বিগত কিছুদিন ধরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে তারা যা করছেন, তা আসলে দেশের সরকার এবং মানুষের বিরুদ্ধে এক ধরনের স্বল্পমাত্রায় গেরিলা যুদ্ধ। যারা নিরীহ-নিরপরাধ মানুষের জীবন হরণের জন্য এমন নিষ্ঠুর ধ্বংসযজ্ঞের অবতারণা করে তাদের মুখে গণতন্ত্র ও জনগণের কথা শোনা, আর ভূতের মুখে রাম নাম শোনা একই কথা। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা এই ধ্বংসযজ্ঞের ব্যাপারে বিএনপির শীর্ষ নেতা-নেত্রীদের কোন নিন্দা বা বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখা গেল না। তেমনি দেখা গেল না আহত-নিহতদের প্রতি সামান্য সমবেদনা জানাতে। গেল সোমবারের প্রেস ব্রিফিংয়ে উল্টো খালেদা জিয়াকে বলতে দেখা গেল, নাশকতা ও মানুষ পুড়িয়ে মারার জন্য সরকার দায়ী। এত গেল বিরোধী দলের চরম নিষ্ঠুরতা এবং নির্জলা মিথ্যাচারের কাহিনী। অন্যদিকে সরকারের ব্যাপারেও মানুষের অভিযোগ আছে। যে কোন সরকারের অন্যতম দায়িত্ব এবং কর্তব্য হলো নাগরিকের জীবন এবং সম্পদের নিরাপত্তা বিধান। চলমান এ মহাসন্ত্রাস দমনে তাদের প্রয়াস যথেষ্ট শক্তিশালী এবং কার্যকর মনে হচ্ছে না। কিছুদিন আগে আইনমন্ত্রী হরতাল নিষিদ্ধ করার বিষয়টি বিবেচনা করার কথা বলায় সাধারণ মানুষ আশান্বিত হয়েছিল। এরপর এ ব্যাপারে আর কোন উদ্যোগ বা অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। অথচ হরতাল-অবরোধ শুধু জীবন ও সম্পদ ধ্বংসকারী নয়, এগুলো নাগরিকের সাংবিধানিক এবং মানবিক অধিকারেরও পরিপন্থী, যা অবিলম্বে নিষিদ্ধ করার পক্ষে দেশের মানুষ।
দেশব্যাপী এ নাশকতা, নৃশংসতা, নৈরাজ্য এবং নরহত্যা করা হচ্ছে জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে, ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণের স্বাভাবিক জীবন বিপর্যস্ত করা এবং দেশব্যাপী ধ্বংসলীলা অনুষ্ঠানের অধিকার খালেদা জিয়া ও তার দলকে কেউ দেয়নি। অবরোধ এবং হত্যার মাধ্যমে তারা কি ধরনের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় তা আমাদের বোধগম্য নয়। তবে এটা সত্য যে, দেশে এখন পর্যন্ত একটি সঠিক নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি, যেমনটা প্রতিবেশী দেশ ভারতে গড়ে উঠেছে। কারণ দেশটির সাম্প্রতিক নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষের পরাজয় এবং বিরোধী দলের সিরিসেনার বিজয় তাই প্রমাণ করে। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা যা দেখছি, তা হলো একটি গুরুতর ত্রুটিপূর্ণ এবং দুর্বল নির্বাচনী ব্যবস্থা। সব সময়ই ক্ষমতাসীনরা নিজেদের স্বার্থে নির্বাচনী ব্যবস্থা সাজায়। শুধু নির্দলীয় নিরপেক্ষ লোকদের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোই সঠিক ও গ্রহণযোগ্য হয়। তবে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে দুর্বল এবং দলীয় স্বার্থে ব্যবহারের ব্যাপারে বিএনপির রেকর্ডের তুলনা হয় না। এর কয়েকটি উদাহরণ হলো মাগুরার কালো নির্বাচন এবং ঢাকা-১ এ ফালুর নির্বাচন। সর্বশেষ ২০০৬-এর শেষে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার আজিজ, বিচারপতি কেএম হাসান এবং সর্বশেষ রাষ্ট্রপতি ইয়াজুদ্দিনকে দিয়ে নির্বাচনের নামে যে মহাজালিয়াতির প্রচেষ্টা বিএনপি করেছিল, তা মানুষ ভুলে যাবে না।
