শাহবাগকে জেগে থাকতে হবে। দৃশ্যত শাহবাগ ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলের একটি স্থানের নাম, কিন্তু তার ডালপালা সারা দেশে। তারুণ্যের অন্তরে। তারুণ্য যেখানে, সেখানেই শাহবাগ। ট্রাইব্যুনাল শুরুর সময়ই আমি একটি নাটক লিখেছিলাম। নাটকের নাম আগুনের ডালপালা। নাটকটি একটি কাল্পনিক ট্রাইব্যুনাল নিয়ে। ট্রাইব্যুনালের বিচারের শেষ প্রান্তে বিচারক রায় দেওয়ার আগেই প্রসিকিউশন দর্শকদের প্রশ্ন করেন, 'বিচারক এখনো রায় দেননি কিন্তু দর্শক, আপনাদের রায় কী?' দর্শক একযোগে সবাই বলে উঠত, 'ফাঁসি', 'ফাঁসি চাই'। আমাদের তাই সব সময়ই মনে হতো, যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
শাহবাগ চত্বরে যে তারুণ্যের জাগরণ ঘটেছে, সেখানেও একই কথা, মৃত্যুদণ্ড। কাদের মোল্লার রায়ের পর আমরা সবাই কেমন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম। অগ্র-পশ্চাৎ ভাবনা চলছিল আমাদের মধ্যে। কিন্তু তারুণ্য তাদের স্বতঃস্ফূর্ততা দিয়ে আমাদের ভাবনাকে ছিন্নভিন্ন করে জাগিয়ে দিল জাতিকে। রাতদিন পাহারা দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে। গত ৪২ বছরে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে যেভাবে ষড়যন্ত্র হয়েছে এবং সেসব ষড়যন্ত্র কখনো সাফল্যও পেয়েছে। আজ যাঁরা কারাগারে বসে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচারের অপেক্ষা করছেন, তাঁরা একসময় রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন। ইতিহাস প্রবলভাবে পরিবর্তিত হয়েছিল।
পঁচাত্তর-পরবর্তীকালে এ দেশটাকে পাকিস্তান বানানোর প্রক্রিয়া ১৫ বছর ধরে চলছিল। এ সময় সংস্কৃতিকর্মী, ছাত্র, জনতা, পেশাজীবীদের প্রবল বিরোধিতা ও আন্দোলন চলেছে। এই আন্দোলনের পেছনের দিক থেকে যুদ্ধাপরাধীরাও যুক্ত হয়েছে। এবং একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে চিরতরে ক্ষমতার অংশ হয়েছে। আবার বাদ সেধেছে জনগণ। বিচারের দাবি এসেছে। বিচার হচ্ছে, সে দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে। দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্রপক্ষের তদন্তের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত রায় শুরু হয়েছে।
সমাজ কখনো জড়তন্ত্রে আক্রান্ত হয়। কোনো ঢেউ ওঠে না, তরুণেরাও যেন বৃদ্ধ হয়ে যায়। অচলায়তনে পরিণত হয় দেশ। ষাটের দশকেও সে রকম হয়েছে মাঝেমধ্যে। আবার উনসত্তরে এসে উত্তাল হয়ে পড়েছে। সেই থেকে একাত্তর। এটা বোধ হয় সব দেশেই, সর্বকালেই হয়েছে।
শাহবাগ বিষয়টি তেমনি একটি বিস্ফোরণ, তারুণ্যের যৌক্তিক দাবির বিস্ফোরণ। এই তরুণদের অধিকাংশ মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, রাজাকার, আলবদরদের কর্মকাণ্ড চাক্ষুষ করার সুযোগ পায়নি। নানা বিভ্রান্তির মধ্য দিয়ে তারা ইতিহাস পড়েছে ও শুনেছে। আমরাও নাটকে, কাব্যে, সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে এসব সত্য কাহিনি বলতে চেয়েছি। একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ, ষোলোই ডিসেম্বর পালন করেছি। সে-ও যেন এক নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। কিন্তু এর মধ্যে তারুণ্যের যে প্রতিনিয়ত ঝলক, তা দেখতে পাইনি। অনেক রাজনৈতিক বিভ্রান্তির মধ্যে জনগণও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। যেসব মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করতে করতে বা যুদ্ধাহত অবস্থায় নির্মম-নিপীড়নে নিহত হয়েছিলেন, তাঁদের কথাও বিভ্রান্তির দৃষ্টিতে দেখা হতো। এ কি সত্য? শহীদ পরিবারের সদস্যরা একসময় ভীত হয়ে উঠেছিলেন। তাঁদের বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ একটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কিছু পত্রপত্রিকার জন্ম হলো। উদ্দেশ্য, ভুলিয়ে দাও সেসব দিনের কথা। শহীদজননী জাহানারা ইমামকে নিয়েও নানা কটূক্তি করত এরা। সাঈদী তো তাঁকে 'জাহান্নামের ইমাম' বলত। