বাচার দাবি ছয়দফা:ভুলি নাই,ভুলবোনা৷
নিরবেই চলে গেল ৫ ফেব্রুয়ারী , বাঙালি জাতির স্বাধিকার আন্দোলনের
একটি অবিশ্বরনীয় দিন ৷ ১৯৬৬ -র এই দিনে পাকিস্তানের লাহোরে
সর্বদলীয় সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাঙালির বাচার দাবি ৬ দফা
উত্থাপন করে তত্কালীন রাজনৈতিক মহলে আলোড়ন তোলেন ! সব দলই
এর বিরোধিতা করে , এমনকি প্রগতিশীল ন্যাপও বাঙালির বাচা-মরার
এই দাবির বিরোধিতা করতে কুন্ঠাবোধ করেনি সেদিন ! এত বিরোধিতার
মাঝেও অকুতোভয় বঙ্গবন্ধু তার দাবি থেকে এক চুলও সরে আসেন নি ,
বরং সভা বর্জন করে আগামী দিন গুলোতে ৬ দফার ভিত্তিতে দুর্বার আন্দোলন
করার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করেন ৷ সেদিন বঙ্গবন্ধু যদি সবার সাথে তাল
মিলিয়ে ৬ দফা প্রত্যাহার করে নিতেন তা হলে কি আমরা এত সহজে ৭১ এ
স্বাধীনতা অর্জন করতে পারতাম ? লাহোর থেকে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু উল্কা-বেগে
টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া চষে বেড়ালেন ৬ দফা প্রচারে , বাংলার মানুষ ও লুফে
নিল ৬ দফাকে তাদের "বাচা-মরার" দাবি হিসাবে ৷ সেই থেকে ৬ দফা হয়ে গেল
"শোষিত বাঙালির ঐতিহাসিক মুক্তি-সনদ" আর বঙ্গবন্ধু হয়ে গেলেন নিপীড়িত
বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা ৷ ৬দফা আর বঙ্গবন্ধুর আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তায়
স্বৈরশাসক আইউব খান প্রমাদ গুনলেন ৷ অবিরাম জেল-জুলুম-নির্যাতনে বঙ্গবন্ধুকে
৬ দফার আন্দোলন থেকে নিবৃত করতে না পেরে, তাকে "বিচ্ছিন্নতাবাদী'' হিসাবে আখ্যায়িত
করে চির তরে শেষ করে দেবার জন্য "আগরতলা ষড়যন্ত্র " মামলার এক নম্বর আসামী করা
হলো ৷ কিন্তু ছাত্র-জনতার দুর্বার আন্দোলনে আইউব শাহির ষড়যন্ত্র ধুলিসাত হয়ে যায় ,
তার পরের ইতিহাস তো সবারই জানা ৷ ৬ দফার ভিত্তিতে ৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের
ঐতিহাসিক , অবিশ্সরণীয় জয় ছিল "স্বাধীন বাংলাদেশ'' অভ্যুদয়ের মূল ভিত্তি ৷
৬ দফার পূর্ণ বাস্তবায়নের অর্থই ছিল "রক্তপাতহীন" স্বাধীনতা অর্জন ! পশ্চিম পাকিস্তানিরা
তা বেশ ভালো করে জানত বলেই "ইয়াহিয়া-ভুট্টো গং" রা আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা
না দেওয়ার ব্যাপারে ছিল বদ্ধ পরিকর ৷ আওয়ামী বিরোধীরা বিভিন্ন বিষয়ে আওয়ামী লিগ
এবং বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা করলেও , ৬ দফার ব্যাপারে কিন্তু তারা নিরব ! আমাদের
প্রানের স্বাধীনতার মূল ভিত্তি হলেও , স্বাধীনতার ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গিয়ে আমরা
"৬ দফা এবং ৬৬ কে বাদ দিয়ে " , ৫২ থেকে এক লাফে ৬৯ এ চলে আসি !
