http://www.bhorerkagoj.net/pri
"হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না"
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, পার্লামেন্ট (সংসদ) দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধান সংশোধন করতে পারে। পুরো সংসদ মিলে যেকোন আইন করতে পারে, সেই ক্ষমতা তাদের আছে। কিন্তু সুপ্রিমকোর্ট যদি মনে করে এতে সংবিধানের মূল ভিত্তি নষ্ট হয়ে গেছে, আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং জনগণের অধিকারে আঘাত হেনেছে, তাহলে সংসদের ঐ সিদ্ধান্ত বাতিলের ক্ষমতা সুপ্রিমকোর্টের আছে। তিনি আরো যুক্ত করেন, ভবিষ্যতে সংসদ যদি সংবিধানের কোন বিধান বা অন্যকোন আইন প্রণয়ন করে এবং সেটা যদি সংবিধানের পরিপন্থী হয়, তাহলে সুপ্রিমকোর্ট সেটা বাতিল করতে পিছপা হবেনা। কথাগুলো কঠিন কিন্তু নুতন নয়,তবে সচরাচর কেউ বলেন না, প্রধান বিচারপতি সম্ভবত: জাতিকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানের অভিভাবক, এর সেই এখতিয়ার আছে। প্রায় একই সময়ে প্রধান বিচারপতি বলেছেন, "আমি আর পারছিনা"।
হটাৎ তিনি একথা বললেন কেন? ফেইসবুকে এর উত্তর দিয়েছেন একজন সাইফুল ইসলাম। তিনি লিখেছেন: "প্রধান বিচারপতি বিপদ ডেকে আনছেন না, বরং বিপদ দেখেই তিনি কথা বলতে শুরু করেছেন। আমরাও বুঝছি, উনি আর বেশিদিন নাই, 'হিন্দু বিচারপতি অপসাৰণ আন্দোলন ঘনীভূত হচ্ছে"। আওয়ামী লীগের একজন নেতা আমায় বলেছেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে যারা 'কালো বিড়াল' বানিয়েছে তারা এখন প্রধান বিচারপতিকে 'সাদা বিড়াল' বানাতে চাচ্ছেন। বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির পদটি একটি সাংবিধানিক পদ। এর মর্যাদা সমধিক। ওই পদে কে আসীন সেটা বড়কথা নয়, মর্যাদা হচ্ছে আসনটির। ওই আসনে যিনি থাকেন তাকে কটাক্ষ করা মানে পদটিকে খাটো করা। তার অ-মর্যাদা বিচার বিভাগের অসম্মান।সম্প্রতি সুপ্রিমকোর্টের সামনে ভাস্কর্য প্রশ্নে কোন কোন নেতা ও মন্ত্রী এবং এক বা একাধিক ধর্মান্ধ-স্বাধীনতা বিরোধী গোষ্ঠী প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে বিষোদগার করছেন।
হেফাজত-ই-ইসলাম এবং আওয়ামী ওলামা লীগ এবং আরো ক'টি ইসলামপন্থী রাজাকার গোষ্ঠী সরাসরি প্রধান বিচারপতির অপসারণ চাইছেন। কারণ তিনি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, একজন হিন্দু। তারা তাদের এই বিজাতীয় বিতৃষ্ণা গোপন রাখছেন না, প্রকাশ্যেই বলছেন, মিছিল-মিটিং করছেন, দাবি-দাওয়া দিচ্ছেন। আর এদের এই কর্মকান্ডকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন দিচ্ছেন শক্তিশালী একটি মহল এবং ক্ষমতাসীন ক'জন নেতা ও মন্ত্রী। ভাস্কর্য সরানোর আন্দোলনটি করছে স্বাধীনতা বিরোধী চক্র। তাদের আন্দোলনের মূল টার্গেট হিন্দু প্রধান বিচারপতির অপসারণ। এতে ঘি ঢালছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি প্রধান বিচারপতিকে পরামর্শ দিয়েছেন কথা কম বলার জন্যে! তিনি এও পরামর্শ দেন যে প্রধান বিচারপতি যেসব কথা বলেন তা তাদের কাছে বললেও পারেন? এরআগে তিনি ভাস্কর্যের দায় প্রধান বিচারপতির ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন। এরমধ্যে আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক, হাসান মাহমুদ বলেছেন, ঈদগাহের সামনে ভাস্কর্য স্থাপন করা যায়না। সরকারকে অগোচরে রেখে গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য স্থাপন করা ঠিক হয়নি।
