SitangshuGuha 646-696-5569
__._,_.___
'মুন সিনেমা হল মামলা' সম্পর্কে সাধারণ মানুষদের কয়জন জানেন? কেউই হয়তো কিছু জানেন না, কারণ সাধারণ মানুষ ব্যস্ত রয়েছে ক্রিকেট খেলা ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে। অথচ এই 'মুন সিনেমা হল' মামলাকেই ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে এমন এক রায় দেয়া হয়েছে, যাতে বাতিল হয়ে গিয়েছে সংবিধানের 'আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস', ফিরে এসেছে হিন্দু ও নাস্তিকদের বহুল আকাঙ্খিত 'ধর্মনিরপেক্ষতা'। ভাবছেন এটা কী করে সম্ভব? তো আসুন বিষয়টি আলোচনা করি। একাত্তরে যুদ্ধের পর এদেশের বহু পাকিস্তানী তাদের প্রচুর সম্পত্তি ফেলে চলে যায়। সেসব সম্পত্তি সরকার বাজেয়াপ্ত করে নেয় 'অর্পিত সম্পত্তি' হিসেবে। সেরকম একটি সম্পত্তি ছিলো পুরান ঢাকার ওয়াইজঘাটের 'মুন সিনেমা হল', যার মালিক ছিলো পাকিস্তানের 'ইটালিয়ান মার্বেল ওয়ার্কস'। এই সম্পত্তি বঙ্গবন্ধু সরকার বাজেয়াপ্ত করে প্রদান করেছিলো মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টকে। কিন্তু স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে কোম্পানীর নাম বদলে 'বাংলাদেশ ইটালিয়ান মার্বেলস ওয়ার্কস লিমিটেড' রাখা হয় । তারা মুন সিনেমা হল ফিরে পেতে নানা জায়গায় লবিং করতে থাকে। এর মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এর পর শিল্প মন্ত্রণালয় ২৭ জুন ১৯৭৫ সালে ওই সম্পত্তি 'পরিত্যাক্ত সম্পত্তি" বলে প্রাক্তন মালিককে চিঠি দিয়ে জানিয়ে সব আবেদন নাকচ করে দেয়। স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। ইটালিয়ান মার্বেল ওয়ার্কস থেকে ১৯৭৬ সালে সম্পত্তি ফেরত পাবার আদেশ কামনা করে হাইকোর্টে রিট করেন। রিট দায়েরের প্রায় এক বছর পর ১৯৭৭ এর ১৫ জুনে হাইকোর্ট তার রায়ে মন্ত্রণালয় ও কল্যাণ ট্রাস্টকে সম্পত্তি ফেরত দিয়ে দেবার নির্দেশ জানিয়ে রিট নিষ্পত্তি করেন। কিন্তু তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের সংবিধানের ৫ম সংশোধনীতে আর্টিকেল ৭ এ একটি ধারা যুক্ত করেন যে, মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় শত্রুসম্পত্তি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ সংস্থা পাবে। আইনটি ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খুবই উপকারী। কিন্তু এর ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যায় মুন সিনেমা হল মামলা। এখানেই শুরু হয় আসল নাটক। এরপর সামরিক শাসন বাতিল হলে ১৯৯৪ সালে সিনেমা হলের মালিক ফের মামলা করেন। তখন মামলাটি গিয়ে দাঁড়ায় এই তর্কবিতর্কে যে, জিয়াউর রহমানের ঐ আইন করার এখতিয়ার ছিলো কি না ,শুনে অবাক হবেন, এই মামলার রায় দেয়া হয় ২০০৫ সালে বিএনপি-জামাত ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়। রায়ে বলা হয়, জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখল অবৈধ, তার পুরো শাসনকাল অবৈধ, তার শাসনকালের সময়ে করা পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ। এই রায় দিয়ে হাইকোর্ট সিদ্ধান্ত দেয়, মুন সিনেমা হলের জমি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের কাছ থেকে নিয়ে ইটালিয়ান মার্বেল ওয়ার্কসের মালিক মাকসুদুল আলমকে বুঝিয়ে দিতে হবে। তখন বিএনপি