স্টাফ রিপোর্টার ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় 'বাচ্চু রাজাকার' নামে পরিচিত ফরিদপুরের আবুল কালাম আজাদকে গ্রেফতারের পরোয়ানা জারির আদেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। আদেশের পর বাচ্চুকে গ্রেফতারের জন্য তার বাসা, অফিসসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালাচ্ছে গোয়েন্দা পুলিশ। তবে উত্তরার কার্যালয় বা উত্তর খানের বাড়িতে তাকে পাওয়া যায়নি বলে পুলিশ জানিয়েছে। আদেশ পাওয়ার পরে যত দ্রুত সম্ভব এ আদেশ কার্যকর করার জন্য ডিএমপি কমিশনারকে নির্দেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার জন্যও বলা হয়েছে। মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান এটিএম ফজলে কবিরের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২ এসব আদেশ দেয়। অপর দুই বিচারক হলেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও শাহিনুর রহমান।
বিচারক তাঁর আদেশে বলেন, প্রসিকিউশন আবুল কালাম আজাদকে গ্রেফতারের যে আবেদন করেছে তার যৌক্তিকতা রয়েছে। আবুল কালাম আজাদ মুক্তিযুদ্ধের সময় ফরিদপুরে জামায়াত নেতা আলী আহসান মোঃ মুজাহিদের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাঁকে গ্রেফতারের আবেদন শোনার মধ্য দিয়ে গত ২৪ মার্চ আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। আদেশের পর পরই পুলিশ মঙ্গলবার উত্তর খানের ২৮৯/৬ চাঁনপাড়ার আজাদ ভিলায় তাঁর ফ্ল্যাটসহ চারতলা এ ভবনের সব ফ্ল্যাটে তল্লাশি চালিয়েও তাঁকে পায়নি। পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তিনি শেষ রাতের দিকে বাসা থেকে রেরিয়ে গেছেন। আর ফেরেননি। রাতের আঁধারে গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাচ্চু রাজাকার পালিয়েছেন। গোয়েন্দাদের কড়া নজরদারি থাকলেও কিভাবে তিনি পালিয়ে গেলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আজাদ ভিলায় তল্লাশি শেষে অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া ডিবির সহকারী কমিশনার সুনন্দা রায় সাংবাদিকদের বলেছেন, বাচ্চু রাজাকারকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাসা থেকে জানানো হয়েছে, তিনি শেষ রাত সাড়ে তিনটার দিকে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছেন। তিনি আরও বলেন, বাচ্চু রাজাকার ওয়ারেন্টভুক্ত ফেরারি আসামি। তাঁকে ধরার জন্য আমরা তৎপরতা চালাচ্ছি। দেশের প্রত্যেক থানায় তাঁর ছবিসহ ওয়ারেন্টের কপি পাঠানো হবে। এরই মধ্যে সারা দেশে এ বিষয়ে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অভিযানের সময় বাসায় তাঁর স্ত্রী, মেয়ে এবং ছেলের বউ ছিলেন।
বাচ্চু রাজাকার হিসেবে পরিচিত আবুল কালাম আজাদকে গ্রেফতারের জন্য নয়টি কারণ তুলে ধরে প্রসিকিউটর হায়দার আলী সোমবার ট্রাইব্যুনালকে বলেন, 'একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সহযোগীদের নিয়ে তিনি ফরিদপুর সদর, বোয়লামারী, নগরকান্দা, মধুখালী, কামারখালীসহ বিভিন্ন এলাকায় খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। প্রাথমিক তদন্তে এসব অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেছে।'
তিনি ট্রাইব্যুনালকে আরও বলেন, 'বাচ্চু রাজাকার' এলাকায় খুব প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। তাঁর পাঁচটি এনজিও রয়েছে। ওয়াজ-নসিহতের মাধ্যমে মানুষকে বশে আনার ক্ষেত্রে তাঁর রয়েছে 'সম্মোহনী শক্তি।' তদন্ত চলাকালে ফরিদপুরে যাঁরা আবুল কালামের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন তাঁদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন প্রসিকিউটর।
