ইতালিয়ান নাগরিক সিজারে তাবেলা হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে গ্রেফতার হওয়া তানজিদ আহম্মেদ রুবেল ওরফে শুটার রুবেল। গতকাল তাকে আদালতে হাজির করা হলে মহানগর হাকিম মাহবুবুর রহমানের আদালতে জবানবন্দি দেয় রুবেল। তবে এ হত্যায় গ্রেফতার অন্য ৩ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। এর আগে রোববার তাবেলাকে হত্যায় অংশ নেয়া '৩ পেশাদার খুনিসহ ৪ জনকে' গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর অপরাধ তথ্য ও গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে তাবেলাকে গুলি করে তানজিদ আহম্মেদ রুবেল ওরফে শুটার রুবেল। তাবেলাকে অনুসরণ করে রাসেল চৌধুরী ওরফে চাক্কি রাসেল, মিনহাজুল আবেদিন রাসেল ওরফে ভাগিনা রাসেল এবং হত্যায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল সরবরাহ করে মো. শাখাওয়াত হোসেন ওরফে শরীফ। গ্রেফতারকৃতরা প্রত্যেকে পেশাদার অপরাধী এবং এক 'বড় ভাইয়ের নির্দেশে টাকার বিমিনয়ে' তাবেলা সিজার হত্যায় অংশ নেয়। গতকাল সকালে ডিএমপি কমিশনার এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান।সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গত রোববার রাজধানীর গুলশান ও বাড্ডার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয় এবং হত্যায় ব্যবহৃত মোটারসাইকেলটি উদ্ধার হয়। তবে হত্যায় ব্যবহৃত পয়েন্ট ৩২ বোরের লোকাল মেড তৈরি পিস্তলটি উদ্ধার করা যায়নি। গতকাল সকাল ১১টায় ৪ জনকে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে হাজির করা হয়। তবে গ্রেফতারকৃতদের পরিবারের লোকজন জানিয়েছে, তাদের ১৫ থেকে ২০ দিন আগে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ডিবি পরিচয়ে। একই সময় ডিবি সদস্য পরিচয়ে বিএনপির সমর্থিক সাবেক কমিশনার কাইয়ুমের ভাই ডা. মতিন ও বাড্ডার শুটার জুয়েলকেও আটক করে নিয়ে গেছে বলে তাদের স্বজনরা অভিযোগ করে আসছে।গতকাল সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, সিজারে তাবেলা হত্যার পর ঘটনাস্থলে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণ করে হত্যাকা-ে অংশ নেয়া ৩ জন তানজিদ আহম্মেদ রুবেল ওরফে শুটার রুবেল, সিজারকে অনুসরণকারী রাসেল চৌধুরী ওরফে চাক্কি রাসেল ও মিনহাজুল আবেদিন রাসেল ওরফে ভাগিনা রাসেলকে শনাক্ত করা হয়। এদের মধ্যে চাক্কি রাসেলকে গুলশান এলাকা থেকে এবং ভাগিনা রাসেলকে বাড্ডা সাতারকুল এবং শুটার রুবেল এবং মোটরসাইকেলের মালিক শাখাওয়াত হোসেন শরীফকে মধ্য বাড্ডা থেকে গ্রেফতার করা হয়। পরে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ভাগিনা রাসেলের দেয়া তথ্যে মধ্য বাড্ডার ট/ ১১৯ নম্বর বাসা থেকে হত্যাকা-ে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়। মোটরসাইকেলটির মালিক শরীফ জানায়, রুবেল ও দুই রাসেল বিভিন্ন সময়ে তার কাছ থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যেত। ঘটনার আগে একটি অপারেশনে যেতে হবে জানিয়ে তাকে মোটরসাইকেলটি দিতে বলে। শরীফ তাদের ৩ জনকে মোটরসাইকেল দেয়। ঘটনার দিন রাতেই তাকে আবার মোটরসাইকেলটি ফেরত দিয়ে যায় ভাগিনা রাসেল।সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, হত্যাকা-ে ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রটি এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। অস্ত্রটি কার কাছে কোথায় আছে সে তথ্য গোয়েন্দাদের কাছে রয়েছে। অস্ত্র উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। অস্ত্র উদ্ধার হলে ব্যালাস্টিক পরীক্ষার মাধ্যমে উদ্ধার হওয়া গুলি মিলিয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে গুলি কে করেছে। হত্যাকা-ে ব্যবহৃত অস্ত্রটি পয়েন্ট ৩২ বোরের এবং দেশীয় তৈরি অস্ত্র বলেও জানানো হয়।সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি কমিশনার দাবি করেন, সিজারে তাবেলাকে হত্যার কোন টার্গেট আগ থেকেই ছিল না গ্রেফতারকৃতদের। তাদের টার্গেট ছিল যেকোন একজন বিদেশিকে হত্যা করার। হোয়াইট কালার (সাদা চামড়ার) বিদেশি নাগরিককে হত্যার নির্দেশনা ছিল কথিত বড় ভাইয়ের পক্ষ থেকেও। দেশকে অস্থিতিশীল করে আন্তর্জাতিকভাবে 'বাংলাদেশে বিদেশি নিরাপদ নয় প্রমাণ করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে' ওই বড় ভাইয়ের নির্দেশে গ্রেফতারকৃতরা এ হত্যাকা- ঘটায়। এ জন্য মোটা অঙ্কের টাকার চুক্তিও হয়েছিল। তবে টাকার সঠিক পরিমাণ সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।ডিএমপি কমিশনার বলেন, ঘটনার দিন মূল খুনি শুটার রুবেল সিটি করপোরেশন অফিসের সামনে অবস্থান নেয়। ৯০ নম্বর রোডে মোটরসাইকেলে ছিল ভাগিনা রাসেল ও চাক্কি রাসেল। সিজারে তাবেলা ৮৯ নম্বর রোড দিয়ে ৯০ নম্বর রোডে প্রবেশ করলেই চাক্কি রাসেল ও ভাগিনা রাসেল শুটার রুবেলকে ফোন করে তাবেলার অবস্থান সম্পর্কে জানিয়ে গুলি করার জন্য বলে। সঙ্গে সঙ্গে সিটি করপোরেশন অফিসের সামনে থেকে রুবেল ৯০ নম্বর রোডে এসে একাই সিজারে তাবেলাকে গুলি করে। এর পর তারা ৩ জনই ৮৩ নম্বর রোড দিয়ে পালিয়ে যায়।কমিশনারের দাবি, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা ডিবিকে জানিয়েছে, হত্যার কয়েকদিন আগে এক বড় ভাই তাদের ডেকে নিয়ে বলে একজন বিদেশিকে হত্যা করতে হবে। তখন গ্রেফতারকৃতরা ওই বড় ভাইকে পাল্টা প্রশ্ন করেন আপনার সঙ্গে কারও শত্রুতা রয়েছে কিনা। তখন বড় ভাই বলেন, আমার সঙ্গে কারও শত্রুতা নেই। সরকার অনেক বাড়াবাড়ি করছে। সরকারকে চাপে ফেলতে এ কাজটি 'বিদেশি হত্যা' করতে হবে। কমিশনারের দাবি, হত্যার জন্য একটি মোটা অঙ্কের টাকা চুক্তি হয় খুনিদের সঙ্গে। চুক্তি অনুযায়ী কিলিং মিশনে অংশ নেয়া ৩ জন ওই বড় ভাইয়ের কাছ থেকে অর্ধেক টাকাও নিয়েছে। বাকি অর্ধেক টাকা কাজ হয়ে যাওয়ার পর নেয়ার কথা থাকলেও এখনও সে টাকা পায়নি খুনিরা।ডিএমপি কমিশনার বলেন, জানুয়ারি থেকে মার্চ
মাস পর্যন্ত মোট ৯২ দিন যারা নাশকতা করেছে তারা এ সকল ঘটনার সঙ্গে জড়িত কি-না তা ক্ষতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য কেউ কেউ আইএস প্রচারণা চালাচ্ছিল। আমাদের তদন্তে কোন ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব পড়বে না। যেহেতু পুলিশ একটি পেশাদার বাহিনী সেহেতু তদন্তে কোন ধরনের প্রভাব পড়বে না।এদিকে তাবেলা হত্যায় গ্রেফতারকৃতদের আরও ১৫ থেকে ২০ দিন আগেই আটক করা হয়েছিল বলে তাদের স্বজনরা দাবি করে আসছিলেন। মধ্য বাড্ডা থেকে এদের আটক করার পর স্বজনদেরও কিছু জানানো হয়নি আটকের কারণ সম্পর্কে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে রাসেল চৌধুরীর বাসা দক্ষিণ বাড্ডার শিমুলতলা বাজারের ব/ ৮৯। শুটার রুবেল থাকতেন মধ্য বাড্ডার ৯ নম্বর রোডের ২১ নম্বর বাসায়।