মুসলিম পটশিল্পীর সৃজনেই সেজে উঠছে রূপচাঁদ মুখার্জি লেনের মণ্ডপ
সরোজ দরবার: শারদ সাজে সেজে উঠছে প্রকৃতি, শহরও। ধুয়ে যাচ্ছে মালিন্য। ঝলমলে এই বাতাবরণ কি তবু মনের কোণের দীনতাটুকুও মুছে দিতে পারছে? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, অন্তত কোথাও কোথাও জেগে আছে আশার আলো। যেমন রূপচাঁদ মুখার্জি লেনের পুজোয়। এক মুসলিম পটশিল্পীর সৃজনেই সেজে উঠছে এবারের মণ্ডপ।
[অভিনব আয়োজন, আসানসোলে একই বাড়িতে পূজিতা দুই দুর্গা প্রতিমা]
বেশ অভিনব ভাবনাই বলা যায়। যখন এ রাজ্যেই কিছুদিন আগে সাম্প্রদায়িক অশান্তির তুষচাপা আগুন লকলকিয়ে উঠেছিল। কিংবা বিসর্জন নিয়ে যেখানে বিভেদের অভিযোগ ওঠে, সেখানে নিঃসন্দেহে এ এক ছকভাঙা প্রয়াস। কিন্তু কেন এরকম ভাবনা? আসলে এ পুজো কালীঘাটের বেশ কাছেই। শিল্পী পিয়ালী সাধুখাঁ জানাচ্ছেন, এবারের পুজোয় কালীঘাটের পটশিল্পের প্রয়োগ করার ভাবনা ছিল তাঁর। পট এখনও বহু দেখা যায় বটে, কিন্তু তা মূল ধারার সস্তা সংস্করণই বলা যায়। শিল্পীর খোঁজ ছিল এমন পটশিল্পীর, যাঁর কাজে অন্তত মূলধারার ছোঁয়া আছে। আর তা খুঁজতে খুঁজতেই তিনি পেয়ে যান স্বর্ণ চিত্রকরকে। হ্যাঁ, নাম এরকম বটে। কিন্তু তাঁরা মুসলমান। অর্থাৎ হিন্দুদের জন্য কাজ করতে গিয়ে তিনি এই নাম নিলেও, মুসলমান সমাজে তাঁর পরিচিত অন্য নামে। তফাত মাত্র নামে, কিন্তু শিল্পের প্রশ্নে দুটো মানুষে তো কোনও বিভেদ নেই। অভিভূত হন শিল্পী ও উদ্যোক্তারা। মুগ্ধ হন তাঁর কাজেও। ঠিক যে জিনিসের খোঁজ ছিল, তাই সাজানো স্বর্ণ চিত্রকরের ঘরে। তারপরই তাঁর পটচিত্রে মণ্ডপ সাজানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়। থিমের নামও দেওয়া হয় 'স্বর্ণ-চিত্র'।
[পুজোয় মননের সুলুকসন্ধান টালা পার্ক প্রত্যয়ে]
পটচিত্রের কাজ করা তো এই প্রথম নয়, জানাচ্ছেন স্বর্ণ চিত্রকর। বংশ পরম্পরায় তাঁরা এ কাজ করে চলেছেন, যাঁদেরকে চলতি কথায় পটুয়া বলা হয়। পটের গায়ে রঙের আঁচড়েই তাই দিনযাপন। তবে এতবড় মণ্ডপে এই মাত্রার কাজ এই প্রথমবার। স্বভাবতই বেশ উচ্ছ্বসিত তিনি। জানাচ্ছেন, মুসলমান বলে গোড়ার দিকে অনেক সমস্যায় পড়তে হত। রামায়ণ, মহাভারতের কাহিনি তাঁরা মুখে মুখে শুনেই আত্মস্থ করেছেন। তবে কাজ করতে গিয়ে দুই সম্প্রদায়ের মানুষের থেকেই কিছু না কিছু বাধা পেয়েছেন। কিন্তু থেমে যাননি। আর তাই আজ তাঁর সৃষ্টির অভিযাত্রা শহরের অন্যতম সেরা এক মণ্ডপ অবিমুখে। চণ্ডীমঙ্গল থেকে কমলে-কামিনী আখ্যান ফুটিয়ে তুলছেন তিনি। রূপচাঁদ মুখার্জি লেনের পুজোয় শহরের লক্ষ লক্ষ দর্শনার্থী যে সৃষ্টির সাক্ষী থাকবেন, তিনি শুধু মুসলমান নন, একজন শিল্পী। এমনটাই জানাচ্ছেন পিয়ালী সাধুখাঁ। বলছেন, আমরা তো এই জায়গাটাই তুলে ধরতে চেয়েছিলাম। শিল্প, সৌন্দর্য যে সবরকম জাতপাত-ভেদাভেদের উর্ধ্বে তা প্রতিষ্ঠিত হল এই কাজে।
[রাজ্যে পুজো শুরু হওয়ার আগেই বিসর্জন প্রতিমার, জানেন কেন?]
রাজ্যে কিছুদিন আগেই ছড়িয়ে পড়েছিল অশান্তির আগুন। যদিও শুভবুদ্ধির জাগরণে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। অকালবোধনে এবার সেই শুভবোধেরই আবাহন রূপচাঁদ মুখার্জি লেনে। পুজোর আঙ্গিকে এ কি তবে একটা সম্প্রীতির বার্তা? পিয়ালী বলছেন, নিঃসন্দেহে তা বলা যায়। সবার আগে মানুষ। শাশ্বত শিল্পের কাছে যে কোনও বিভেদই নতজানু। আর স্বর্ণ চিত্রকর কী মনে করছেন? বার্তা কি সম্প্রীতি এত কিছু তিনি জানেন না। মনের আনন্দে তিনি মা দুর্গাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। আর বলছেন, আমাদের এখানে হিন্দু-মুসলমান সকলে বেশ ভালই আছি। কোনও সমস্যা নেই। সমস্যা তো না থাকারই কথা। তাঁর হাতে সেজে ওঠা পুজো দেখতে দেখতে সম্প্রীতির এই ভিত্তিভূমিতেই পা দেবেন মানুষ। সত্যি তো আমরা কী করে ভুলে যাব, এ দেশে বিসমিল্লা খাঁয়ের সানাইতেই যে বেজে ওঠে রাগ দুর্গা।
ছবি: অমিত ঘোষ
[মহাষ্টমীতে অপমৃত্যুর আতঙ্ক, পুজো 'নিষিদ্ধ' বাংলার এই গ্রামে]
__._,_.___