সাতকানিয়া-লোহাগাড়া ঘুরে
এলাকাবাসী জানায়, ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৭ মার্চ আট দিন। এর মধ্যে বুধবার এক দিনের জন্য সড়কে যানবাহন চলেছে। অন্য সাত দিন স্থবির ছিল সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার সাত লাখ মানুষের জীবন। গতকাল বৃহস্পতিবারও হরতালের কারণে দুর্ভোগ ছিল লাখো মানুষের সঙ্গী।
তাণ্ডবের খণ্ডচিত্র : 'সাঈদীর রায় ঘোষণার পর হাজার হাজার দুর্বৃত্ত আমার কমিউনিটি সেন্টারে আশ্রয় নেওয়া ২০ জন পুলিশ সদস্যের ওপর আক্রমণ চালায়। হামলায় একজন পুলিশ সদস্যসহ দুজন মারা যান। আর আমার কমিউনিটি সেন্টার, গাড়ি, মোটরসাইকেল, ট্রাক সবকিছুই পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে শুধু আমারই ক্ষতি হয়েছে প্রায় দুই কোটি টাকা।' কালের কণ্ঠকে বলছিলেন লোহাগাড়ার জমির কমপ্লেক্স ভবনের মালিক জমির উদ্দিন। তিনি আরো বলেন, 'দেশ জন্মের পর এমন তাণ্ডব আর দেখিনি।' কেরানীহাটের শিল্পপতি নিজাম উদ্দিন বলেন, 'দেখলাম ছোট ছোট শিশুসহ অসংখ্য লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মার্কেট এবং গাড়িতে হামলা চালাল। মুহূর্তেই ২০ লাখ টাকার সম্পদ নষ্ট হয়ে গেছে। চোখের সামনে তিল তিল করে গড়া মার্কেট ভাঙা হলো, অথচ কিছুই করতে পারলাম না।'
জামায়াত-শিবির সন্ত্রাসীদের তাণ্ডব থেকে রক্ষা পায়নি অ্যাম্বুল্যান্স, হাসপাতাল থেকে শুরু করে জনহিতকর অনেক প্রতিষ্ঠান। এমন তাণ্ডব ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ও মন্তব্য করে লোহাগাড়ার বাসিন্দা ও পুলিশ হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী আবুল হোসেন (৭০) বলেন, 'দেখলাম, একজন পুলিশকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হলো, গাড়িতে আগুন দেওয়া হল।' তিনি বলেন, 'আমি ভয়ে দোকান বন্ধ করে টেবিলের নিচে লুকিয়ে ছিলাম। পরে টানা ছয় দিন ভয়ে ঘর থেকে বের হইনি।'
এলাকাবাসী জানায়, সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে অসংখ্য গাছ কেটে ব্যারিকেড দেওয়া হয়। ফলে একটি সাইকেলও চলাচল করতে পারেনি। তাণ্ডবে দুই উপজেলায় পুলিশের হিসেবে প্রায় ১০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আর বেসরকারি হিসেবে এই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৫ কোটি টাকা।
মানবিক দুর্ভোগ : টানা পাঁচ দিন সড়ক বন্ধ। তাই রিকশা নিয়ে রাস্তায় নামতে পারেননি সাতকানিয়ার করাইনগর গ্রামের রিকশাচালক মোহাম্মদ সেলিম। অবরোধের প্রথম দিন ঘরে থাকা খাবার এবং প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ধার করে চার শিশুসন্তানসহ ছয়জনের পরিবার ক্ষুধা নিবারণ করে। চার দিনের মাথায় ধারও জুট ছিল না। এরপর ছয় সদস্যের এই পরিবারটি অভুক্ত রাত যাপন করে। পরদিন প্রতিবেশী একজন ব্যবসায়ী বিষয়টি জানতে পেরে তাৎক্ষণিকভাবে এক বস্তা চাল দেন। ওই ব্যবসায়ী ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি একটি পরিবারের কথা বললাম। অনেক সচ্ছল পরিবারও বাজার বন্ধ থাকায় খাবার সংকটে পড়েছিল।' কেরানীহাট বাজারের ব্যবসায়ী নূর আহমদ বলেন, 'টানা পাঁচ দিন কেরানীহাট বাজার বন্ধ থাকায় খাবার কিনে খেতে পারিনি। এমন দুর্ভোগে কখনোই পড়িনি। আর দুই দিন বাজার বন্ধ থাকলে শিশুসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অভুক্ত থাকতে হতো।'
