রবিবার, ১ ডিসেম্বর ২০১৩, ১৭ অগ্রহায়ন ১৪২
সবাই কেন খালেদাকে প্যাম্পার করে!
মমতাজ লতিফ
এ কথা তো বার বার আলোচিত হয়েছে যে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে খালেদা জিয়া কখনই সংঘর্ষ, লাশের মিছিল ছাড়া, তা-ব সৃষ্টি, হিন্দু-আওয়ামী লীগার নির্যাতন-খুন ছাড়া এবং জনগণেনর জীবনে অসম্ভব রকম সমস্যার সৃষ্টি না করে কোন নির্বাজনকে সংঘটিত হতে দিয়েছে! কেন এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি তিনি বার বার করেন তার কিছু কারণ মিডিয়া, এক শ্রেণীর বৃদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকের তৈরি, যেমন-
১. তিনি কখনও কোন চরম অন্যায়, চরম স্বৈরাচারী আচরণ, অভাবনীয়, অদৃষ্টপূর্ব অমানবিক পন্থায় ভিন্নমতাবলম্বী রাজনীতিক, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী এবং আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক হিসেবে গণ্য হিন্দুদের ওপর চরম নির্যাতন চালিয়েও কখনও কোন রকমের বিচার ও দ-ের সম্মুখীন হয়নি! এমন কি কঠোর সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রতিবেদন সমালোচনা থেকেও অব্যাহতি পেয়েছেন!
২. তিনি ক্ষমতা লাভ না করলেও সংসদে জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাঁর যে দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে, বিরোধীদলের নেত্রী হিসেবে দেশের ও জাতির মঙ্গলের জন্য জাতীয় স্বার্থগুলোতে সরকারকে অন্যান্য দেশের সংসদের বিরোধী দলের নেতার মতো পূর্ণ সহযোগিতা প্রদানের যে কথা, তা তিনি জানেন না, জানলেও এটি গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অবশ্যমান্য রীতি বলে তিনি মানেন না, মানার জন্য তাঁর মনে কোন তাগিদ আছে তার প্রমাণও কখনও দেননি!
৩. একদল মিডিয়া দীর্ঘদিন যাবত তাকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছে, যার ফলাফল হলো এই যে সাদামাটা সেনাস্ত্রী ভারি মেকাপ, রঙিন সাজপোশাক ব্যবহার করে একটি 'মডেল'-এর রূপ গ্রহণ করলেন, যেটি মিডিয়া দ্বারা কাক্সিক্ষত ও তৈরি! এরই সঙ্গে মিডিয়াই তাঁর মধ্যে এই বোধ তৈরি করেছে যে তিনি যা কিছ্ইু করেন তা আওয়ামী নেত্রীর চাইতে মন্দ নয়, বরং সমান সমান!
৪. স্মরণ করুন পাঠক, বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীনতার পর পর দেশ পুনর্গঠন, কোটি দেশত্যাগী সর্বস্বহারাদের পুনর্বাসন, দেশকে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে ব্যস্ত, '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেফতার ও বিচার পরিচালনা করছিলেন, তখন একদল বাঙালী তাঁকে শূলে ছড়িয়েছেন! অপরদিকে জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণ করামাত্র সব যুদ্ধাপরাধীকে মুক্তি দিয়ে দ- মওকুফ করে, বঙ্গবন্ধুর খুনীদের তাঁর কাক্সিক্ষত কাজ সম্পাদন করার জন্য পুরস্কৃত করে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তিযোদ্ধার ওপরে স্থান দিয়ে, ৩/৪ হাজার সেনা মুক্তিযোদ্ধাকে গোপনে ফাঁসি দিয়ে হয়ে ওঠে 'হিরো','মুক্তি যোদ্ধা প্রেসিডেন্ট।' সব দোষে দোষী হন বঙ্গবন্ধু!
৫. এই দেশপ্রেমহীন মিডিয়াগোষ্ঠী কোন একাধিক বিদেশেী স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথে স্থায়ী বাধা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে মানবিকতা, ন্যায়-নীতির প্রতি অনুভূতিহীন, গণতন্ত্রকে যেনতেন উপায়ে ক্ষমতা দখলের পন্থায় পরিণত করার যথার্থ এক নেত্রীর জন্ম দেয়, যিনি বর্তমানে জাতির দেহে দীর্ঘকাল যাবত অবস্থান করে 'এ্যান্টিবডি'তে পরিণত হয়েছেন। যার নির্মূলের চিকিৎসা সুকঠিন!