ট্রাইব্যুনাল মঙ্গলবার গ্রেফতারী পরোয়ানা জারির আদেশ দেয়ার পর প্রসিকিউটর জিয়াদ আল মালুম সাংবাদিকদের বলেন, 'আবুল কালাম আজাদকে যেদিন গ্রেফতার করা হবে তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে হবে। ডিএমপি কমিশনারকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে ট্রাইব্যুনালের আদেশে।' এছাড়া 'বাচ্চু রাজাকারের' বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের সমস্ত অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে জমা দিতে বলা হয়েছে।
আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার রাজধানীর উত্তরার ৭নং সেক্টরের ৬নং সড়কের ৩৩নং বাড়িতে বসবাস করেন। তবে তদন্ত দলের কাছে তাঁর অপর একটি ঠিকানাও রয়েছে। সেটি হচ্ছে রাজধানীর উত্তরখানের মাস্টারপাড়া কাজি বাড়ি।
বাচ্চু রাজাকার হিসেবে পরিচিত মাওলানা আবুল কালাম আজাদকে গ্রেফতারের জন্য যে ৯টি গ্রাউন্ড তুলে ধারা হয়েছে সে গুলোর মধ্যে রয়েছে, (১) তিনি একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং ভাল বক্তা। ওয়াজ নছিয়তের মাধ্যমে সে অনেক লোককে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য প্রদান করে সাধারণ লোকজনকে বিভ্রান্ত করছে। (২) তদন্তকালীন সময়ে বাচ্চু রাজাকারের কতিপয় সমর্থক মামলার তদন্ত কাজকে ব্যাহত করার লক্ষ্যে সাক্ষী রণজিৎ কুমার নাথকে প্রকাশ্যে ভীতি প্রদর্শন করেছে। উক্ত সাক্ষী এই বিষয়ে ফরিদপুর কোতোয়ালি থানায় একটি অভিযোগ করেছে। (৩) আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার একজন চতুর ব্যক্তি। তাঁর বিরুদ্ধে গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে ইতোমধ্যে পত্রিকায় প্রাকাশিত হয়েছে বিধায় সে গ্রেফতার এড়ানোর লক্ষ্যে পলাতক হওয়ার চেষ্টা করছে। (৪) আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারকে গ্রেফতারপূর্বক পুলিশ হেফাজতে নিয়ে (সেফ হাউস) জিজ্ঞাসাবাদ করলে অনেক তথ্য যাচাই ও নতুন নতুন তথ্য উদ্ঘাটনের সম্ভাবনা রয়েছে বিধায় তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন রয়েছে। (৫) সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে বিভিন্ন বইপুস্তক ও পত্রপত্রিকা দেশ-বিদেশ হতে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের কাজ অব্যাহত রয়েছে। (৬) তাঁর বিরুদ্ধে প্রাপ্ত মানবতাবিরোধী অপরাধের কতিপয় ঘটনাস্থল পরিদর্শন, গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর জবানবন্দী লিপিবদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ আরও তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করার প্রয়োজন রয়েছে। (৭) ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী থানার ১৯৭১ সালের ভিকটিম মলয় চেয়ারম্যান নামক এক ব্যক্তিকে একমাস পূর্বে আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের সহায়তায় দিনদুপুরে হত্যা করা হয়েছে। উক্ত বাড়ি ও আশপাশের সাক্ষীরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে সাহস পাচ্ছে না। (৮) আসামি গ্রেফতার না হলে সে তদন্তে বিঘœ সৃষ্টি করবে এবং সুষ্ঠু ও কার্যকর তদন্ত সম্ভব হবে না। তার অনুপস্থিতিতে বিচারে বিলম্ব হবে বিধায় ন্যায় বিচারের স্বার্থে জরুরী ভিত্তিতে তার গ্রেফতারের আদেশ প্রয়োজন। (৯) আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার প্রকাশ্যে গোপনীয়ভাবে সাক্ষীদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে মামলার তদন্ত কাজে বিঘœ ঘটাচ্ছে। ও মামলার তথ্য উপাত্ত বিনষ্ট করতে সক্রিয় আছে।
তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাচ্চু রাজাকার মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশুনা কালীন ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কর্তৃক ঢাকা শহর সহ অন্য বড় বড় শহরে নিরীহ মানুষের ওপর গুলি করে হাজার হাজার মানুষ হত্যাসহ অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ধর্ষণ ইত্যাদি মানবতাবিরোধী অপরাধ শুরু হয়। তখন হতে আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার পাকিস্তানীদের পক্ষে এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের বিপক্ষে কাজ করার লক্ষ্যে তাঁর শ্বশুর চান কাজীসহ আশপাশের কতিপয় স্বাধীনতাবিরোধী লোকজন নিয়ে সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলে।
১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল পাকিস্তানী সেনাবাহিনী গুলিবর্ষণ করতে করতে ফরিদপুর শহরে প্রবেশ করে। এ দিনই ফরিদপুর শহরে কতিপয় দোকানপাট ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে জনমনে ত্রাস সৃষ্টি করে। পাকিস্তানী সেনা অফিসার মেজর আক্রাম কোরাইসীর নেতৃত্বে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ফরিদপুর স্টেডিয়াম, পুরনো সার্কিট হাউস, রাজেন্দ্র কলেজ, পুলিশ লাইন দখল করে তথায় ক্যাম্প স্থাপন করে।
তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আবুল কালাম আজাদ মাদ্রাসায় লেখাপড়ার কারণে ভাল উর্দু বলতে পারতেন। এটাকে পুঁজি করে অন্যায় ভাবে লাভবান ও অসৎ কামনা চরিতার্থ করার লক্ষ্যে তিনি ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রারম্ভকাল হতে পাকিস্তানী সেনা অফিসারদের মন জয় করার জন্য সচেষ্ট হন। পাক সৈন্যরা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও আবুল কালাম আজাদসহ কতিপয় স্বাধীনতাবিরোধী স্বেচ্ছাসেবী পাকিস্তানপন্থী লোকদের সার্বিক সহায়তায় ফরিদপুরবাসীদের মধ্য হতে পর্যায়ক্রমে পিস কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী গঠন করে। আবুল কালাম আজাদ ফরিদপুর জেলার আল বদরের দায়িত্ব পেলেও ফরিদপুরবাসী তাঁকে খাড়দিয়ার 'বাচ্চু রাজাকার' হিসেবে চিনে।
১৯৭০-১৯৭১ সালের পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী এবং পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের ফরিদপুর জেলা পর্যায়ের কমিটির সদস্য আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও আবুল কালাম আজাদ, ফরিদপুর স্টেডিয়ামে অবস্থানরত পাকিস্তানী সেনাবহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করত। অভিযুক্ত আবুল কালাম আজাদ তাঁর দলবলসহ স্টেডিয়ামে অবস্থানরত পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নিয়ে ফরিদপুর তোয়োলি, নগরকান্দা, বোয়ালমারীসহ অন্যান্য থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে স্বাধীনতাকামী আওয়ামী লীগ সমর্থিত মুক্তিযোদ্ধা, হিন্দু ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘরে আক্রমণ করে মালামাল লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে নিরীহ লোকদের ধরে বিভিন্ন নির্যাতন ও আটক রেখে নিপীড়ন, নির্যাতন, নারী ধর্ষণ ও হত্যাসহ বিভিন্ন প্রকার মানবতবিরোধী অপরাধ করেছে।
বাচ্চু রাজাকার পাক বাহিনীর নিকট ফরিদপুর পুলিশ লাইনে অস্ত্র ট্রেনিং গ্রহণ করে পাকিস্তানী হানাদারদের নিকট থেকে অস্ত্রপ্রাপ্ত হয়। ফরিদপুর শহরের জসীম উদ্দীন রোডের হীরালাল মোক্তারের একটি দোতলা বাড়ি দখল করে রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে। তাঁর ইঙ্গিতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী স্টেডিয়ামের ভেতরে হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করে স্টেডিয়ামের ভেতরেই মাটিচাপা দিয়েছে। বহু লাশ নদীতে ও ফরিদপুর শহরে ময়লার গাড়ি নামক স্থানে ফেলে দেয়।