সরকার তড়িঘড়ি করে মামলাটি কোনভাবে স্থগিত করিয়ে রাখে। কিন্তু পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই এই মামলাকে সচল করা হয়। ২০১০ সালে এই 'মুন সিনেমা হল' মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করা হয় এবং জিয়াউর রহমান আমলের সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করা হয়। জিয়াউর রহমান পঞ্চম সংশোধনীতে 'গণভোট' রেখেছিলেন, যেই 'গণভোট' নিয়েই সংবিধানে 'আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' যোগ করা হয়েছিলো। ২০১০ সালের রায়ে এই 'গণভোট' বাতিল করে দেয়া হয়, যার ফলে 'আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' সংবিধান থেকে বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু মজার বিষয় হলো, যেই 'মুন সিনেমা হল'কে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে কেড়ে নিয়ে মাকসুদুল আলমকে বুঝিয়ে দিতে বলা হলো, সেই মাকসুদুল আলম যুদ্ধের সময়েই পাকিস্তান চলে যায়। সে ফেরত আসেনি, এই ছুতোয় 'মুন সিনেমা হল' এর সম্পত্তি এখনও ফেরত দেয়া হয়নি। জমি জমির জায়গাতেই আছে, ওদিকে বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে 'আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস'।
এখানে আমরা যা দেখতে পেলাম-
১) 'বাহাত্তরের সংবিধান' পন্থীরা প্রায়ই বলে থাকে, তারা সংবিধান চেঞ্জ করেছে নাকি 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা' ফিরিয়ে আনার জন্য। কিন্তু 'মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট' থেকে সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে তা পাকিস্তান পলাতক মাকসুদুলকে বুঝিয়ে দেয়ার মধ্যে কোন 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা' কাজ করছে, তা সত্যিই আমার বুঝে আসে না। সাথে সাথে পাঠকদের এটাও জানা দরকার যে, সংবিধানে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস সংযুক্ত হয়েছিলো 'গণভোট' এর মাধ্যমে। হাইকোর্টের রায়ে এই গণভোট বাতিল করার ফলেই 'ধর্মনিরপেক্ষতা' প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। অর্থাৎ গণতন্ত্রের নাম করে 'গণভোট' বাতিল করা হলো, আর 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা'র নামে মুক্তিযুদ্ধ কল্যাণ ট্রাস্টের বিরুদ্ধে রায় দেয়া হলো।
২) আওয়ামী লীগ সরকার খুব চালাক। সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তনের এখতিয়ার একমাত্র পার্লামেন্টের, কিন্তু আওয়ামী সরকার আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে 'আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস' উঠিয়ে দিয়েছে। কাজটি সম্পূর্ণই বেআইনি, কিন্তু আওয়ামী সরকার তা করেছিলো নিজের ঘাড়ে দায় না নেয়ার জন্য।ঠিক সেভাবেই বর্তমানে যে সংবিধান থেকে 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' উঠিয়ে দেয়ার কাজ চলছে, তা করা হচ্ছে আদালতের মাধ্যমে। অথচ আদালতের এই বিষয়ে কিছু করার এখতিয়ার নেই। কিন্তু পার্লামেন্টে করলে আওয়ামী লীগের ঘাড়ে সরাসরি নাস্তিকতার দায় চাপবে, তাই তারা এখানেও আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে গুলি করছে।