৬. ঐ মিডিয়া সুকৌশলে এই স্বৈরাচারী মহিলাকে সারাজীবন জনমানুষের ভাত ও ভোটের জন্য লড়াইরত বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার পাশাপাশি জাতির কাছে সমান সমান গণ্য করার কাজে 'দুই নেত্রী' সমান দোষে দোষী, দেশের রাজনীতি 'দুই নেত্রীর' একে অপরের প্রতি বিদ্বেষের কারণে ধ্বংসাত্মক পথে চলেছেÑ এইসব চরম মিথ্যা প্রচার চালিয়ে খালেদাকে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে! উল্টোদিকে শেখ হাসিনাকে তার প্রাপ্য স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত রেখেছে!
৭. পাঠক, খেয়াল করুন, এই মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীদল দু'টি দলের সম্পূর্ণ বিপরীত আদর্শÑ বিএনপির যুদ্ধাপরাধী জামায়াত- জঙ্গী পন্থী রাজনীতির উত্থানই হয়েছিল যুদ্ধাপরাধীদের বঙ্গবন্ধু কর্তৃক সূচিত বিচার ও দ- থেকে রক্ষা করার জন্য, সেখানে আওয়ামী লীগের জন্ম, বলা চলে '৭১-দলটির দ্বিতীয় জন্ম হয় যখন দলটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ও দেশে অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণে নেতৃত্ব দেয়। রাষ্ট্রের জন্মের বিপরীত স্রোতের রাজনীতিই যে দেশে অস্থিতিশীলতার মূল কারণ সেই তথ্য গোপন রেখে বিএনপি নেত্রীর যুদ্ধাপরাধীবান্ধব রাজনীতিকেও লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখার লক্ষ্যে তার মিত্রদল ও নিজ দলের দ্বারা সংঘটিত পুরো ধ্বংসযজ্ঞ, হত্যা, অগ্নিসংযোগকে 'দুই নেত্রীর' ব্যক্তিগত রেষারেষি হিসেবে অথবা দুই বড় দলের হানাহানি হিসেবে উপস্থাপন করে প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ দল ও নেত্রীকে জনগণের কাছে হেয়, বিনাদোষে দোষী সাব্যস্ত করছে!
এই কূটকৌশলে দেশী-বিদেশী শক্তি সম্পৃক্ত আছেÑএর অনেক প্রমাণ নানাভাবে প্রকাশিতও হয়েছে!
৮. পাঠক আরও স্মরণ করুন, বিডিআর বিদ্রোহের সময় পত্রিকাসূত্রে জানা গিয়েছিল, বিদ্রোহী বিডিআর নেতার মোবাইলে 'ডু নট সারেন্ডার'-এ কথাটি বার বার এসেছিল যখন সদ্য দায়িত্বগ্রহণ করা প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে তাদের আত্মসর্ম্পণের জন্য বলা হচ্ছিল! এই নির্দেশকে দিচ্ছিল? এ নির্দেশ কে, কি উদ্দেশ্যে দিচ্ছিল? তারপর একজন বড় জামায়াত নেতাকে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে যাতায়াত করতে বা দেখা গেল কেনÑ সব মিলিয়ে এটি যে একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ছিল, তাকি বোঝা যায় না! তারপরও বিডিয়ার বিদ্রোহের বিচার হলেও নেপথ্যের কলাকুশলীদের অনুসন্ধানের বিচার হয়নি! বিচারে সেনা কর্মকর্তা খুনের শাস্তি ফাঁসি হবার পর পর 'হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচ্' বিচার সুষ্ঠু হয়নি বলে দ্রুত মন্তব্য করেছে! অথচ বর্তমানে যখন তাদের পশ্চিমা দেশের নিয়মেই নির্বাচন হবার ব্যবস্থা নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী তখন এর বিরদ্ধে বিএনপি- জামায়াত দেশ ধ্বংস, নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে মারছে, শত শত ট্রাক-বাস-ট্যক্সি ভাঙছে-পুড়ছে, শতাধিক নারী-পুরুষ-শিশু পুড়ে মারা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা- কর্মীদের পিটিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে, হিন্দুদের মন্দির বসত ভাঙ্গা হচ্ছে, ছাঁদাবাজি