Dear all,
Regardless of your political preferences, mainstream Bangladeshi people are worried and concerned about the way minorities and low income group population are suffering from unstable political situation in Bangladesh. I saw an interesting article on this serious issue and wanted to share it with you.
Have to thank Prothom Alo for this outstanding reporting. Feel free to share your opinion on this reporting.
সাঁথিয়ার ঘটনায় গুন্ডা-বদমাশদের নাম যতটা আসে ততটা আসে না তাদের রিংমাস্টারদের নাম। হিন্দু সমাজের ঘরবাড়িতে যারা হামলে পড়েছিল, নিঃসন্দেহে তারা সমাজের সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব। কিন্তু তারা একা ছিল না। তাদের পায়ের ছাপ ধরে এগোলে যে 'উৎকৃষ্টদের' নামনিশানা পাওয়া যায়, তাঁরা আমাদের নেতা-অভিভাবক-প্রশাসক। এঁদের ছাড়া ওই নিকৃষ্টরা বড়জোর লুম্পেন-চাঁদাবাজি করে দিন কাটাত, হিন্দু পাড়া তছনছ করার 'হিরো' হতে পারত না।
রামু, সাঁথিয়া, বরিশালের 'সাম্প্রদায়িক' তাণ্ডবের কাহিনিতে আক্রমণকারী 'মুসলমান'। আক্রান্ত কখনো বৌদ্ধ কখনো হিন্দু। এ জন্যই একে সাম্প্রদায়িকতা বলা হচ্ছে। কিন্তু দলীয় পরিচয়ের হদিস নিলে দেখা যায় এক সর্বদলীয় সাম্প্রদায়িক ঐক্য, যার হেফাজতকারীরা বর্তমান সরকারের। ধর্মনিরপেক্ষ আর ধর্মবাদীরা একজোট করতে পারে কোনো বড় ষড়যন্ত্র অথবা অর্থ-সম্পত্তির লোভে। এখন তাই বলবার উপায় নেই কে অসাম্প্রদায়িক আর কে সাম্প্রদায়িক! প্রশ্ন হচ্ছে, এই হামলাগুলো কি ধর্মীয় কারণে ঘটছে? নাকি ঘটছে টাকা-ক্ষমতা-জমি বা ভোটের মতো বাস্তব স্বার্থের হাতছানিতে? ধর্মবিশ্বাসী পরকালের জন্য পুণ্য অর্জনে আগ্রহী, সাম্প্রদায়িকতাবাদীর লোভ ইহলোকের ক্ষমতা ও সম্পত্তি প্রতি। সাম্প্রদায়িকতার হিরোরা তাই খুব কমই ধর্মনিষ্ঠ হয়। এমনকি হামলার সামনের সারিতে যে বীরপুঙ্গবদের দেখি, বাস্তবে তারা তালপাতার সেপাই। যাকে মনে হচ্ছে মূল খলনায়ক, সে আরেক দিক থেকে হয়তো বিপর্যয়ের বার্তাবাহক। কীভাবে তুচ্ছ ঘটনা ও রটনা মহামারি ঘটাতে পারে, রামু ও সাঁথিয়া তা চোখে আঙুল দিয়েই দেখাল। কিন্তু তত্ত্বকথা আর ইতিহাস থেকে মুখ তুলে আমরা তা দেখতে কি রাজি?
নির্বাচনী রাজনীতির ফাঁদ: ফেসবুক পেজে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অবমাননায় উত্তেজিত মুসলিম জনতা হিন্দু ব্যবসায়ী বাবলু সাহার দোকান ও হিন্দু পাড়ায় আগ্রাসন চালায়; এটা বাইরের সত্য। ফেসবুকের সেই রটনা রটবার আরও আগে ঘটনার শুরু। বাবলু সাহার মেয়ের বিয়ে হয় কয়েক মাস আগে। তখন তাঁর কাছে কয়েক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে স্থানীয় চাঁদাবাজ ফজলু মিয়া। ইনি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী টুকু সাহেবের চ্যালা মিঠু প্রভৃতির মদদপুষ্ট। চাঁদা তাঁরা পান, তবে পরিমাণে কম। ব্যবসায়ীদের সব জায়গাতেই চাঁদা দিতে হয়, বনগ্রাম তার বাইরে নয়। ফজলু মিয়ার চাঁদার গ্রুপ সর্বদলীয়। এরা বাকি চাঁদার জন্য বাবলু সাহাকে বিপদে ফেলার ফন্দি করে।