সাতকানিয়ার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ফরিদুল আলম বলেন, 'আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং গাড়িসহ প্রায় ১০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এতে আমি দুঃখবোধ করছি না। আমি চরমভাবে অপমানবোধ করছি এই কারণে, আমাদের ব্যবসায়ীদের ঐতিহ্যে দুর্বৃত্তরা নগ্ন হামলা চালিয়েছে।'
আতঙ্ক কাটেনি : পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এলেও সাধারণ মানুষ চরম আতঙ্কে আছে। সদ্য আমেরিকাফেরত প্রবাসী ব্যবসায়ী ও সাতকানিয়ার কেওচিয়া গ্রামের বাসিন্দা আহমদ নবী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এমন হবে জানলে দেশেই আসতাম না। এখন ভয়ে বের হতে পারছি না।' লোহাগাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ শাহজাহান কালের কণ্ঠের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, 'সাধারণ মানুষ যেমন আতঙ্কে আছে, তেমনি পুলিশও আতঙ্কে আছে। আবারও সংঘাতের সম্ভাবনা প্রবল।' তবে তিনি দাবি করেছেন, 'আতঙ্ক থাকলেও পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে আছে।'
জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা মন্দিরেও হামলা চালায়, আগুন দেয় বলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এখনো আতঙ্কে আছে। তাঁরা জানান, সাতকানিয়ার চরতি, বাজালিয়া এবং পৌরসভা সদরে পাঁচটি হিন্দু ও বৌদ্ধমন্দিরে আগুন দেওয়া হয়। সাতকানিয়া হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক প্রদীপ কুমার চৌধুরী বলেন, 'জামায়াত-শিবির সন্ত্রাসীরা এই হামলা চালিয়েছে। এই মুহূর্তে হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টানরা চরম আতঙ্কে দিনাতিপাত করছে এবং রাতে মন্দির পাহারা দিচ্ছে।
এদিকে বৃহস্পতিবার লোহাগাড়ায় পুলিশের ওপর হামলার সময় তিনটি অস্ত্র লুট করে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। এর মধ্যে গত সাত দিনে পুলিশ দুটি অস্ত্র উদ্ধার করতে সক্ষম হলেও একটি অস্ত্র এখনো উদ্ধার করতে পারেনি। ওসি মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, অস্ত্রটি উদ্ধারের জন্য পুলিশ অভিযান অব্যাহত রেখেছে।
এদিকে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের এলএমজি বলেন, 'পুলিশ যদি শুরুতেই জামায়াত-শিবিরকে সংগঠিত হতে বাধা দিত, এমন নারকীয় ঘটনা ঘটত না।' এ প্রসঙ্গে সাতকানিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, 'ওই দিন পুলিশ ছিল, তবে আমরা নীরবও ছিলাম না। তবে বিপুল সংখ্যক দুর্বৃত্ত দমনে পুলিশ কৌশল নিয়েছিল।'
৪ মাসে নিহত ৭, আহত ৫৬৯
হামলা ঠেকাতে গিয়ে মার খাচ্ছে পুলিশ
বিশেষ প্রতিনিধি | তারিখ: ০৭-০৩-২০১৩
জামায়াত-শিবিরের হামলা ঠেকাতে গিয়ে গত চার মাসে পুলিশের সাতজন সদস্য নিহত এবং ৫৬৯ জন আহত হয়েছেন। এ সময় পুলিশের ব্যবহূত ৫২টি যানবাহন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। দেশব্যাপী এ হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে উদ্বিগ্ন পুলিশ প্রশাসন। ..........
Details at:
http://prothom-alo.com/detail/date/2013-03-07/news/334495
ধ্বংসস্তূপে খাওয়া দাওয়া রাতযাপন
বারুদ ছিটিয়ে আগুন নিমেষেই সব শেষ
মাহবুবুর রহমান, নোয়াখালী | তারিখ: ০৭-০৩-২০১৩
জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব : শহরে বেরিয়ে স্তম্ভিত বগুড়াবাসী
শরিফুল হাসান, মিলন রহমান ও আনোয়ার পারভেজ, বগুড়া থেকে | তারিখ: ০৭-০৩-২০১৩
__._,_.___