http://sonarbangladesh.com/article.php?ID=7646
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংঘাত বন্ধে কিছু সুপারিশ
শাহ আবদুল হান্নান
বহুদিন ধরে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে আমি কিছু লিখছি না। আমার রাজনৈতিক বন্ধুরা এখন আমাকে রাজনীতি সম্পর্কে না লিখতে অনুরোধ করেছিলেন। গত ৬ মাসে তা আমি অনুসরণ করে চলেছি। তবে এখন আমি আমাদের দেশের রাজনীতিতে যেই গভীর সংঘাত দেখছি তার আলোকে কোনো দলের পক্ষে বা বিপক্ষে না গিয়ে সরকারকে এবং প্রধান দলগুলোকে কিছু প্রস্তাব দিচ্ছি। প্রথমত, বর্তমান রাজনৈতিক সংঘাতের মূল কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা। যতটুকু রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে জানি সংবিধানের ব্যাপারে সংসদ বা পার্লামেন্ট সম্পূর্ণ স্বাধীন। সংবিধানের ব্যাখ্যা সুপ্রিমকোর্ট করতে পারেন, কিন্তু সংবিধান রচনার দায়িত্ব সম্পূর্ণ সংসদের। তদুপরি সবাই জানি যে, সুপ্রিমকোর্ট তাদের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা অন্তত আরও দুই বার রাখার সুপারিশ করেছিলেন। আরও উল্লেখ্য যে, এই সংক্রান্ত সুপ্রিমকোর্টের রায় সর্বসম্মত নয় বরং সংখ্যাধিক্যের জোরে করা হয়েছিল। রায়ের পূর্ণ বিবরণী আমরা জানি না। কেননা এখনও তা প্রকাশিত হয়নি। এই অবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা জাতিকে ভয়াবহ অবস্থার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, দেশের অধিকাংশ দল বা মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে। সুতরাং আর বিলম্ব না করে সংবিধান পুনরায় সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল করার অনুরোধ জানাচ্ছি।
দ্বিতীয়ত, খুব শিগগিরই বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। তার স্থলে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করা অত্যন্ত জরুরি। প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান এ ব্যাপারে একটি উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি সব দলের সঙ্গে আলাপ করবেন। স্পষ্টত তিনি এই উদ্যোগ নিয়েছেন সরকারের অনুরোধে, তা প্রকাশ্যে বলা হোক বা না হোক। এ প্রসঙ্গে যেই বিষয়টি জরুরি যে, প্রেসিডেন্ট যেন এমন ব্যক্তিকে কমিশনে নিতে না বলেন যার ব্যাপারে মহাজোট এবং চারদলীয় জোট একমত নয়। অন্তত আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির এ ব্যাপারে ঐকমত্য জরুরি। আমি বিএনপি এবং সব দলকে প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণ গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করছি। তাদের শর্ত তারা প্রেসিডেন্টকে দিতে পারবেন। তাদের মৌলিক শর্ত রক্ষিত না হলে তাদের সুপারিশকৃত ব্যক্তিকে প্রত্যাখ্যান করতে পারবেন। কিন্তু না যাওয়া ঠিক হবে না, সংঘাত অবসানে সবারই দায়িত্ব রয়েছে।
তৃতীয়ত, বর্তমানে দলগুলো স্বাধীনভাবে গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করতে পারছে না। স্বাধীনভাবে প্রসেসান ও সভা করা যাচ্ছে না। পুলিশ সবখানে বাধা দিচ্ছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রসেসান ছত্রভঙ্গ করে দিচ্ছে। বড় বড় দলের অফিস ঘেরাও করে রাখা হচ্ছে। একটি বড় দলের অফিসে কেউ কাজই করতে পারছে না। সংঘাত কমিয়ে আনতে হলে এসব বন্ধ করতে হবে। আমি প্রস্তাব করি সরকার সব দলকে সভা-মিছিল করার সুযোগ দিন। এতে রাজনৈতিক সংঘাত কমে আসবে।
চতুর্থত, দেশের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে অনেক অসন্তোষ রয়েছে। আমরা তিস্তার পানি পাইনি এবং অন্য কোনো সুবিধা পাইনি। অন্যদিকে ভারত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করে চলেছে। তারা করিডোর পেয়ে গেছে। তারা চট্টগ্রাম এবং মংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে গেছে। জনগণ খুবই ক্ষুব্ধ এবং রাজনীতি এ বিষয়ে অত্যন্ত উত্তপ্ত, আমি প্রস্তাব করি তিস্তা চুক্তি না হওয়া পর্যন্ত ভারতকে করিডোর দেয়া বন্ধ করা হোক এবং মংলা বন্দর ব্যবহার বন্ধ হোক।
পঞ্চমত, দেশের জনগণ এবং অধিকাংশ রাজনৈতিক দল সংবিধান সংশোধন করে আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা বাদ দেয়া এবং সেক্যুলারিজম (রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ধর্মবর্জন) গ্রহণকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। এটা অহেতুক জাতীয় বিভক্তি বৃদ্ধি করেছে। অবিলম্বে এই জাতীয় বিভক্তি দূর করা দরকার এবং এ জন্য সংবিধান সংশোধন করা যেতে পারে।
ষষ্ঠত, দেশে অসংখ্য মামলা হচ্ছে এবং কোনো কোনো মামলায় হাজার হাজার আসামি। এসব বন্ধ করার জন্য সরকার এবং পুলিশ কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করছি। সরকারকে অনুরোধ করছি এসব মামলা যেন খারিজ করার ব্যবস্থা করে এবং নিরীহ লোকদের জামিনের ব্যবস্থা করে।
আশা করি, সরকার এবং অন্য কর্তৃপক্ষ জাতিকে সংঘাত মুক্ত করার জন্য আমার এসব প্রস্তাব বিবেচনা করে দেখবেন।
লেখক : সাবেক সচিব; বাংলাদেশ সরকার
[সূত্রঃ আমার দেশ, ২১/১২/১১]
__._,_.___