বনগ্রামের হিন্দু সমাজের বিপদ আসছিল আরেক দিক থেকে। ১ নভেম্বর সাঁথিয়ায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর স্বদলীয় প্রতিদ্বন্দ্বী আবু সাইয়িদকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। গত নির্বাচনে শেখ হাসিনার অনুরোধে জনপ্রিয় সাইয়িদকে টুকুর কাছে আসন ছেড়ে দিতে হয়। আসন্ন নির্বাচনের লক্ষ্যে আবু সাইয়িদ নিজের প্রভাব বিস্তারে তৎপর ছিলেন। সংবর্ধনা সভা তারই অংশ। সেখানে হিন্দু পাড়া থেকে প্রায় ৩০০ মানুষ যান। প্রতিমন্ত্রী টুকুও সে সময় এলাকাতেই ছিলেন। অন্যদিকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিএনপি-সমর্থক পরাজিত প্রার্থী সেলিম ও উপজেলা চেয়ারম্যানেরও ক্ষোভ ছিল হিন্দুদের প্রতি। তাঁদের বিশ্বাস, হিন্দু পাড়ার ভোট তাঁদের বিপক্ষে। নির্বাচনী রাজনীতি এভাবে আগেভাগেই বনগ্রামের নিরীহ অধিবাসীদের ঝুঁকিতে রেখেছিল।
পরিকল্পনার আলামত: ঘটনার দিন ২ নভেম্বর। এর কিছু আগে বনগ্রামের দুই পাশের দুই গ্রামে দুটি বৈঠক হয়। বউলবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বৈঠকে নেতৃত্ব দেন সোহেল ও ফজলু। আর কুমিরগাড়ি পদ্মবিলে ছিলেন সেলিম মেম্বার। ঘটনার দিন বনগ্রাম বাজারে বিএনপিপন্থী সোহেলের দোকানে ১০-১২ জন জড়ো হয়। পরিকল্পনামাফিক তারা বেছে নেয় হাটের দিন, যখন ভিড়ের মধ্যে কেউ কাউকে চিনবে না। আশপাশের গ্রামের লোকজনের ব্যাপক উপস্থিতি ছিল সেখানে। অন্যদিকে হিন্দু পাড়ার পুরুষেরাও সবাই হাটে-কাজে বাইরে ছিল। হাট-বাজার সমাজ-বহির্ভূত এলাকা। এসব জায়গায় অজস্র মানুষকে সহজেই উত্তেজিত করা যায়। সোহেলের দোকান থেকেই একদল যায় ফেসবুকে ইসলাম অবমাননার প্রচারপত্র বিলির কাজে। একই সময় ছাত্রলীগের কাউসার হাবিব সুইট, ছাত্রশিবিরের জাকির মোটর সাইকেলে করে বাবলু সাহাকে তুলে আনতে যায়। সোহেলের দোকানেই তিনি বন্দী থাকেন। এর মধ্যে তাঁর দোকানের ক্যাশবাক্স লুট হয়, দাবি করা হয় আরও টাকা। তিনি দিতে ব্যর্থ হলেই শুরু হয় সর্বদলীয় সাম্প্রদায়িক জিগির। এই পটভূমিতে সর্বদলীয় লোকজন উত্তেজিত জনতাকে সঙ্গে নিয়ে লাঠিসোঁটাসহ হিন্দু পাড়ায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। যারা টাকা নিয়েছে তাদের সবাই হামলায় ছিল না, আবার যারা হামলায় জড়িত তাদের সবাই চাঁদাবাজির ঘটনাটা জানে না। এই গল্পে লীগ, দল, জামায়াতের পরিচয় তাদের আচরণ থেকে বোঝা সম্ভব নয়। তাই আলাদা করে কুশীলবদের পরিচয় জানতে হবে।
জলে কুমির ডাঙায় বাঘ: ঘটনার ১০ মিনিটের মধ্যে স্থানীয় পূজা উদ্যাপন কমিটির সভাপতি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী টুকুকে সাহায্য চেয়ে ফোন করে বিফল হন। এর ব্যাখ্যা তিনি নিজেই দেন পরে। বিপর্যস্ত গ্রামবাসীদের শাসান, 'কই, কোনো বাবুই (আবু সাইয়িদ) তো তোদের বাঁচাতে পারলো না'। হামলার চার দিন পর, বনগ্রাম বাজারে সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ সমাবেশ হয়। সরকারি আয়োজনে বিশেষ অতিথি থাকেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, দুর্যোগ ও ত্রাণমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এবং স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক। সভাপতিত্ব করেন স্থানীয় জেলা