পূর্বাহ্নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি থেকে ফেরত এসে বলেছিলেন, গ্রীক ভাস্কর্য্ তার পছন্দ নয়। বিরোধী দল ঐসময় বলাবলি করছিলো যে, তিনি ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করে দিয়ে এসেছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ভাবলেন, বিরোধীদের দৃষ্টি ঘোরাতে তার এ বক্তব্য। এরপর প্রধানমন্ত্রী আবারো বললেন, গ্রীকভাস্কর্য, তায় আবার শাড়ি পরানো? মিডিয়া জানালো প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে প্রধান বিচারপতির সাথে কথা বলবেন। এক অনুষ্ঠানে সেই কথা হলো। জাতি জানলো দু'জনে ঐক্যমত্যে পৌঁছেছেন যে, দুই ঈদের দিনে ওই ভাস্কর্যটি ঢাকা থাকবে। এরপর কি হলো কেউ জানেনা। প্রধানমন্ত্রী আবার বললেন, গ্রীকভাস্কর্য ওখানে থাক তা তিনি চাননা। তিনি ওটাকে সুপ্রিমকোর্টের চত্বরে অন্য কোথাও স্থাপনের পরামর্শ দিলেন। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সেই দায়িত্ব ন্যস্ত হলো প্রধান বিচারপতির ওপর।
আমাদের কানাডার সাংবাদিক সওগত আলি সাগর ফেইসবুকে একটি পোস্টিং দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ষ্টিফেন হারপার তখন কানাডার প্রধানমন্ত্রী। তার কনজারভেটিভ সরকারের আইন ও বিচার বিষয়ক সংসদীয় কমিটির প্রধান এক ভাষণে প্রধান বিচারপতি বেভারলি ম্যাকলাচিন-এর সমালোচনা করে বলেন, প্রধান বিচারপতি ঈশ্বরের মতই ক্ষমতাবান। মিডিয়া হেডিং করে 'কানাডার প্রধান বিচারপতি ঈশ্বরের মত ক্ষমতাবান'। প্রধান বিচারপতি তখন অস্ট্রেলিয়ায়। তাতে কি? তার কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা প্রধানমন্ত্রীর দফতরে চিঠি পাঠিয়ে এ ব্যাপারে সরকারের অবস্থান ও ব্যাখ্যা জানতে চান। ষ্টিফেন হারপার জানান, এটি তার সরকারের বক্তব্য নয়। সংশ্লিষ্ট এমপি ও বিচার বিষয়ক কমিটির প্রধান মিন মিন করে কিছু ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করেন। তাতে শেষ রক্ষা হয়না। প্রধান বিচারপতি দেশে ফিরে আসার আগেই তিনি সংসদীয় কমিটির পদটি হারান।
যুক্তরাষ্ট্রে গতবছর নির্বাচনী প্রচারণাকালে ডোনাল্ড ট্রাম্প দু'একজন বিচারপতি সম্পর্কে উল্টাপাল্টা মন্তব্য করলে প্রবল সমালোচিত হন। কিন্তু প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে এদেশে কাউকে মন্তব্য করতে দেখা যায়না। বরং যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস সদ্য ট্রাম্প প্রশাসনের ছোটখাট মিথ্যা, ভুল বা ভায়োলেশনের জন্যে কারো সিটিজেনশীপ সহজেই বাতিল করা যাবে বলে ধারণায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। রয়টার জানায়, সার্ব ইমিগ্র্যান্ট দিভনা ম্যাসলেনজ্যাক-এর সিটিজেনশীপ ফিরিয়ে দেয়ার মামলার প্রেক্ষিতে তার এ উদ্বেগ। এই ইমিগ্র্যান্ট মহিলা তার সিটিজেনশীপ ফরমে মিথ্যা তথ্য দিয়েছিলেন যে ৯০ দশকে তার স্বামী বসনিয়ান সার্ব আর্মীতে চাকুরী করেননি। ট্রাম্প প্রশাসন এজন্যে তার সিটিজেনশীপ বাতিল করে।