ঐতিহাসিক মুক্তি-সনদ ৬ দফা কিসের ভিত্তিতে তৈরী হয়েছিল তা কিন্তু আমরা অনেকেই জানিনা ,
নতুন প্রজন্মত এব্যাপারে পুরোপুরি অন্ধকারে ! তাই সবার অবগতির জন্য সংক্ষেপে ৬ দফার বিশ্লেষণ
করছি :
১ম দফা : ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনা করতে হবে এবং
পাকিস্তান লাহোর প্রস্তাবানুযায়ী একটি ফেডারেল রাষ্ট্ররূপে প্রতিষ্ঠিত হবে ৷
২য দফা : কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে কেবল দেশরক্ষা এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থাকবে , বাকি
সকল বিষয় প্রদেশসমূহের হাতে ন্যাস্ত থাকবে ৷
৩য দফা : (ক) পূর্ব-পশ্চিম অংশের জন্য দুটি সম্পূর্ণ পৃথক সহজ বিনিময়যোগ্য মুদ্রার প্রচলন
থাকবে এবং কারেন্সি কেন্দ্রের পরিবর্তে অঞ্চল সমূহের নিয়ন্ত্রণে থাকবে ৷দুটি
অঞ্চলের জন্য দুটি পৃথক কেন্দ্রীয় ব্যেন্ক বা স্টেট বেংক থাকবে ,অথবা
(খ) দু'টি অঞ্চলের জন্য একই কারেন্সি থাকবে এবং নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের হাতেই থাকবে ৷
তবে শাসনতন্ত্রে এমন স্পষ্ট বিধান থাকতে হবে যাতে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থ পশ্চিম -
পাকিস্তানে পাচার হতে না পারে এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রে একটি ফেডারেল রিজার্ভ বেংক
এবং দু'টি অঞ্চলে দু'টি পৃথক রিজার্ভ বেংক থাকবে ৷
৪ দফা : সকল প্রকার কর , খাজনা ,টেক্স ধার্য বা আদায় করার এখতিয়ার আঞ্চলিক বা প্রাদেশিক
সরকারের ওপর থাকবে ৷ আদায়কৃত রেভিনিউর একটি নির্ধারিত অংশ অঞ্চলসমূহ থেকে
কেন্দ্রীয় ফেডারেল বেংকে জমা হবে এবং এই অর্থ কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল হিসাবে গন্য হবে ৷
৫ম দফা : বৈদেশিক বানিজ্য ও লেনদেনের ক্ষেত্রে -(ক) দু'টি অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক
হিসাব রক্ষিত হবে ; (খ) প্রতিটি অঞ্চলের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের এখতিয়ারে
থাকবে ; (গ) কেন্দ্রের প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা দু'টি অঞ্চল থেকে সমানভাবে অথবা
শাসনতন্ত্রে বর্ণিত নির্ধারিত হারে প্রদেয় হবে ; (ঘ) দেশজ উত্পাদিত দ্রব্য বিনাশুল্কে উভয়
অঞ্চলে আমদানি-রফতানি করা যাবে ; (উম) সকল প্রকার বৈদেশিক ব্যাবসা -বানিজ্য ,
এতদসংক্রান্ত যেকোনো ট্রেড মিশন স্থাপন কিংবা আমদানি-রপ্তানির এখতিয়ার প্রদেশ বা
আঞ্চলিক সরকারের ওপর ন্যাস্ত করার বিধান শাসনতান্ত্রিকভাবেই স্বীকৃত থাকবে ৷
৬ষ্ঠ দফা : যেহেতু পূর্ব-পাকিস্তান নদী-সমৃদ্ধ অঞ্চল , নৌ -বাহিনীর সদর দপ্তর চট্টগ্রামে স্থাপিত হবে
এবং পূর্ব-পাকিস্তানে স্বতন্ত্র অস্ত্র-কারখানা স্থাপন করতে হবে ৷ পূর্ব-পাকিস্তানের নিজস্ব
আত্বরক্ষার জন্য মিলিশিয়া বা প্যারা-মিলিটারী রক্ষিবাহিনী গঠন করতে হবে ৷
তাই স্বাধীনতার পক্ষের সবাইকে "মুক্তি-সনদ ৬ দফাকে" অন্তরে লালন করার জন্য অনুরোধ
করছি,নতুন প্রজন্মকে ৬ দফার আলোকে আলোকিত করার আহবান জানাচ্ছি৷ তাহলেই নতুন
প্রজন্ম "বঙ্গবন্ধুর প্রজ্ঞা , দূরদর্শিতা" সম্পর্কে অবহিত হবে, স্বাধীনতার সত্যিকার ইতিহাস জানতে পারবে ৷
জয় বাংলা , জয় বঙ্গবন্ধু ,
ডা : মুহাম্মদ আলী মানিক ,
উপদেষ্টা , যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ ৷
__._,_.___