৩) এখানে ইসলামবিরোধীদের মূল অস্ত্র হয়েছে একটি পরিত্যাক্ত সিনেমা হল। একটি সিনেমা হলের মামলার রায় দিতে গিয়ে সংবিধান থেকে 'আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' উঠিয়ে দেয়া হয়েছে এবং 'ধর্মনিরপেক্ষতা' ফিরিয়ে আনা হয়েছে। অর্থাৎ হারাম থেকে হারামই উৎপন্ন হয়। বর্তমানে হয়তো সিনেমা হল নেই, কিন্তু ক্রিকেট খেলা তো রয়েছে। ভারত থেকে নর্তকী এনে কনসার্ট করা তো রয়েছে। এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল আমাদেরকে চিন্তা করতে হবে। ক্রিকেট খেলায় জাতিকে ডুবিয়ে রেখে কতো ক্ষতি করা হচ্ছে, তা হয়তো কেউ চিন্তাও করতে পারবে না। কলকাতা থেকে বিভিন্ন অভিনেতা এনে সাক্ষাৎকারে বলানো হচ্ছে, বাংলাদেশে এই সম্পত্তি তার, ঐ সম্পত্তি তার। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরবর্তীতে হয়তো এমন আইন পাশ করা হবে, যেখানে লেখা থাকবে কলকাতা থেকে হিন্দুরা সম্পত্তি ফেরত চাইলে তা মুসলমানরা ফেরত দিতে বাধ্য থাকবে। একটি সিনেমা হলের জমির মামলাকে কেন্দ্র করে যদি সংবিধান বাতিল করে দেয়া যায়, তাহলে এমনটি হলে তাতে আশ্চর্যের কিছু থাকবে না।
অর্থাৎ মুসলমানদের এখন সমস্ত হারাম কাজ ত্যাগ করে মুসলমান হওয়াটাই সবচেয়ে বেশি জরুরী। একটি হারাম থেকেই উৎপত্তি ঘটতে পারে বিরাট দুর্যোগের, যাতে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব। আজকের ক্রিকেটের উল্লাস আগামী দিনের পরাধীনতার হাহাকার, আজকের ভারতীয় শিল্পীর গিটার আগামী দিনের বিএসএফের হিংস্র বেয়নেট।
তুরিন আফরোজ
সোমবার মার্চ ২৮, ২০১৬, ১০:১৭ এএম.
বিডিলাইভ ডেস্ক: একাত্তর সালে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর ওপর সংঘটিত ভয়াবহ গণহত্যায় জড়িত এদেশীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। নানা ষড়যন্ত্র ও বিতর্কের জাল ছিন্ন করেও এ কাজ এগিয়েছে। একাত্তর দেখিনি আমি। কারণ আমার জন্মই একাত্তরে। তথন যে চেতনা ধারণ করে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে গিয়েছিলেন, আমিও সেটি ধারণ করি। সে বোধ থেকেই একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সম্পৃক্ত হওয়া। যুক্ত হওয়ার ইচ্ছাটা ছিল আগে থেকেই। কিন্তু কীভাবে যুক্ত হব, কোন ফরম্যাটে কাজ করব, তা নিয়ে দ্বন্দ্বে ছিলাম। বিদেশে আইনের ওপর পড়াশোনা করে দেশে ফিরে যুদ্ধাপরাধের বিচারের যে আন্দোলন, তার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলাম। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিতে যোগদান করে তাদের আইন-বিষয়ক সেক্রেটারিও হলাম। সেটা ২০১০ সালের কথা।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যাতে আজকের প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, এ জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজনে 'আমার একাত্তর' নামে একটি অনুষ্ঠান করতাম। দেশব্যাপী চলত সেটা। তরুণ মুক্তিসেনা ক্যাম্প করে তরুণদের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু করি আমরা।
পুরো কাজটাই ছিল আমার পরিকল্পনায়। যেহেতু একেক সময় একেক ইতিহাস সামনে এসেছে, এতে আজকের প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভ্রান্তি থাকা স্বাভাবিক। এই বিভ্রান্তি দূর করা, তাদের প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়া– এভাবে নানা ফরম্যাটে কাজ করছিলাম। এমন সময় কাদের মোল্লার রায় নিয়ে যখন বিক্ষোভ দেখা দিল, গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি হল, দেশজুড়ে সংক্ষুব্ধ মানুষ রাস্তায় নেমে এল, আমিও তাতে পা মেলালাম।
