আনিস আলমগীর : দেশের সমৃদ্ধির জন্য যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, তিনি যখন সাধারণ মানুষকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলে দেশের উন্নয়নের জন্য যে কোনও ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত করছেন, তখন মনে হচ্ছে সরকারি দলের এইসব নেতা আত্মকলহের এক মজমার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। অথচ প্রধানমন্ত্রীর বিরাট এক প্রতিপক্ষ প্রতিদিন ছুরিতে সান দিচ্ছেন। সুযোগ পেলে প্রধানমন্ত্রীর গলা কেটে ফেলবেন।
যখন শাসক দলের প্রয়োজন টিম ওয়ার্কের তখন টিম ভাঙার এই আত্মঘাতি প্রচেষ্টা বোধগম্য হচ্ছে না। নেতারা নিজেদের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন কেন? বিদ্বেষের নামে মানুষ যতটা মেতে উঠে, ভালবাসার নামে ততটা নয়।
গত ১৫ আগস্টের আগে '৭৫ এর ট্রাজিডি নিয়ে একটা কলাম লিখেছিলাম। এই হত্যার প্রেক্ষপাট আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিলাম- ফারুক-রশীদ, মোশতাক-জিয়া গংরা বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যা করেছে সত্য কিন্তু তার পটভূমি তৈরি করেছে কিছু খলনায়ক। আমার চোখে সিরাজুল আলম খান, রব-জলিলরা ছিল সেই খলনায়ক। কারণ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ১০ মাসের মাথায় জাসদের জন্ম দিয়ে বঙ্গবন্ধু সরকারকে অস্থির করে তুলেছিল তারা। জাসদ, ন্যাপ ভাসানী, তোয়াহা, আব্দুল হক, আলাউদ্দিন, আবদুল মতিন, ওহিদুর রহমান, সিরাজ শিকদার, জিয়াউদ্দিনের সর্বহারা পার্টি আর একাত্তরের পরাজিত শক্তির মুসলিম বাংলা- সব মিলিয়ে বঙ্গবন্ধুকে প্রতিরোধ করার পক্ষগুলো একাট্টা হয়ে মাঠে নেমেছিল তখন।
প্রসঙ্গটা তুলেছিলাম নতুন প্রজন্মের জন্য ইতিহাস পাঠের স্বার্থে। কোনো বিদ্বেষে নয়। অন্য বামরা এখন মৃত। খণ্ডিত জাসদের পরিচিত অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বর্তমান তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। এই জাসদ আর সেই জাসদ নেই। জাসদকে আমি ব্যক্তিগভাবে সেই চোখে দেখিও না। এরা এখন আওয়ামী লীগের সবচেয়ে কাছের বন্ধু, জোটের শরীক। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির যে কোনও আন্দোলনে জাসদ নেতা কর্মিদের ভূমিকা পরীক্ষিত। জাসদের অনেকে বিলিনও হয়েছেন আওয়ামী লীগে। ক্ষমতা ছাড়ার পর আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ শেখ হাসিনার পরে যাকে কোপানোর জন্য বসে আছে- তিনি হচ্ছেন হাসনুল হক ইনু।
গত কয়দিন ধরে দেখছি ইনুকে আক্রমনে ব্যস্ত সরকারি দলের লোকেরা। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিএনপির কিছু নেতাও। তাদের কলহ দেখে আতংকিত হচ্ছি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগে দেশে যে পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল পরিস্থিতি যেন এখন সে রকমই বিরাজ করছে। গত দু.সপ্তাহে ঢাকাসহ কয়েকটি জেলায় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে অন্তত ছয়জন নিহত হন। ক্রসফায়ারে হত্যা হচ্ছে। হত্যার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেই প্রথমবারের মতো হঠাৎ শোরগোল তোলা হচ্ছে।
শাসক দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যেও এমন আশংকার কথা ফুটে উঠেছে। আশরাফ দুই সপ্তাহ আগেও জাতীয় শোক দিবসের এক অনুষ্ঠানে বক্তব্যে ৭৫-এর ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, 'তখনও (১৯৭৫ সাল) আমাদের দল ক্ষমতায় ছিল। তাহলে আমাদের দলের নেতা-কর্মীরা তখন কোথায় ছিল? তখন কি আমাদের কোনো ব্যর্থতা ছিল না?'
