় ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রথম কার্যকর হয় আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি।
মানবকণ্ঠ/এফএইচ