তখন গণজাগরণ মঞ্চ, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক-বাহক বিভিন্ন সংগঠন ও মহল থেকে দাবি উঠল যে, আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে এমন একজনকে নিয়োগ দেওয়া হোক, যিনি আন্তর্জাতিক আইন ও যুদ্ধপরাধ আইন বোঝেন। আমাদের দেশে আইনটি যেহেতু নতুন, সেহেতু এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পাওয়া কঠিন ছিল।
এ অবস্থায় প্রসিকিউশনে আমাকে নেওয়ার কথা উঠল। কিন্তু আমার ভাবনা ছিল অন্য জায়গায়। যেহেতু অনেকগুলো মামলা এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে, এসবের মধ্যে যদি সত্যিই তেমন কোনো দুর্বলতা থাকে, সেসব কীভাবে কতটা কাটিয়ে উঠতে পারব তা নিয়ে। যাহোক, ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি হয়। আমিও প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পাই ২০ ফেব্রুয়ারি। এভাবেই রাজপথের একজন আন্দোলনকারী থেকে, একজন গবেষক থেকে, আইনের শিক্ষক থেকে মূল প্রসিকিউশনে সম্পৃক্ত হই।
কিন্তু এমন একটা সময়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হলাম যখন কাদের মোল্লার রায় নিয়ে সারাদেশে অসন্তোষ বিরাজ করছে। গণমানুষের প্রত্যাশা পূরণের দিকটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। মামলাগুলো সঠিকভাবে পরিচালনা করার চ্যালেঞ্জ তো ছিলই। আমার নিয়োগে তাই মোটেও স্বাগত জানানো হয়নি। কারণ, কাদের মোল্লার রায়ের ক্ষেত্রে চারদিকে সমালোচনা চলছিল যে, প্রসিকিউশনের দুর্বলতার কারণেই এমন বিপর্যয় ঘটেছে। এমন প্রেক্ষাপটে আমার নিয়োগের অর্থ হল, আমাকে সেসব দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হবে।
সে ক্ষেত্রে যাদের সঙ্গে কাজ করব, যারা আমার সহকর্মী, তাদের অনেকেই আমাকে সহজভাবে নিতে পারেননি। এমনও ভেবেছি যে সরে দাঁড়াব। কিন্তু তখনও একাত্তরের কাছেই অনুপ্রেরণা পেয়েছি। একাত্তরেও তো নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করেই আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছে। আমাকেও পিছু হটলে চলবে না। লড়াই করে জয়ী হতে হবে। কাজের মধ্য দিয়েই আমাকে সবার আস্থা অর্জন করতে হবে।
পরে যখন একে একে সব মামলা আমরা সঠিকভাবে পরিচালনা করতে থাকি, তখন সহকর্মীরাও আস্তে আস্তে আমার ওপর আস্থা রাখতে শুরু করেন।
প্রসিকিউটরদের মধ্যেও মতভিন্নতা ছিল। মতভিন্নতা কোথায় নেই বলুন? এক পরিবারের সদস্যদেরও তো ভিন্ন ভিন্ন মত থাকে। প্রসিকিউটররা একেক জন একেক ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছেন। তাদের মধ্যে মতানৈক্য থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু দেখতে হবে এসব সত্ত্বেও আমরা এই বিচার এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছি কি না। আমাদের ব্যক্তিগত আচার, আচরণ নিয়ে মতপার্থক্য থাকতেই পারে। তা নিয়ে সমালোচনাও হতে পারে। কিন্তু আমরা যখন মামলা মোকাবেলা করছি, তখন শতভাগ পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েই কাজ করেছি। কাজের ক্ষেত্রে আমরা যদি একমত হতে না পারতাম তাহলে মতিউর রহমান নিজামীর রায়ের ফলাফল এমন না-ও হতে পারত। সুতরাং ব্যক্তিগত বিভাজন বা সমালোচনা আমাদের মূল কাজে প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করি না। আমরা যথাযথভাবে টিমওয়ার্ক করতে পেরেছি, পারছি।