করে তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করছেÑতখন কিন্তু দেখা যাচ্ছে এই তথাকথিত 'হিউম্যান রাইটস্'-এর কর্মকর্তারা নীরব, নিশ্চুপ, থাকে! এরাই জামায়াতের টাকা খেয়ে 'যুদ্ধাপরাধের বিচার আন্তর্জাতিক মানের হচ্ছেনা' এবং এদের ফাঁসির দ-ের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছিল। স্মর্তব্য এরপর ৫ মে হেফাজত-জামাতকে দিয়ে যে বর্বর ধ্বংস যজ্ঞ খালেদা সংঘটিত করেছে তার জন্য বিচার দূরে থাক তিনি কি যথেষ্ট নিন্দিত হয়েছেন? এখন আসা যাক, সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে। সুশীল সমাজ কেন বার বার 'দুই নেত্রীর' সংলাপের কথা তোলেন তা আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে ভুল বলে মনে হয়। তাঁদের এ প্রসঙ্গে আবদুল জলিল ও আবদুল মান্নান ভুঁইয়ার দীর্ঘ সময় যাবত অশ্বডিম্ব প্রসবকারী সংলাপের কথা স্মরণ করতে অনুরোধ করব। একটি প্রশ্ন করব, জানি পৃথিবীর কঠিনতম সব সমস্যার সমাধান সংলাপেই হওয়া সম্ভব। কিন্তু যখন আমাদের রয়েছে ২০০৬-এর সেই 'নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার' গঠনের খালেদা দ্বারা অদৃষ্টপূর্ব এক পুতুল খেলার স্মৃতি, একজন প্রেসিডেন্ট ড. ইয়াজউদ্দিনের 'ইয়েসউদ্দীন'-এ পরিণত হবার কু-দৃষ্টান্ত, যখন সুলতানা কামাল, আকবর আলী খানসহ উপদেষ্টার দল খালেদা জিয়ার গোয়ার্তুমির কারণে কিছুদিন টানেলের ভেতর সামান্য আলো দেখেও অবশেষে পদত্যাগে বাধ্য হন, তখন জাতি বার বার হতাশ হয়েছে এবং অবশেষে ১/১১-এর রাতে সেনা সমর্থিত ড. ফখরুদ্দীন ক্ষমতা নিলেও দুর্নীতিবাজ তারেক গ্রেফতার হলে সত্যি বলতে জাতি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল!
জনগণ বিগত তিন মাসের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীকে, নির্বাচন কমিশনারদের, মন্ত্রীদের বার বার বলতে শুনেছেন নবেম্বরের ২/৩ তারিখের মধ্যে শিডিউল ঘোষণা করা হবে এবং জানুয়ারির মধ্যভাগে নির্বাচন হবে। আগেই বলেছি খালেদা জিয়া পুরো জাতির কাছ থেকে বড় বড় দোষ-পাপ করে যে পরিমাণ 'ইনডেমনিটি' বা আশকারা পেয়েছেন, সেই মিডিয়া-সুশীল সমাজের অন্যায্য, অনৈতিক, সীমাহীন আশকারাই তাঁকে আজ এই সব আইন-কানুনের উর্ধে থাকার এবং পুরো বিশ্বের গণতান্ত্রিক রীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর অবস্থানে যেতে সহায়তা করেছে বললে ভুল হবে কি? এটাকেই কথায় বলে ধরাকে সরা জ্ঞান করা। সুশীল সমাজের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস করায় কোন সমস্যা হতো না যদি না খালেদা '৯৬ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তাঁর দলীয় রাষ্ট্রপতির হাতে রেখে সেনাবাহিনীতে ক্যু সংগঠনের চেষ্টা করত! ধরা যাক, প্রস্তাব গৃহীত হবার পর খালেদা জিয়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দাবি করলেন, আইন মন্ত্রণালয় চাইলেন, তাহলে তাঁর দ্বারা নিযুক্ত তাঁর দলের মন্ত্রীরা যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল বাতিল করে দিল! য্দ্ধুাপরাধীদের (বিচারধীন) বিচার বন্ধ করে দিল! তখন কি হবে? বিশিষ্ট নাগরিকেরা এসব বিষয় নিশ্চয় ভেবে দেখেছেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকেও উক্ত সম্ভাবনার বিষয় সম্বন্ধে সতর্ক থাকতে অনুরোধ করর। কেননা বেহুলা-লক্ষীন্দরের লোহার বাসরেও তো বাসুকী ঢুকে পড়েছিল!
