'কুখ্যাত' সুবহানের ফাঁসির আদেশ
আশরাফ-উল-আলম, এম বদি-উজ-জামান ও রেজাউল করিম
'এ কী নৃশংসতা! মসজিদ থেকে বের করে এনে তলোয়ার দিয়ে গলা কেটে মানুষজনকে হত্যা করেন সুবহান ও তাঁর সহযোগীরা! এর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।' জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির আবদুস সুবহানের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় দিতে গিয়ে কথাগুলো বলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারক। সুবহানের বিরুদ্ধে প্রমাণিত তিনটি অভিযোগে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
গতকাল বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ রায় ঘোষণা করেন। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিচারক প্যানেল এই রায় ঘোষণা করেন। প্যানেলের অন্য দুজন বিচারক হলেন- বিচারপতি মো. মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম। এটি ট্রাইব্যুনালের ১৬তম এবং জামায়াতে ইসলামীর নবম নেতার বিরুদ্ধে রায়। আবদুস সুবহানের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ৯টি অভিযোগের মধ্যে ছয়টি প্রমাণিত হয়েছে বলে রায়ে বলা হয়। এর মধ্যে তিনটিতে সুবহানের মৃত্যুদণ্ড, দুটিতে আমৃত্যু কারাদণ্ড ও একটিতে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেন, আবদুস সুবহান সামান্য অপরাধী নন। তিনি গুরুতর অপরাধী। তিনি সরাসরি মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ছিলেন। এ ছাড়া তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে ১৯৭১ সালে অপরাধে সহযোগিতা করেন বলে প্রমাণিত হয়েছে। আবদুস সুবহান পাবনা জেলা জামায়াতের তৎকালীন আমির ছিলেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহায়তায় তিনি গণহত্যা, হত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে অংশ নেন বলে সাক্ষ্য-প্রমাণে প্রমাণিত হয়েছে। রায়ে বলা হয়, আবদুস সুবহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব কাজ করেছেন তাতে তাঁকে একজন 'কুখ্যাত ব্যক্তি' হিসেবে অভিহিত করা যায়।
ট্রাইব্যুনাল রায়ে আরো বলেন, দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আবদুস সুবহানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হবে। একই সঙ্গে আদালত সাজা পরোয়ানাসহ তাঁকে কারাগারে পাঠাতে ট্রাইব্যুনালের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন। তবে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ইচ্ছে করলে এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করতে পারবেন বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। ট্রাইব্যুনাল রায়ের অনুলিপি ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে পাঠানোরও নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকেও রায়ের অনুলিপি সরবরাহের নির্দেশ দেন। ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গেছে, গতকালই রায়ের অনুলিপি আসামিপক্ষকে দেওয়া হয়েছে, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকেও পাঠানো হয়েছে। রায়ের পর সাজা পরোয়ানাসহ আসামিকে কারাগারে পাঠানো হয়।
যেসব অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড
অভিযোগ নম্বর ১ : ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিলের পর এক সপ্তাহের মধ্যে ঈশ্বরদী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ থেকে অপহরণ করে মোয়াজ্জেম হোসেন, মোতালেব খান ও তাঁর ছেলে নাজমুল হক খানসহ ২০ জনকে হত্যার অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় আবদুস সুবহানকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। একাত্তরে সহযোগী জামায়াত নেতা ও বিহারিদের সঙ্গে নিয়ে পাবনার ঈশ্বরদীতে জামে মসজিদে আশ্রয় নেওয়া স্বাধীনতাকামী মানুষকে অপহরণ করে হত্যা করেন সুবহান।
অভিযোগ নম্বর ৪ : একাত্তরের ২ মে সুবহানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঈশ্বরদীর সাহাপুর গ্রামে অসংখ্য বাড়িঘর লুটপাট ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় এবং কয়েকজনকে হত্যা করে।
অভিযোগ নম্বর ৬ : একাত্তরের ১২ মে সুবহানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি বিরাট বহর পাবনার সুজানগরের কয়েকটি গ্রামে হামলা চালিয়ে তিন-চার শ মানুষকে হত্যা এবং বিভিন্ন বাড়িঘরে লুটপাট চালায় ও পুড়িয়ে দেয়।
এ তিনটি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ভিন্নভাবে সুবহানকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
আমৃত্যু কারাদণ্ড