'দি ডেইলী টেলিগ্রাফ পত্রিকা জানাচ্ছে, বৃটেনের সর্বোচ্চ বিচারক লর্ড নিউবের্গের সেদেশের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তেরেসা মে'র কট্টর সমালোচনা করেছেন। ঘটনা ২০১৩ সালের। সুপ্রীমকোর্টের প্রেসিডেন্ট লর্ড নিউবের্গের বলেছেন, বিচারকদের ওপর প্রকাশ্য আক্রমন পার্লামেন্ট ও বিচার বিভাগের মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট করে দেবে। এরআগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তেরেসা মে ইমিগ্রেশন জজদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন যে তাদের কারণে বিদেশী অপরাধীদের ডিপোর্ট করা যাচ্ছেনা। লর্ড নিউবের্গের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যকে 'উদ্বেগজনোক বলে উল্লেখ করে বলেন, একজন বিচারককে আক্রমণ করা মন্ত্রীদের পক্ষে অন্যায়। ভারতে প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে কেউ মন্তব্য করেছেন বলে আমরা শুনিনি। এমনকি উদ্ভট রাষ্ট্র পাকিস্তানের একমাত্র হিন্দু এক্টিং প্রধান বিচারপতি রানা ভগবান দাস-র বিরুদ্ধে তেমন উচ্চবাচ্য শোনা যায়নি।
অথচ বাংলাদেশে মন্ত্রীরা প্রধান বিচারপতিকে অযাচিত পরামর্শ দিচ্ছেন? প্রধান বিচারপতির ওপর ওনাদের এত রাগ কেন? কারণ তিনি হিন্দু? তিনি আপোষ করছেন না? ২০১৬ সালের মার্চে আদালত অবমাননার দায়ে তিনি দুজন মন্ত্রীকে দণ্ডিত করেছেন? তিনি বলছেন, প্রশাসন চায়না বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করুক? ২০১৬-র এপ্রিলে তিনি বলেছেন, প্রচলিত আইনে তনু হত্যার বিচার সম্ভব নয়, যেমন সম্ভব হয়নি সাগর-রুনী খুনের বিচার? ঐ সময়ে তিনি আরো বলেন, আইন প্রণেতারা যথেষ্ট বিচার-বিবেচনা করে আইন প্রণয়ন করছেন না? তিনি পরামর্শ দেন, আইন না বুঝলে পড়াশোনা করে বোঝার চেষ্টা করা প্রয়োজন? পূর্বাহ্নে তিনি বিচারপতিদের রিটায়ারের পরে রায় লেখার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছেন? । তিনি বলেছেন, ক্রসফায়ার আদালতে এলে বিচারকরা এর বিচার করতে প্রস্তুত? যুদ্ধাপরাধী আবুল কাসেম ও মুজাহিদের কেইস ঠিকমত সাজানো হয়নি বলে মন্তব্য করে তিনি সমালোচিত হন? সাদা পোশাকে কাউকে গ্রেফতারের বিপক্ষেও তিনি মত দেন। রিমান্ড প্রশ্নে তার রায় যুগান্তকারী কিন্তু কারো কারো জন্যে বিব্রতকর?
হয়তো এসব কারণে একটি মহল 'ঝোপ বুঝে কোপ মারার চেষ্টায় অছেন। কিন্তু মিলিয়ন ডলার প্রশ্নটি কেউ করহেন না, সুপ্রিমকোর্টের সামনে ভাস্কর্যটি আসলে কে বসিয়েছেন? যেই বসিয়ে থাকুন তিনি কোন অন্যায় করেছেন তা নয়, কিন্তু এর দায় শুধু একা প্রধান বিচারপতিকে নিতে হবে কেন? আর এটা কি এমন কোন সমস্যা যা নিয়ে জল ঘোলা করতে হবে? "ডাল মে কুছ ক্যালা হ্যায়"? মহাজোট সরকারের আমলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সবার প্রশংসা কুড়িয়েছে। এর সবগুলো রায় হয়েছে বা হচ্ছে বর্তমান প্রধান বিচারপতির সময়ে। ভয় হয়, কবে না এই কুটিল গোষ্ঠী এর দায় প্রধান বিচারপতির ওপর দিয়ে নিজেদের হাত মুছে ফেলেন! যারা প্রশাসন ও বিচার বিভাগের মধ্যে সংকট সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন, দয়া করে নিবৃত্ত হউন। নুতন সঙ্কট সৃষ্টি করবেন না। বিচার বিভাগ সর্বশেষ আশ্রয়স্থল। এ জায়গাটা ধ্বংস করবেন না। বৃটিশ আমলে নাকি একটি কথা প্রচলিত ছিলো যে, "হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না"। আমাদের দেশে ওই রকম হাকিম কিন্তু এখনো আছে।
শিতাংশু গুহ, কলাম লেখক।
নিউইয়র্ক। ১লা মে ২০১৭।
__._,_.___