গ্রেফতারকৃত রুবেলের মামা তৌহিদ জানান, তার ভাগিনা রুবেল পেশায় ইলেক্ট্রনিঙ্ মিস্ত্রি ও মোবাইল সার্ভিসিং করেন। রুবেলের ৩ বছর বয়সে বাবা হানিফ মোল্লা মারা যাওয়ার পর থেকে তাদের কাছে থেকেই বড় হয়েছে। রুবেল এখনও বিয়ে করেনি। বাড্ডা ২১ নম্বর বাসাটি তাদের নিজস্ব। নিখোঁজ থাকার পর গত ১২ অক্টোবর রুবেলের নাম তারা পত্রিকায় দেখেন। এর পর প্রথমে থানায় ও পরে ডিবিতে খোঁজ নিলে রুবেলের আটকের বিষয়ে তাদের কিছুই জানানো হয়নি। ২১ অক্টোবর বাড্ডা থানায় রুবেলের নিখোঁজ থাকার বিষয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি করেন মামা তৌহিদ। কী অভিযোগে তার ভাগিনাকে আটক করা হয়েছে গতকাল পর্যন্ত পুলিশের পক্ষ থেকে কিছুই জানানো হয়নি। তবে গোয়েন্দারা জানান, রুবেল একজন পেশাদার খুনি। এছাড়া ভাগিনা রাসেল, আরেফিন রাসেল পেশাদার ইয়াবা ব্যবসায়ী। মাদক মামলায় এরা একাধিকবার সাজাও ভোগ করেছে। শাখাওয়াত হোসেন ইয়াবা ব্যবসায়ী ও অবৈধ অস্ত্রের সরবরাহকারী।একজনের স্বীকারোক্তি৩ জন রিমান্ডেইতালীয় নাগরিক সিজারে তাবেলা হত্যা মামলায় গ্রেফতার মূল কিলার তানজিদ আহম্মেদ রুবেল ওরফে শুটার রুবেল হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। গ্রেফতারকৃত অন্য ৩ জন রাসেল চৌধুরী ওরফে চাক্কি রাসেল, মিনহাজুল আবেদিন রাসেল ওরফে ভাগিনা রাসেল ওরফে কালা রাসেল এবং শাখাওয়াত হোসেন শরীফকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটদিনের পুলিশ হেফাজতে পাঠিয়েছে আদালত।ঢাকার মহানগর হাকিম মাহবুবুর রহমানের আদালতে পুলিশ ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে শুনানি শেষে এ আদেশ দেন।পুলিশের অপরাধ তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের সহকারী কমিশনার মিরাশ উদ্দিন জানান, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক জেহাদ হুসাইন ওই তিনজনকে আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের পুলিশ হেফাজত চান। 'বিচারক শুনানি শেষে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের আটদিনের পুলিশ হেফাজতে নেয়ার অনুমতি দেন। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে তানজিদ আহম্মেদ রুবেল ওরফে শুটার রুবেল হত্যাকা-ের দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়ায় তাকে রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করা হয়নি।উল্লেখ, ২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় গুলশান-২ এর ক্রসিং সংলগ্ন ৯০ নম্বর রোডের পশ্চিম প্রান্তে অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তদের গুলিতে ইতালিয়ান নাগরিক তাবেলা সিজার আহত হন। তাকে তাৎক্ষণিক পথচারীদের সহায়তায় ইউনাইটেড হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় নিহতের কর্মক্ষেত্র নেদারল্যান্ডসের অর্থায়নে পরিচালিত আইসিসিও নামে এনজিওর বাংলাদেশ পরিচালক হেলন ভেনডার ভিক বাদী হয়ে গুলশান থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
http://www.thedailysangbad.com/first-page/2015/10/27/31944
ঢাকা, মঙ্গলবার, ১২ কার্তিক ১৪২২, ১৩ মহররম ১৪৩৭, ২৭ অক্টোবর ২০১৫
Related STORIES
__._,_.___