অভিযোগ নম্বর ২ : ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সুবহানের নেতৃত্বে ও উপস্থিতিতে ঈশ্বরদীর যুক্তিতলা গ্রামে হামলা চালিয়ে লুটপাটসহ ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে তিনজনকে গুরুতরভাবে আহত এবং পাঁচজন নিরস্ত্র লোককে হত্যা করা হয়।
অভিযোগ নম্বর ৭ : ২০ মে সুবহানের নেতৃত্বে পাবনা সদর থানার ভাড়ারা গ্রামে ১৮ জনকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়।
এ দুটি অভিযোগ আসামির বিরুদ্ধে প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে আমৃত্যু কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে বলে রায়ে বলা হয়।
অভিযোগ নম্বর ৩ : ১৯৭১ সালের ১৬ মে ঈশ্বরদীর অরণখোলা গরুরহাট থেকে দুজনকে অপহরণ করে পাবনার ঈশ্বরদীতে জেলা পরিষদ ডাকবাংলোর ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করেন সুবহান। এই অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় তাঁকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
তবে তিনটি অভিযোগের যেকোনো একটিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলে বাকি সাজাগুলোর কার্যকারিতা থাকবে না বলে রায়ে বলা হয়।
তিনটি অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় সুবহানকে খালাস দেওয়া হয়।
২০১২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর পাবনার একটি ফৌজদারি মামলায় সুবহান গ্রেপ্তার হলে ২৩ সেপ্টেম্বর তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক দেখানো হয়। ওই সময় থেকে তিনি কারাগারে আটক আছেন।
আদালতের পরিবেশ : গতকাল সকাল ১১টায় রায় ঘোষণার জন্য ট্রাইব্যুনালের বিচারক প্যানেল এজলাসে ওঠেন। এর পরই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ১৬৫ পৃষ্ঠার রায়ের সারাংশ পড়া শুরু করেন। এ সময় আসামি আবদুস সুবহান কাঠগড়ায় সাদা পাজামা-পাঞ্জামির ওপর খাকি রঙের হাফ সোয়েটার পরে বসেছিলেন। তিনি নীরবে রায় পড়া শোনেন। তাঁকে স্বাভাবিক দেখাচ্ছিল। রায় ঘোষণা শেষ হলে তাঁকে ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় নিয়ে যান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এর আগে সুবহানকে সকাল সাড়ে ৯টায় কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। রায় শোনার জন্য ট্রাইব্যুনালে সংশ্লিষ্ট আইনজীবী, আসামির ছেলে, তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তা, প্রসিকিউশন টিমের সদস্যরা, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও বিপুলসংখ্যক সাংবাদিক উপস্থিত হন। ট্রাইব্যুনাল ও সুপ্রিম কোর্টের আশপাশে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়।
রায়ের প্রতিক্রিয়া : রায় ঘোষণার পর সন্তোষ প্রকাশ করেন মামলা পরিচালনাকারী প্রসিকিউটর টিমের সদস্য ড. তুরিন আফরোজ, অ্যাডভোকটে জিয়াদ আল মালুম ও সুলতান মাহমুদ সিমন। অন্যদিকে আসামির আইনজীবী মো. শিশির মনির রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, 'আমরা এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করব।'
পাবনায় আনন্দ মিছিল : জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা আবদুস সুবহানের ফাঁসির রায় ঘোষণার পর পাবনায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এবং আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা গতকাল আনন্দ মিছিল করেছে। মিছিল শেষে আওয়ামী লীগ দলীয় কার্যালয়ে মিষ্টি বিতরণ করা হয়। রায়কে স্বাগত জানিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন মামলার সাক্ষী ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা।
মামলার অন্যতম সাক্ষী সুজানগর উপজেলার সাতবাড়িয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, এই রায়ের মাধ্যমে দীর্ঘ ৪৪ বছর পরে পাবনার শহীদ পরিবারের সদস্যদের স্বজন হারানোর কষ্ট অনেকখানি লাঘব হয়েছে।
পাবনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাবিবুর রহমান হাবিব অবিলম্বে এই রায় কার্যকরের দাবি জানান।
ঈশ্বরদী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুর রাজ্জাক, মামলার সাক্ষী শহীদুজ্জামান নাসিম ও মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান ফান্টু বলেন, এই রায় দীর্ঘ প্রত্যাশিত ছিল।
http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2015/02/19/189614কামারুজ্জামানের ফাঁসি দ্রুত কার্যকর চান সোহাগপুরের বিধবারা
I see who is the decision maker জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার
কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড বহাল
__._,_.___