গত কয়েকদিনের ঘটনাবলি দেখলে মনে হচ্ছে বিদ্বেষপূর্ণ কথা ছড়াচ্ছেন বেশি প্রধানমন্ত্রীর নিকট আত্মীয় শেখ ফজলুল করিম সেলিম এমপি। তাকে অনুসরণ করে মুখ খুলেছেন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ। এদের সঙ্গে আদর্শের ফেরিওয়ালা সেজেছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।
শেখ সেলিম এই কলহটা আরম্ভ করেছেন ১৫ আগস্ট থেকে। জাসদকে বঙ্গবন্ধু হত্যার ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য দায়ী করেছেন তিনি। জেনারেল শফি উল্লাহকে অমার্জিত ভাষায় আক্রমন করেছেন সেনাপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য অভিযোগে। তার অভিযোগ হয়তো সত্য কিন্তু এই সময়ে, এই পরিস্থিতিতে কেন? এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে এখন কি করা উচিত তিনি সেটা বলছেন না কিন্তু অভিযোগের পর অভিযোগ তুলে পরিস্থিতি ঘোলাটে করছেন কী কারণে? তিনি কি জাসদ নেতাদের, শফি উল্লাহর বিচার চান নাকি তাদেরকে জোট থেকে, দল থেকে বের করে দিতে চান? তাকে সুস্পষ্ট করে বলা উচিত। তিনি কেন এতো মুখরা হলেন। নাকি দুর্জনদের কথাই মানতে হচ্ছে যে- পরিস্থিতি ঘোলাটে করে তিনি মন্ত্রী হতে চান?
আমেরিকা বঙ্গবন্ধুর খুনী মহিউদ্দিনকে ফেরত দিয়েছিল। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে আরেক খুনি রাশেদ চৌধুরীকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে। এটা দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কি কোনও ইঙ্গিত দিতে চাচ্ছে? এই সময় শাসক দলের লোকদের মধ্যে ঐক্য সিমেন্টের মতো হওয়া উচিত। দলের ঐক্য ও ভিত্তি মজবুত হওয়া প্রয়োজন। এটা আত্মকলহ পাকানোর সময় নয়। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির আরও ঐক্যের প্রয়োজন।
আওয়ামী লীগের যুক্তফ্রন্ট টাইপের সরকার গঠনের প্রয়োজন না থাকলেও প্রধানমন্ত্রী জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় পার্টিকে তার মন্ত্রিসভায় স্থান দিয়েছেন। খুব কঠিন সময়ে মেনন-ইনুরা মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন।
চল্লিশ বছরব্যাপী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনেক প্রেমিক দেশবাসী দেখেছে। শেখ হাসিনাকে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার জেলে নিয়েছে তখন তার দলের অনেকের ভূমিকাও মানুষ দেখেছে। বহু প্রশ্নের অবতারণা হয়েছে। সেসব প্রশ্ন তুলে অপ্রয়োজনীয়ভাবে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার কোনও মানে হয়না এখন। দরকার নেই। দেখছি কোনও কোনও কলামিস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যায় রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নিরুপণের পরামর্শ দিচ্ছেন। আমার মনে হয় সেটা বর্তমান সময়ে নিজেদের মধ্যে কলহ বাধানোর অপচেষ্টা।
আওয়ামী লীগ সরকার দীর্ঘ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার একটা আকাঙ্খা ব্যক্ত করেছেন শেখ হাসিনার সরকার। যেসব প্রকল্প প্রহণ করেছেন তা বাস্তবায়ন করতে পারলে নিশ্চয়ই ২০২১ সালের অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছানো অসম্ভব কিছু না। তবে এর জন্য সবার আগে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। কিন্তু আওয়ামী লীগের নিজের মধ্যেই যদি স্থিতিশীলতা না থাকে তাহলে অপরের কাছ থেকে সেই স্থিতিশীলতা সরকার আশা করবে কি করে!
আমেরিকা বাংলাদেশের পোশাক শিল্পখাতের জন্য দেওয়া জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার করেছে। তা পূর্নবহালের জন্য নানা শর্ত দিয়েছিল। সেসব শর্ত পূরণ করলেও জিএসপি সুবিধা পূর্ণবহাল করছে না। মনে হচ্ছে আমেরিকা বর্তমান সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখতে চায়। অসন্তোষ এখনো তাদের পুরোপুরি কাটেনি। সুতরাং এই সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে কোনও উদ্যোগ আসলেও সন্দেহ নেই আমেরিকা তাতে হাওয়া দিবে, সমর্থন দিবে। সে কারণেই এখন সরকারে, দলে, জোটে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির মধ্যে অটুট ঐক্যের প্রয়োজন।
দারিদ্রতার মধ্যে কোনও সৌন্দর্য নেই। প্রধানমন্ত্রী দারিদ্রতা থেকে জাতিকে মুক্ত করার জন্য সংকল্প গ্রহণ করে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছেন। তা সফল হলে জাতি সুখে শান্তিতে থাকবে তা নয়, বিশ্বসভায়ও জাতির মুখ উজ্জ্বল হবে। সুতরাং আওয়ামী লীগ সভানেত্রীরও উচিত আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদেরকে দলগত ঐক্য, জোটগত ঐক্য এবং মুক্তিযুদ্ধের শক্তির ঐক্য বজায় রাখতে কঠোর নির্দেশ দেওয়া।
লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক
Also read:
__._,_.___