এটাও ঠিক, যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হয়ে অনেকের বিরাগভাজন হয়েছি। জামায়াতে ইসলামীর হুমকি-ধামকি পেয়েছি। আমাকে তুলে নেবে, আমার বাচ্চাকে তুলে নেবে, এসব। বাসায় কাফনের কাপড় পাঠানো হয়েছে, উড়ো চিঠি এসেছে। ককটেল মারা হল বাসায়। টেলিফোনে নানা বাজে কথা, মোবাইলে এসএমএস পাঠানো এসব তো আছেই। এসব হুমকিতে মোটেই দমে যাইনি। সাহস নিয়ে লড়াই করেছি। তবে সন্তানের ওপর হুমকি এলে মা হিসেবে স্বাভাবিকভাবে আমার মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হয়। পাশাপাশি এ কথা সত্যি যে, কারও কারও শত্রু হলেও বন্ধু পেয়েছি অনেক। পাশে দাঁড়িয়েছেন বহুজন।
মামলা চালাতে গিয়ে আরও নানা চ্যালেঞ্জ ছিল। প্রতিটি মামলা নিয়ে দেশে-বিদেশে খবর বেরুচ্ছে। সমালোচনা হয়েছে, হচ্ছে। সেখানে কিন্তু নিজেরাই নিজেদের কাজের মানোন্নয়নের প্রশ্নটি এসে যায়। কীভাবে আরও ভালো করা যায় সেসব খতিয়ে দেখতে হয়েছে। নতুন নতুন জুরিসপ্রুডেন্স আমার আইনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছি। যেমন, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড পৃথিবীর আর কোথাও নেই। সেটি সঠিকভাবে সম্পৃক্ত করেছি। প্রথমে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির কনসেপ্টে বসানো হল। তারপর এটি মামলাতে আনলাম। জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজ জুরিসপ্রুডেন্সের আলোকে আমাদের আইনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হল। এ রকম বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ একেক সময় নিয়েছি।
আগামীতে প্রথম চার্জ আনতে যাচ্ছি ওয়ার ক্রাইমের উপর কিশোরগঞ্জের একটি মামলায়; এ পর্যন্ত এই ট্রাইবুনালে ওয়ার ক্রাইমের কোনো চার্জ আনা হয়নি। তারপর জেনোসাইডাল রেপ, ভায়োলেশন অন জেনেভা কনভেনশন সামনে নিয়ে আসছি। এসবই চ্যালেঞ্জ, যা আমি আমার দিকেই ছুঁড়ে দিই।
সব সময় চেষ্টা করি, আমাদের জুরিসপ্রুডেন্স যেন আরও উন্নত হয়, আন্তর্জাতিক মানের সব কিছু যেন এখানটাতে থাকে। আমাদের আইনগুলো পড়ে একশ বছর পরেও যেন কেউ বলে, এই বিচার অনেক উন্নতমানের ছিল।
প্রসিকিউশনের দুর্বলতা নিয়ে নানা সময়ে নানা কথাবার্তা উঠছে। আমি বলব, প্রসিকিউশনের সীমাবদ্ধতা যে একেবারে নেই তা নয়। যেমন, তাদের ভালো কোনো রিসার্চ সেন্টার নেই, সমৃদ্ধ লাইব্রেরি নেই, দরকারি অনেক বইয়েরও অনুপস্থিতি চোখে পড়ে।। তা সত্ত্বেও আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। নুর্যেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল যখন কাজ শুরু করে, তাদেরও অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। আমাদের এত সমস্যা, নানা প্রতিকূলতা এবং রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করতে পেরেছি, এটা আমার বিবেচনায় গোটা পৃথিবীর জন্য একটা বিরাট ইতিবাচক দৃষ্টান্ত।
যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়ার আন্তর্জাতিক মান নিয়ে প্রথমদিকে যতটা সমালোচনা হয়েছে, এখন কিন্তু তা নেই। সেই সমালোচকদের মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। যুদ্ধাপরাধ-বিষয়ক বিশেষ মার্কিন দূত স্টিফেন জে র্যাপও ঢাকায় এসে বলেছেন, আমাদের বিচার আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন। বিচারকরা অনেক ভালো কাজ করছেন। সবচেয়ে বড় কথা, সত্য আমাদের পক্ষে। সুতরাং আমরা যদি যথাযথ শ্রম দিই, আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করি, জয় আমাদের হবেই।
ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল থেকে শুরু করে হেগের জাতিসংঘের ট্রাইব্যুনাল ইত্যাদির চেয়ে আমাদের ট্রাইব্যুনালের আলাদা বিশেষত্ব রয়েছে। ওই সব আদালতের সঙ্গে আমাদের ট্রাইব্যুনালের কাঠামোগত পার্থক্য হল, আমাদেরটা ডমেস্টিক, দেশীয় আইনে বিচার হচ্ছে এখানে।
আর গুণগত দিক দিয়ে বলব, আমাদের বিচারিক প্রক্রিয়া অন্য যে কোনো যুদ্ধাপরাধ আদালতের বিচারের চেয়ে অনেক মানসম্পন্ন। এর যথেষ্ট কারণও আছে। প্রথমত, আমাদের বিচার শুরু হয়েছে অপরাধ সংঘটনের চল্লিশ বছর পর। সুতরাং এ সংক্রান্ত অনেক তথ্য-উপাত্ত হারিয়ে গেছে। প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া অনেক দুষ্কর। সে সব কারণে এই বিচার আসলে অসম্ভব সম্ভব করে তোলার মতো ব্যাপার। নানা সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও আমরা কিন্তু আন্তর্জাতিক আইনকে ইনকর্পোরেট করেছি। আন্তর্জাতিক আদালতগুলোতে বিভিন্ন দেশের বড় বড় বিশেষজ্ঞদের বিচারিক কাজে যুক্ত করা হয়। তা সত্ত্বেও অনেক আদালতই কিন্তু সেভাবে বিচারকাজ এগিয়ে নিতে পারছে না। কম্বোডিয়া, সিয়েরালিয়ন ইত্যাদি দেশের বিচার শুরু হতেই বছরের পর বছর সময় লেগেছে। যেখানে কম্বোডিয়ার প্রথম মামলার কাজ শুরু করতে ১০ বছর লেগেছে, আমরা ছয় বছরে ২০টি মামলার রায় এনেছি। সে দিক থেকেও আমাদের অর্জন অনেক বড়।
তারপর দেখুন, আমরা কত মানবিক। বিশ্বের কোথাও যুদ্ধাপরাধের বিচারে জামিন দেওয়া হয় না। আমরা কিন্তু বয়সের বিবেচনায় জামিন দিচ্ছি। ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে কিন্তু আপিলের সুযোগ ছিল না। আমাদের এখানে আছে। আছে শুধু নয়, দেশের সর্বোচ্চ আদালতে আপিলের সুযোগ আছে; এমনকি আপিল বিভাগের রায় রিভিউয়েরও সুযোগ রাখা হয়েছে। আরেকটি কথা, গোলাম আযমের মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত বলেই আমরা মনে করি। কিন্তু আদালত তার বয়স এবং স্বাস্থ্য বিবেচনায় যাবজ্জীবন দিয়েছেন।
যেসব চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী পলাতক রয়েছে, দেশের বাইরে রয়েছে, তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। এটা আসলে সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়। কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে আইন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কূটনৈতিক দৌড়ঝাঁপ শুরু করলে এর একটা সুরাহা হতে পারে।
অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি মামলার রায় হয়েছে। কয়েকটির রায় কার্যকর হয়েছে। অনেকগুলোর বিচারকাজ চলছে। এ প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আজ আমার অনুভূতি হল, এতে জীবন বিপন্ন হতে পারে সত্যি; কিন্তু আমার মৃত্যু মানে কি চেতনারও মৃত্যু? অবশ্যই নয়।
আমার কাজকেই আমি একাত্তর মনে করি। হ্যাঁ, কাজই আমার একাত্তর।
From: Sitangshu Guha <guhasb@gmail.com>
To: Khobor <khabor@yahoogroups.com>; mokto mona <mukto-mona@yahoogroups.com>
Sent: Tuesday, March 29, 2016 10:34 PM
Subject: Pleas read