লড়াই শেষ হয়নি
মামুনুর রশীদ
একজন নজরুল ভক্ত অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিলেন, নজরুল অবহেলিত। জাতীয় কবির মর্যাদা পেলেও যথার্থ সম্মান তাঁকে দেওয়া হয়নি। আজও দেওয়া হচ্ছে না।
কথাটা তিনি বলেছিলেন অনেক আগে। তারপর ধানমণ্ডিতে নজরুল ইনস্টিটিউটের মতো স্থাপনা দেখেছি, রাস্তায় নামফলক দেখেছি। নজরুলের নামে বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। কিছু বইপুস্তকের প্রকাশনাও চোখে পড়েছে। আবার পশ্চিমবঙ্গে বড় একটা নজরুল মঞ্চ হয়েছে, বিশাল রাস্তার নামকরণ হয়েছে কাজী নজরুল সরণি। মিডিয়ায়ও নজরুলজয়ন্তী পালিত হয়, রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও হয়। তার পরও ওই নজরুল ভক্ত কেন বললেন নজরুল অবহেলিত! অনেক ভেবে একটা সূত্র বের করার চেষ্টা করি। সূত্রটা খুব সূক্ষ্মও নয়। সেটি হলো নজরুলচর্চা। নজরুল কি গণমানুষ যথার্থ চর্চা করেছেন? অথবা চর্চার পরিস্থিতি সৃষ্টি করা গেছে?
নজরুল অবহেলিত হবে। কারণ তিনি নির্যাতিতের কবি, সর্বহারার প্রতিনিধি। মধ্যবিত্তের বা উচ্চবিত্তের যে অংশ রাষ্ট্র চালায় তাদের কাছে নজরুল তো ভয়ংকর। কিন্তু একদা মধ্যবিত্ত বিদ্বজ্জনের কাছে নজরুল ছিল এক অভাবনীয় সম্পদ। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, সেই সময়কার বা পরের কবিদের মধ্যেও তাঁর প্রবল প্রভাব। এমনকি প্রেম ও প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশও নজরুলের কবিতার অনুকরণ করতেন। নজরুল বিদ্রোহী। বিদ্রোহ ছিল তাঁর সর্বগ্রাসী। দারিদ্র্য, অসাম্য, বিদেশি শাসন-শোষণ, বর্ণবাদ, ধর্মের অসৎ ব্যবহার,সাম্প্রদায়িকতা এ সবকিছুর বিরুদ্ধে। উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধেও তিনি বলেছেন। এসবের জন্য শিল্পের প্রায় সব মাধ্যমকে বেছে নিয়েছেন। গান, কবিতা, উপন্যাস, নাটক, চলচ্চিত্র, প্রবন্ধ—সবকিছু লিখেই তিনি ক্ষান্ত নন। গান লিখেছেন সুর দিয়েছেন, গেয়েছেন। নাটক, চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। নাটকে উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে তাঁরও গান রয়েছে। প্রচলিত ভারতীয় উচ্চাঙ্গসংগীতের মধ্যে তিনি নতুন রাগ সৃষ্টি করেছেন। সভা, সমিতি, অনশন করেছেন। দারুণ সব বক্তৃতা দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত জেল খেটেছেন। ভাগ্যিস, তাঁর মেসসঙ্গী কমরেড মুজাফফর আহমেদ নজরুলের অনুরোধ সত্ত্বেও কমিউনিস্ট পার্টিতে সদস্যপদ দেননি। কমরেড মুজাফফর আহমেদ জানতেন, পার্টির সদস্য মানেই পার্টির নিয়ন্ত্রিত বিদ্রোহ। প্রেমিক হিসেবেও তিনি নন্দিত। সে সময় তাঁর প্রতিটি গান আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। নজরুলের কালে যেসব বিষয় নিয়ে তিনি লড়েছেন, সে লড়াই কি শেষ হয়েছে?