সুশীল সমাজকে বলতে চাই, শিডিউল ও নির্বাচনী তারিখ ঘোষণাতে সরকার ও নির্বাচন কমিশন বিএনপিকে অনেক সময় দিয়েছে।, বহুবার তাদের দলের মন্ত্রীদের নাম দিতে আহ্বান জানিয়েছে, সংলাপের নমুনা জাতিকে খালেদা খুব ভালভাবেই দিয়েছে! খালেদা কিন্তু সেই মুহূর্তের অপেক্ষায় আছেন যখন তিনি একদানে বাজি মাত করে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করে অট্টহাসি হাসবেন এবং স্বম্ভিত মুক্তিযোদ্ধারা, বিচারক, সাক্ষী, সরকার এবং জাতি অবাক বিস্ময়ে কি করবে তা ভেবে কূল পাচ্ছি না! এর মধ্যে তো মুক্তিযোদ্ধার দল ভেবে সিপিবিকে বর্তমানের এই মুক্তিযুদ্ধপক্ষও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী পক্ষের নির্বাচনটি যে জাতির জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা উপলব্ধি করে সর্বদলীয় সরকারের পক্ষে অবস্থান নেবে-এমন ভুল ভাবনার জন্য অনেকেই লজ্জিত হয়েছেন! কেননা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের বিএনপির পক্ষে অবস্থান গ্রহণে বিস্মিত ফোনকারীদের এক কোটি নাকি দু' কোটির উত্তরও দিতে পারিনি! এর ফলে খালেদা জিয়ার গর্বে বুক ফুলে ওঠার কথা কেননা তেঁতুল হুজুর, যুদ্ধাপরাধী, মৌলবাদী গংয়ের পাশে কম্যুনিস্টরাও তাঁকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করছে। হায়! গণজাগরণ মঞ্চ তাঁকে কি একটি যৌবনোচিত চারিত্র্য বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী একটি উচিত শিক্ষা দেবে না? যুদ্ধাপরাধী মিত্র খালেদা জিয়াকে তেঁতুল হুজুররা মিডিয়া বুদ্ধিজীবীর একাংশ আশকারা দিয়েছে ও দেবে, তাই বলে কম্যুনিসটরাও? জনগণ, শেষ ভরসা আপনারা, খালেদাকে আর আশকারা ও সুযোগ দেবেন না, যারা দিচ্ছে তাদের উপযুক্ত জবাব দিন।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক।
১. তিনি কখনও কোন চরম অন্যায়, চরম স্বৈরাচারী আচরণ, অভাবনীয়, অদৃষ্টপূর্ব অমানবিক পন্থায় ভিন্নমতাবলম্বী রাজনীতিক, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী এবং আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক হিসেবে গণ্য হিন্দুদের ওপর চরম নির্যাতন চালিয়েও কখনও কোন রকমের বিচার ও দ-ের সম্মুখীন হয়নি! এমন কি কঠোর সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রতিবেদন সমালোচনা থেকেও অব্যাহতি পেয়েছেন!
২. তিনি ক্ষমতা লাভ না করলেও সংসদে জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাঁর যে দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে, বিরোধীদলের নেত্রী হিসেবে দেশের ও জাতির মঙ্গলের জন্য জাতীয় স্বার্থগুলোতে সরকারকে অন্যান্য দেশের সংসদের বিরোধী দলের নেতার মতো পূর্ণ সহযোগিতা প্রদানের যে কথা, তা তিনি জানেন না, জানলেও এটি গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অবশ্যমান্য রীতি বলে তিনি মানেন না, মানার জন্য তাঁর মনে কোন তাগিদ আছে তার প্রমাণও কখনও দেননি!
৩. একদল মিডিয়া দীর্ঘদিন যাবত তাকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছে, যার ফলাফল হলো এই যে সাদামাটা সেনাস্ত্রী ভারি মেকাপ, রঙিন সাজপোশাক ব্যবহার করে একটি 'মডেল'-এর রূপ গ্রহণ করলেন, যেটি মিডিয়া দ্বারা কাক্সিক্ষত ও তৈরি! এরই সঙ্গে মিডিয়াই তাঁর মধ্যে এই বোধ তৈরি করেছে যে তিনি যা কিছ্ইু করেন তা আওয়ামী নেত্রীর চাইতে মন্দ নয়, বরং সমান সমান!