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনকে তীব্র ভাষায় এরা ব্যঙ্গ করত। তখনকার ক্ষমতাসীন দলও প্রবলভাবে প্রশ্রয় দিত। এভাবেই আঁধার নেমে এসেছিল আমাদের জীবনে। সেসব অন্ধকারের দিনগুলোতেই এই তরুণদের জন্ম, তারা যে এই আঁধারকে মেনে নেয়নি, তার স্বাক্ষরই ঘোষিত হয়েছে শাহবাগে। শাহবাগের আন্দোলনের সূচনালগ্নে চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম। সেখানেও দেখেছি একই চিত্র, একই ক্ষোভ। প্রতিশোধস্পৃহায় ফেটে পড়েছে তারুণ্য।
এ এক অন্য রকম তারুণ্য, ২২ দিন অবস্থানের এমন শান্তিপূর্ণ উদাহরণ আর কোথাও আছে কি না, আমার জানা নেই। জামায়াতের প্রত্যাখ্যাত হরতালের দিনেও যখন অতর্কিত হামলা হলো মসজিদের সামনে, তখন এক ধর্মপ্রাণ মুসল্লি বলছিলেন, 'ছেলেরা ১৮ দিন কাটিয়ে দিল, একটা ঘটনা হলো না, কোনো ভাঙচুর, মারামারি না, আর দেখেন, ধর্মের নাম নিয়ে এরা কী করছে? ভয় দেখিয়েই কি সবকিছু হয়?' এটা প্রমাণিত হলো, মানুষকে চাপের মধ্যে রেখে রাজনীতিকেরা নানা সময় নানা আন্দোলনে নিজেদের ফায়দা লুটতে চান, তাতে দেশ এগোয় না, মনুষ্যত্বের বিকাশ হয় না। গণতন্ত্র কায়েম হয় না। পাকিস্তান আমলে, বাংলাদেশের ইতিহাসের একটা দীর্ঘ সময়ে তা-ই ঘটেছে। তাতে পাকিস্তান আজ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। শাহবাগের তারুণ্য এ-ও বলেছে, এ দেশকে আমরা ব্যর্থ রাষ্ট্র হতে দেব না, জঙ্গিদের আশ্রয়স্থল করতে দেব না। আর সেই ফরাসি বিপ্লবের স্লোগান বারবার ফিরে এসেছে—ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার। এসব জায়গা থেকে পিছু ফেরা যাবে না। শাহবাগে যে তারুণ্যের নতুন মুখগুলো দেখেছি, সেই নতুন মুখ দেখেছিলাম একাত্তরের রণাঙ্গনে, প্রতিরোধে। তাঁদের মধ্যে অনেকেই বেঁচে নেই। আমরা যখন ষাটের দশকের আন্দোলন করেছি, অনেকেই বলেছে, এসব হঠকারী, বেয়াদব, উদ্ধত, অদূরদর্শী এবং শেষ কথাটি, বোকা। এসব গুণের অধিকারীই হয় তরুণেরা। বেশি চালাক, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন অন্ধ চতুরেরা কিন্তু কখনোই জননায়ক তো দূরের কথা, সমাজকে পাল্টায় না। তাই তারুণ্য যখন একবার জেগে উঠেছে, তাদের জাগরণকে অনুপ্রাণিত করে, আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে এগিয়ে যেতে দিতে হবে। গত ৪২ বছরে সমাজে আরও একটি বড় সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তা হলো নেতৃত্ব। একটি সৎ নেতৃত্বের পথও খুলে দিতে হবে।
তরুণ প্রজন্ম সুযোগ পেলে অনেক নতুন ভাবনার জন্ম দিতে পারে। যেমন আকাশের ঠিকানায় তারা চিঠি লিখেছে, আলো জ্বালিয়েছে পর্ণ কুটির থেকে অট্টালিকায়, রাজপথ থেকে গলিতে—সারা দেশ থমকে দাঁড়িয়েছে কয়েক মিনিটের জন্য। আবার মিছিল করে হরতালের বিরোধিতা করেছে। শান্তিপূর্ণ মিছিলে অন্ধকারের প্রাণীরা পালিয়ে গেছে।
আমাদের স্বীকার করতেই হবে, একাত্তরের বিজয়ী শক্তি নানা রাজনৈতিক পালাবদলে কখনো ভ্রষ্ট হয়েছে, নষ্ট রাজনীতি, নষ্ট মানুষের জন্ম দিয়েছে, আজ সেই জীর্ণ পুরোনো অচলায়তনকে ভেঙে দিতে যে তারুণ্য জেগেছে, তাদের জাগতে দিতে হবে। একবার জেগে আবার ঘুমিয়ে গেলে লাভ নেই।
যে আশায় মানুষ বুক বেঁধেছে, তাকে অনেক দূর যেতে দিতে হবে। তাই ঘুমিয়ো না বন্ধু, জেগে থাকো শাহবাগ, জেগে থাকো সারা দেশের তারুণ্যের দীপশিখা। তাহলে জ্ঞান-বিজ্ঞানে, রাজনীতিতে স্বচ্ছতা আসবে। জনগণ বিভ্রান্ত হবে না। আমিও তোমাদের সঙ্গে জেগে থাকব।
মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব।
http://prothom-alo.com/detail/date/2013-03-01/news/332823