ধর্ম এখন বহুগুণে সাম্প্রদায়িকতার আগুন ঝরাচ্ছে, জাতিকে বিভক্ত করছে। এ শুধু উপমহাদেশই নয়, সারা বিশ্বেই এক নৃশংসতার রূপ নিচ্ছে। তাঁর লেখা শাতিল আরবের মরুভূমি আজ একই ধর্মবিশ্বাসীদের জন্যই রণক্ষেত্র। হিন্দুত্ববাদ ও তার বর্ণবাদী চরিত্র একটুও বদলায়নি; বরং বহুগুণে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠেছে।
নজরুলের গান বৈচিত্র্যে ভরপুর। ভারতীয় উচ্চাঙ্গসংগীতের চর্চা যেমন করেছেন তাঁর গানে, আবার সহজ-সরল সুরের আধুনিক গানও আছে সেখানে। সংগীতের শিক্ষার্থীদের কাছে নজরুলগীতি যেকোনো শিল্পীর বিকাশে একটা কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে। নজরুলের কাব্যে যেমন বিদ্রোহ আছে তেমনি আছে প্রকৃতি প্রেম। হাজারো ফুলের, নদীর, আকাশের, মেঘের, পাহাড়ের উপমা আছে। হয়তো জীবনানন্দ দাশ সে কারণেই প্রভাবিত হয়েছিলেন। শিশুদের জন্যও নজরুল খুবই উপযোগী। কত গান, কত পদ্য তিনি রচনা করেছেন। নজরুলের সৃজনশীল জীবন একেবারেই স্বল্পকালের। তার মধ্যেও তিনি মৃত্যুক্ষুধার মতো বড় উপন্যাস লিখেছেন। লিখেছেন ছোটগল্প, শিশুতোষ রচনা। বৃহত্তর গণজীবনের জন্য তিনি লিখেছেন অনেক লেটো গান। এই লেটো গানগুলো একেবারেই গ্রামীণ কৃষক ও খেটে খাওয়া মানুষের জন্য। তিনি নিজেও লেটো দলে গান গাইতেন। তাঁর লেখা লেটো গানগুলো আমাদের চর্চার মধ্যেই এলো না। যাকে দিয়ে শুরু করেছিলাম সেই নজরুল ভক্ত আরো ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে চারদিকে যা চলছে, নজরুল সেখানে কত বড় অবহেলিত ভেবে দেখুন। তখন রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত বর্ষের ডামাডোল চলছে। ডামাডোল আর চর্চা যে এক জিনিস নয়, তা ওই ভক্তকে বোঝানোর চেষ্টা করি। রবীন্দ্রচর্চা আর ড্রইংরুমে রবীন্দ্র রচনাবলির সব কটি খণ্ড সাজিয়ে রাখা কি এক? কেউ কেউ তো নজরুল রচনাবলিও তাকে তাকে সাজিয়ে রাখেন, তাতে কি চর্চাটি প্রমাণিত হয়?
রবীন্দ্রনাথের বাণী যদি সঠিকভাবে পৌঁছাত, তাহলে শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত কি ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের মধ্যে ঢুকে যেতে পারত? পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূলে কি বোমা হামলা হতো? কাজেই রবীন্দ্রচর্চা খুব ভালোভাবে হচ্ছে, এটাও যেমন ঠিক নয়, তেমনি নজরুলচর্চার বিষয়টিও তাই।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এমন কোনো সংস্কৃতির জন্ম দিতে পারছে না, যে সংস্কৃতিচর্চা সমৃদ্ধ। একেবারেই জীবিকাশ্রয়ী শিক্ষাব্যবস্থার কারণেই কোনো উন্নত মানবিক সংস্কৃতির পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে না।
নজরুলকে জাতীয় কবি করা হলো, গান-স্যালুটে রাষ্ট্রীয় সম্মান দিয়ে সমাহিত করা হলো, রাস্তার নামকরণ হলো, বছর বছর নজরুলজয়ন্তী পালন করা হবে, তাতে কি বাঙালির জীবনে নজরুলকে নিয়ে ভাবার বা চিন্তা করার কোনো কারণ সৃষ্টি হবে?
যদি সৃষ্টি হয়, তবেই নজরুল বাঁচবে, সমাজ বাঁচবে।
লেখক : নাট্যজন
http://www.kalerkantho.com/print-edition/sub-editorial/2017/05/25/501133
বৃহস্পতিবার । ২৫ মে ২০১৭ । ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৪। ২৮ শাবান ১৪৩৮।
যাক না সে জাত জাহান্নামে, রইবে মানুষ নাই পরোয়া ...
__._,_.___