প্রশাসক। বক্তারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা এবং হিন্দু সমাজকে নিরাপত্তার আশ্বাস দেন। অথচ সেই সভাতেই মিঠুর মতো দাঙ্গাবাজরা উপস্থিত ছিল। টুকুর উপস্থিতিতেই মিঠুসহ তিনজনের নামে সুপারিশ করা হয়। তাতে বলা হয়, হিন্দু পাড়ায় আক্রমণের সঙ্গে এদের কোনো সম্পর্ক নেই। মিঠুর কাছের লোক ব্যবসায়ী কার্তিক সাহা সেই দরখাস্তে সই করেন, বাবলু সাহাকেও সই করতে বাধ্য করেন। ব্যবসার স্বার্থে কার্তিক সাহাকে ফজলু, মিঠু, পেনসু প্রভৃতি লীগাশ্রিত মাস্তানদের হাতে রাখতে হয়। বিনিময়ে তিনিও তাঁদের চাঁদা দেন। যে দলটিকে তাঁরা ভোট দেন বলে সকলে জানে, সেই দল পেছনে ছুরি মারলে, এলাকার মন্ত্রী হামলাকারীদের বগলে নিয়ে চলাফেরা করলে অসহায়ত্ব সীমা ছাড়তে বাধ্য। আক্রান্তরা জলে কুমির ডাঙায় বাঘ অবস্থায় পড়েন।
সুতরাং বিএনপিবিরোধী ভোটব্যাংক হিসেবে হিন্দুদের চিহ্নিত থাকা এবং আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের জাঁতাকলের মাঝখানে পড়ার সুযোগে সর্বদলীয় লুম্পেনরা একটি 'সাম্প্রদায়িক হামলা' সাজিয়ে ফেলল। এরা ফেউ, আসল বাঘ হলো ভূমিগ্রাসীরা। এ দেশের অর্থনীতিতে আদিম লুটপাটের জয়জয়কার। এর প্রধান লক্ষ্য হলো জমি। হিন্দু বা আদিবাসী জমি যেখানে সবচেয়ে অরক্ষিত; সেখানে জমি দখলের 'সাম্প্রদায়িকতা' ঠেকানোটাই জরুরি। অর্পিত সম্পত্তি আইনের সকল ধারা বাতিল করে প্রয়োজনে 'মাইনরিটি কমিশন' গঠন করতে হবে। বুদ্ধিজীবীদের সেমিনার আর দুর্গত এলাকা পরিদর্শনে আত্মতৃপ্তির সুযোগ আছে। কিন্তু বাস্তব প্রতিরোধ, বিচার বিভাগীয় নিরপেক্ষ তদন্ত এবং আইনি কমিশন ছাড়া এ অসুখের কোনো ওষুধ নেই।
মুসলিম প্রতিবেশী ও জাতীয় সমাজ: নিতাই (ছদ্মনাম) পেশায় নরসুন্দর। বৃদ্ধা বিষ্ণুপ্রিয়া বৈষ্ণব। সরকার ফার্মেসির যুবক ও তাদের বাড়ির বাসিন্দাসহ এ রকম অনেকেই সেদিন আশ্রয় পেয়েছিলেন প্রতিবেশী মুসলমানদের বাড়িতে। বাবলু সাহার গুদাম যারা বাঁচান তারাও মুসলমান। নিতাইয়ের বাড়ির মেয়েরা আশ্রয় নিয়েছিল প্রতিবেশী জয়নাল মুহুরির বাড়িতে। প্রায় সব হিন্দু পরিবারের মেয়েদের এটাই আত্মরক্ষার গল্প সেদিনের। মুহুরি ভদ্রলোকটির চেহারায় পরহেজগার; অথচ তাঁর মতো মুসলিমদের সামনেই তাঁকে বুক চিতিয়ে বলতে হয়েছিল, 'বাড়িতে ঢুকতে হলে আমাকে মেরে ঢুকতে হবে'। বিষ্ণুপ্রিয়া বলছিলেন, 'স্বাধীনতার পর কখনো এ রকম হয়নি'। কিন্তু এখন তাঁর ঘুমের মধ্যেও ভয় ঢুকে পড়ে।
হামলার হোতারা সর্বদলীয় এবং সমাজ-বহির্ভূত। দু-একজন ছাড়া হামলাকারীরা ছিল অপরিচিত। কিন্তু তাদের পেছনে তো সাধারণ মুসলমানরাও অনেকে ছিল। আবার রুখে দাঁড়াবার সারিতেও ছিল মুসলমান পরিচয়েরই মানুষ। বনগ্রামের হিন্দু-মুসলমানের যে মিলিত সমাজটা এখনো বেঁচে আছে; সেটাই দেশের আত্মা। সেই আত্মাটাই যেন বাজারের এক দিনমজুরের মুখ দিয়ে কথা বলে উঠল। তিনি চান না, কেউ ভয়ে থাকুক বা দেশ ছেড়ে চলে যাক। তাঁর ভাষায়, 'হিন্দু মুসলমান একসাথে না থা'লে দ্যাশে শান্তি থাহে না'। গণবিরোধী রাজনীতি ও দুর্বৃত্তদের গ্রাস থেকে সেই সমাজকে আমরা বাঁচাতে পারব কি না, আজকের চ্যালেঞ্জ সেটাই।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com