৪. স্মরণ করুন পাঠক, বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীনতার পর পর দেশ পুনর্গঠন, কোটি দেশত্যাগী সর্বস্বহারাদের পুনর্বাসন, দেশকে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে ব্যস্ত, '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেফতার ও বিচার পরিচালনা করছিলেন, তখন একদল বাঙালী তাঁকে শূলে ছড়িয়েছেন! অপরদিকে জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণ করামাত্র সব যুদ্ধাপরাধীকে মুক্তি দিয়ে দ- মওকুফ করে, বঙ্গবন্ধুর খুনীদের তাঁর কাক্সিক্ষত কাজ সম্পাদন করার জন্য পুরস্কৃত করে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তিযোদ্ধার ওপরে স্থান দিয়ে, ৩/৪ হাজার সেনা মুক্তিযোদ্ধাকে গোপনে ফাঁসি দিয়ে হয়ে ওঠে 'হিরো','মুক্তি যোদ্ধা প্রেসিডেন্ট।' সব দোষে দোষী হন বঙ্গবন্ধু!
৫. এই দেশপ্রেমহীন মিডিয়াগোষ্ঠী কোন একাধিক বিদেশেী স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথে স্থায়ী বাধা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে মানবিকতা, ন্যায়-নীতির প্রতি অনুভূতিহীন, গণতন্ত্রকে যেনতেন উপায়ে ক্ষমতা দখলের পন্থায় পরিণত করার যথার্থ এক নেত্রীর জন্ম দেয়, যিনি বর্তমানে জাতির দেহে দীর্ঘকাল যাবত অবস্থান করে 'এ্যান্টিবডি'তে পরিণত হয়েছেন। যার নির্মূলের চিকিৎসা সুকঠিন!
৬. ঐ মিডিয়া সুকৌশলে এই স্বৈরাচারী মহিলাকে সারাজীবন জনমানুষের ভাত ও ভোটের জন্য লড়াইরত বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার পাশাপাশি জাতির কাছে সমান সমান গণ্য করার কাজে 'দুই নেত্রী' সমান দোষে দোষী, দেশের রাজনীতি 'দুই নেত্রীর' একে অপরের প্রতি বিদ্বেষের কারণে ধ্বংসাত্মক পথে চলেছেÑ এইসব চরম মিথ্যা প্রচার চালিয়ে খালেদাকে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে! উল্টোদিকে শেখ হাসিনাকে তার প্রাপ্য স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত রেখেছে!
৭. পাঠক, খেয়াল করুন, এই মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীদল দু'টি দলের সম্পূর্ণ বিপরীত আদর্শÑ বিএনপির যুদ্ধাপরাধী জামায়াত- জঙ্গী পন্থী রাজনীতির উত্থানই হয়েছিল যুদ্ধাপরাধীদের বঙ্গবন্ধু কর্তৃক সূচিত বিচার ও দ- থেকে রক্ষা করার জন্য, সেখানে আওয়ামী লীগের জন্ম, বলা চলে '৭১-দলটির দ্বিতীয় জন্ম হয় যখন দলটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ও দেশে অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণে নেতৃত্ব দেয়। রাষ্ট্রের জন্মের বিপরীত স্রোতের রাজনীতিই যে দেশে অস্থিতিশীলতার মূল কারণ সেই তথ্য গোপন রেখে বিএনপি নেত্রীর যুদ্ধাপরাধীবান্ধব রাজনীতিকেও লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখার লক্ষ্যে তার মিত্রদল ও নিজ দলের দ্বারা সংঘটিত পুরো ধ্বংসযজ্ঞ, হত্যা, অগ্নিসংযোগকে 'দুই নেত্রীর' ব্যক্তিগত রেষারেষি হিসেবে অথবা দুই বড় দলের হানাহানি হিসেবে উপস্থাপন করে প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ দল ও নেত্রীকে জনগণের কাছে হেয়, বিনাদোষে দোষী সাব্যস্ত করছে!
এই কূটকৌশলে দেশী-বিদেশী শক্তি সম্পৃক্ত আছেÑএর অনেক প্রমাণ নানাভাবে প্রকাশিতও হয়েছে!