এটাও বলা দরকার, একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিটি প্রথম আওয়ামী লীগের কাছ থেকেই আসে। সেটা সম্ভবত বিএনপি সরকারের সময়ে মাগুরার কালো নির্বাচনের কারণে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেই দাবিটি তোলা হয়। পরে এটা দেশবাসীরও ব্যাপক সমর্থন লাভ করে। তখন বিএনপির জবাব ছিল, পাগল এবং শিশু ছাড়া দেশে কেউ নিরপেক্ষ নয়। এখন সেই বিএনপিই অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চাচ্ছেন। এই যে ভোল পাল্টানো, সুবিধামতো সত্য এবং মিথ্যা এবং নির্বাচনকে শুধুমাত্র ক্ষমতায় আরোহণের জন্য একটি অস্থায়ী সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মনে বাসা বেঁধেছে, তা দীর্ঘ মেয়াদে দেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য আশাব্যঞ্জক নয়। নির্বাচনী ব্যবস্থাটিই যেখানে নড়বড়ে, সেখানে গণতন্ত্রের জন্য অত্যাবশ্যকীয় আইনের শাসন ও সুশাসন যে দুর্বল হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই নেতা-নেত্রীরা মুখে যতই গণতন্ত্রের কথা বলুক মানুষ তাতে আস্থা রাখতে পারে না। সম্প্রতি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের এক গবেষণায় তাই দেশের গণতন্ত্র নয়, দলতন্ত্রে বিকাশ হচ্ছে বলে দাবি করেছে। দেশে রাজনৈতিক অগ্রগতির বড় বাধা হচ্ছে একচ্ছত্র দলতন্ত্র বলেও তাদের অভিমত (প্রথম আলো ২০-১২-১৪)।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত একটি প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন বলা যাবে না। তাই বলা যাবে না সঠিকও। তবে যে নির্বাচনে সরকারি দলের প্রস্তাবিত ১০ জনের একটি নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারে অংশগ্রহণের প্রস্তাব বিএনপি নাকচ করে দিল কেন? অথবা জাতিসংঘের দূত তারানকোর সর্বশেষ সমঝোতা প্রস্তাবে রাজি হয়েও শুধু তারেকের আপত্তিতে তারা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াল কেন, সেটাও আমাদের বোধগম্য নয়। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার পর তাতে কারচুপি এবং জাল-জালিয়াতি ঘটে থাকলে, তা তারা জনগণের কাছে তুলে ধরতে পারত। ফলে তাদের প্রতি মানুষের সহানুভূতি এবং সমর্থন বাড়ত।
বক্ষমান নিবন্ধটি লেখার মধ্যেই আজ সন্ধ্যায় (১৯-১-৫) টিভিতে খালেদা জিয়ার প্রেস ব্রিফিংটি দেখলাম। তাতে দুটো বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় মনে হলো। এক. জেদ এবং দ্বিতীয় মিথ্যাচার। অবরোধ অব্যাহত রাখার ঘোষণা তার জেদের (ঔদ্ধত্য বলা যায়) বহিঃপ্রকাশ। আর এর সঙ্গে 'শান্তিপূর্ণ' শব্দটি যোগ করার মাধ্যমে তার ধোঁকাবাজি এবং মিথ্যাচারের প্রমাণও পাওয়া গেল। চলমান অবরোধ-হরতালে দেশবাসীর জীবনে যে মহাঅশান্তির সৃষ্টি হয়েছে তা যদি শান্তিপূর্ণ হয়, তাহলে অশান্তি এবং দুর্যোগ আমরা কাকে বলব? ২০১৩ সালে তাদের অবরোধ ও হরতালে ১৯৬ জন মানুষ প্রাণ হারায়। প্রায় হাজারখানেক যানবাহন ধ্বংস হয়। আর এবার সেই তথাকথিত শান্তিপূর্ণ অস্ত্রটি প্রয়োগের ফলে বিগত ১৪-১৫ দিনে ২৬ জন মানুষ মারা গেছে এবং ধ্বংস হয়েছে অসংখ্য যানবাহন। তাই 'শান্তিপূর্ণ' শব্দটি যোগ করে নির্দোষ এবং পবিত্রতার ভান করা হলো জনগণের সঙ্গে এক ধরনের নিষ্ঠুর কৌতুক মাত্র। উপরোক্ত প্রেস ব্রিফিংয়ের আরেকটি কৌতুক হলো চলমান নাশকতা এবং পুড়িয়ে মারার ঘটনাবলি সরকারের ষড়যন্ত্র'। মিথ্যাচার কাকে বলে!
এর মধ্যে ২৯ জানুয়ারি জিয়া অরফানেজও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের মামলার তারিখ। এ পর্যন্ত মামলার ৫১টি তারিখ পড়েছে। তার মধ্যে ৪৬ বার তিনি অনুপস্থিত থেকেছেন। নিরাপত্তার অভাব অথবা বিচারকের প্রতি অনাস্থার অজুহাতে এতবার অনুপস্থিতির ফলে বন্ধুদের কেউ কেউ মনে করে 'ডাল মে কুচ কাল হায়'। তার দুর্বলতা আছে। নিজের নৈতিক দুর্বলতা থাকলেই সৎসাহসের অভাব ঘটে। পরিশেষে বলতে হয়, মানুষের স্বাভাবিক জীবনকে বানচাল করে, মানুষ মেরে এবং সহিংসতার তা-ব সৃষ্টি করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। পৈশাচিক এ তা-বের কোন শেষ দেখা যাচ্ছে না। সারাদেশ এর নিন্দায় সোচ্চার। সেদিকে বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। রাজনীতি এবং গণতন্ত্রের নামে এ নব্য সন্ত্রাসবাদী শক্তি জয়ী হলে জাতির ভাগ্যে দুঃখ আছে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
__._,_.___