৮. পাঠক আরও স্মরণ করুন, বিডিআর বিদ্রোহের সময় পত্রিকাসূত্রে জানা গিয়েছিল, বিদ্রোহী বিডিআর নেতার মোবাইলে 'ডু নট সারেন্ডার'-এ কথাটি বার বার এসেছিল যখন সদ্য দায়িত্বগ্রহণ করা প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে তাদের আত্মসর্ম্পণের জন্য বলা হচ্ছিল! এই নির্দেশকে দিচ্ছিল? এ নির্দেশ কে, কি উদ্দেশ্যে দিচ্ছিল? তারপর একজন বড় জামায়াত নেতাকে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে যাতায়াত করতে বা দেখা গেল কেনÑ সব মিলিয়ে এটি যে একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ছিল, তাকি বোঝা যায় না! তারপরও বিডিয়ার বিদ্রোহের বিচার হলেও নেপথ্যের কলাকুশলীদের অনুসন্ধানের বিচার হয়নি! বিচারে সেনা কর্মকর্তা খুনের শাস্তি ফাঁসি হবার পর পর 'হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচ্' বিচার সুষ্ঠু হয়নি বলে দ্রুত মন্তব্য করেছে! অথচ বর্তমানে যখন তাদের পশ্চিমা দেশের নিয়মেই নির্বাচন হবার ব্যবস্থা নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী তখন এর বিরদ্ধে বিএনপি- জামায়াত দেশ ধ্বংস, নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে মারছে, শত শত ট্রাক-বাস-ট্যক্সি ভাঙছে-পুড়ছে, শতাধিক নারী-পুরুষ-শিশু পুড়ে মারা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা- কর্মীদের পিটিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে, হিন্দুদের মন্দির বসত ভাঙ্গা হচ্ছে, ছাঁদাবাজি করে তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করছেÑতখন কিন্তু দেখা যাচ্ছে এই তথাকথিত 'হিউম্যান রাইটস্'-এর কর্মকর্তারা নীরব, নিশ্চুপ, থাকে! এরাই জামায়াতের টাকা খেয়ে 'যুদ্ধাপরাধের বিচার আন্তর্জাতিক মানের হচ্ছেনা' এবং এদের ফাঁসির দ-ের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছিল। স্মর্তব্য এরপর ৫ মে হেফাজত-জামাতকে দিয়ে যে বর্বর ধ্বংস যজ্ঞ খালেদা সংঘটিত করেছে তার জন্য বিচার দূরে থাক তিনি কি যথেষ্ট নিন্দিত হয়েছেন? এখন আসা যাক, সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে। সুশীল সমাজ কেন বার বার 'দুই নেত্রীর' সংলাপের কথা তোলেন তা আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে ভুল বলে মনে হয়। তাঁদের এ প্রসঙ্গে আবদুল জলিল ও আবদুল মান্নান ভুঁইয়ার দীর্ঘ সময় যাবত অশ্বডিম্ব প্রসবকারী সংলাপের কথা স্মরণ করতে অনুরোধ করব। একটি প্রশ্ন করব, জানি পৃথিবীর কঠিনতম সব সমস্যার সমাধান সংলাপেই হওয়া সম্ভব। কিন্তু যখন আমাদের রয়েছে ২০০৬-এর সেই 'নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার' গঠনের খালেদা দ্বারা অদৃষ্টপূর্ব এক পুতুল খেলার স্মৃতি, একজন প্রেসিডেন্ট ড. ইয়াজউদ্দিনের 'ইয়েসউদ্দীন'-এ পরিণত হবার কু-দৃষ্টান্ত, যখন সুলতানা কামাল, আকবর আলী খানসহ উপদেষ্টার দল খালেদা জিয়ার গোয়ার্তুমির কারণে কিছুদিন টানেলের ভেতর সামান্য আলো দেখেও অবশেষে পদত্যাগে বাধ্য হন, তখন জাতি বার বার হতাশ হয়েছে এবং অবশেষে ১/১১-এর রাতে সেনা সমর্থিত ড. ফখরুদ্দীন ক্ষমতা নিলেও দুর্নীতিবাজ তারেক গ্রেফতার হলে সত্যি বলতে জাতি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল!
জনগণ বিগত তিন মাসের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীকে, নির্বাচন কমিশনারদের, মন্ত্রীদের বার বার বলতে শুনেছেন নবেম্বরের ২/৩ তারিখের মধ্যে শিডিউল ঘোষণা করা হবে এবং জানুয়ারির মধ্যভাগে নির্বাচন হবে। আগেই বলেছি খালেদা জিয়া পুরো জাতির কাছ থেকে বড় বড় দোষ-পাপ করে যে পরিমাণ 'ইনডেমনিটি' বা আশকারা পেয়েছেন, সেই মিডিয়া-সুশীল সমাজের অন্যায্য, অনৈতিক, সীমাহীন আশকারাই তাঁকে আজ এই সব আইন-কানুনের উর্ধে থাকার এবং পুরো বিশ্বের গণতান্ত্রিক রীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর অবস্থানে যেতে সহায়তা করেছে বললে ভুল হবে কি? এটাকেই কথায় বলে ধরাকে সরা জ্ঞান করা। সুশীল সমাজের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস করায় কোন সমস্যা হতো না যদি না খালেদা '৯৬ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তাঁর দলীয় রাষ্ট্রপতির হাতে রেখে সেনাবাহিনীতে ক্যু সংগঠনের চেষ্টা করত! ধরা যাক, প্রস্তাব গৃহীত হবার পর খালেদা জিয়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দাবি করলেন, আইন মন্ত্রণালয় চাইলেন, তাহলে তাঁর দ্বারা নিযুক্ত তাঁর দলের মন্ত্রীরা যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল বাতিল করে দিল! য্দ্ধুাপরাধীদের (বিচারধীন) বিচার বন্ধ করে দিল! তখন কি হবে? বিশিষ্ট নাগরিকেরা এসব বিষয় নিশ্চয় ভেবে দেখেছেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকেও উক্ত সম্ভাবনার বিষয় সম্বন্ধে সতর্ক থাকতে অনুরোধ করর। কেননা বেহুলা-লক্ষীন্দরের লোহার বাসরেও তো বাসুকী ঢুকে পড়েছিল!
সুশীল সমাজকে বলতে চাই, শিডিউল ও নির্বাচনী তারিখ ঘোষণাতে সরকার ও নির্বাচন কমিশন বিএনপিকে অনেক সময় দিয়েছে।, বহুবার তাদের দলের মন্ত্রীদের নাম দিতে আহ্বান জানিয়েছে, সংলাপের নমুনা জাতিকে খালেদা খুব ভালভাবেই দিয়েছে! খালেদা কিন্তু সেই মুহূর্তের অপেক্ষায় আছেন যখন তিনি একদানে বাজি মাত করে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করে অট্টহাসি হাসবেন এবং স্বম্ভিত মুক্তিযোদ্ধারা, বিচারক, সাক্ষী, সরকার এবং জাতি অবাক বিস্ময়ে কি করবে তা ভেবে কূল পাচ্ছি না! এর মধ্যে তো মুক্তিযোদ্ধার দল ভেবে সিপিবিকে বর্তমানের এই মুক্তিযুদ্ধপক্ষও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী পক্ষের নির্বাচনটি যে জাতির জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা উপলব্ধি করে সর্বদলীয় সরকারের পক্ষে অবস্থান নেবে-এমন ভুল ভাবনার জন্য অনেকেই লজ্জিত হয়েছেন! কেননা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের বিএনপির পক্ষে অবস্থান গ্রহণে বিস্মিত ফোনকারীদের এক কোটি নাকি দু' কোটির উত্তরও দিতে পারিনি! এর ফলে খালেদা জিয়ার গর্বে বুক ফুলে ওঠার কথা কেননা তেঁতুল হুজুর, যুদ্ধাপরাধী, মৌলবাদী গংয়ের পাশে কম্যুনিস্টরাও তাঁকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করছে। হায়! গণজাগরণ মঞ্চ তাঁকে কি একটি যৌবনোচিত চারিত্র্য বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী একটি উচিত শিক্ষা দেবে না? যুদ্ধাপরাধী মিত্র খালেদা জিয়াকে তেঁতুল হুজুররা মিডিয়া বুদ্ধিজীবীর একাংশ আশকারা দিয়েছে ও দেবে, তাই বলে কম্যুনিসটরাও? জনগণ, শেষ ভরসা আপনারা, খালেদাকে আর আশকারা ও সুযোগ দেবেন না, যারা দিচ্ছে তাদের উপযুক্ত জবাব দিন।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক।
রবিবার, ১ ডিসেম্বর ২০১৩, ১৭ অগ্রহায়ন ১৪ ২০
__._,_.___