বাচ্চু রাজাকার স্বরূপদিয়া, বড়দিয়া গ্রামের বিশ্বাস বাড়িতে আক্রমণ করে গোপাল বিশ্বাসসহ ৬ জনকে হত্যা করে। একই দিন অর্থাৎ একাত্তরের ১০ মে হাসামদিয়া গ্রামে প্রবেশ করে হিন্দুপাড়ার মালামাল লুটপাট করে ও ৪০/৫০টি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেখানে যোগেশ্বর সাহাসহ ৯ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয। একজনকে হাত-পা বেঁধে জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করা হয়। অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় সে মারা যায়।
বাচ্চু রাজাকার ঐ দিন বেলা সাড়ে ৮টার দিকে সহযোগী রাজাকার বাহিনী ও পাক সৈন্যদের নিয়ে ময়েনদিয়া বাজারে প্রবেশ করে। সেখানে ৭০/৮০টি দোকানে লুটপাট করে। পরে ময়েনদিয়া বাজার পুড়িয়ে দেয়। বাজারের ঘাটে হরিপদ সাহা ও পুটিয়া নামক দু'জনকে রাজাকাররা ইট দিয়ে মাথায় আঘাত করে। পরে আবুল কালাম আজাদ নিজে গুলি করে উভয়কে হত্যা করে। উক্ত বাজারের পশ্চিমে পাকিস্তানী সেনারা সুবল কয়াল ও মল্লিক ঠাকুর নামে দু'জনকে গুলি করে হত্যা করে।
একাত্তরের ১৬ মে বাচ্চু রাজাকার তাঁর শ্যালক মোহাম্মদ কাজীসহ অজ্ঞাত ১০/১২ জন রাজাকার দুপুর ১২টার দিকে মধ্য সালিথা (সাবেক নগরকান্দা) থানাধীন পূর্ব সালথা গ্রামের মন্টু বকশী ও অশ্বিনা ম-লের বাড়ির টাকা পয়সা ও স্বর্ণালঙ্কার লুটপাট করে নেয়। পুরুরা গ্রামের বিশ্বাস বাড়িতে আক্রমণ চালিয়ে মাধব বিশ্বাসকে অপহরণ করে। উক্ত স্থানে একই সময়ে রাজেন্দ্রের ছেলে জ্ঞানেন্দ্রকে ধরে এনে বাচ্চু রাজাকার নিজে গুলি করে হত্যা করে। একাত্তরের ২৭ মে বেলা তিনটার দিকে বাচ্চু রাজাকার তাঁর শ্বশুর চাঁন কাজীসহ ১০/১২ জন রাজাকার বোয়ালমারী থানার কলারন গ্রামের সুধাংশু মোহন রায় ও তার পুত্র মনিময় রায়কে ধরে আনে। বাচ্চু রাজাকার নিজে গুলি করে সুধাংশু মোহনকে হত্যা করে, গুলিতে মনিময় রায় কেষ্ট আহত হয়।
একাত্তরের মে মাসের শেষ সপ্তাহে বাচ্চু রাজাকার তাঁর সঙ্গীসহ বোয়ালমারী থানার ডহরনগর গ্রামের জীবন চক্রবর্তীকে বাড়ি থেকে অপহরণ করে পার্শ্ববর্তী রূপাপাত বাজারে বটগাছের নিচে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে। ৩ জুন সকাল ১১টায় বাচ্চু রাজাকার, মোহাম্মদ কাজী, চাঁন কাজীসহ ২০/২৫ জন রাজাকার দুটি বড় নৌকাযোগে সশস্ত্র অবস্থায় নগরকান্দা থানার ফুলবাড়িয়া গ্রামে হামলা করে ৫০/৬০টি বাড়ির মালামাল লুটপাট করে। সেখানে চিত্তরঞ্জন দাসকে গাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি করে হত্যা করা হয়। কিছুক্ষণ পর অন্য রাজাকাররা বাদল দেবনাথ নামে এক ব্যক্তিকে ধরে গুলি করে হত্যা করে।
একাত্তরের ৮ জুন বেলা ১২টা থেকে ২টার মধ্যে বাচ্চু রাজাকার বিভাগদী গ্রামের কাশেম মুন্সী রাজাকারসহ ১৪/১৫ জন অস্ত্রধারী রাজাকার বোয়ালমারী নতিবদিয়া গ্রামের সুধীর বিশ্বাসের বাড়িতে হামলা করে স্বর্ণালঙ্কার লুটপাটসহ ২ যুবতীকে ধরে নিয়ে যায়। পরে বাচ্চু রাজাকার ও তাঁর সঙ্গীরা পালাক্রমে ধর্ষণ করে। এরপর হিন্দুপাড়ায় হামলা চালিয়ে লুটপাট চালায়।
৮ আগস্ট বিকেল ৫টায় ফরিদপুর চকবাজার মসজিদের সামনে থেকে বাচ্চু রাজাকার কবির আহম্মেদ মঞ্জুরকে ধরে নিয়ে পাকিস্তান আর্মিদের কাছে সোপর্দ করে। ২১ আগস্ট ফরিদপুর টু বরিশাল সড়কের হারুকান্দি (কৈজুরী) নামক স্থানে গুলি করে হত্যা করা হয় তাকে। একাত্তরের বৈশাখের শেষ দিকে বাচ্চু রাজাকার তাঁর সঙ্গীয় ১০/১২ রাজাকারসহ সশস্ত্র অবস্থায় ফরিদপুর জেলার বোয়ালমালী থানার আমগ্রাম ও কামারগ্রামে প্রবেশ করে উভয় গ্রামের কয়েকটি বাড়িতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এরপর বাচ্চু রাজাকার গোপেন্দ্র সাহার পুত্র সঞ্জয় সাহাকে নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করে।
'ফরিদপুর শহরে ১২টি বধ্যভূমিতে যে হাজার হাজার মানুষ শায়িত আছেন তাঁদের হত্যার নির্দেশদাতা এবং নিজেও সরাসরি হত্যাকারী আবুল কালাম আজাদ। তিনি নিজে গুলি করে অসংখ্য মানুষ হত্যা করেছেন। হত্যা করে ফরিদপুর স্টেডিয়ামে মাটিচাপা দিয়েছেন, নদীতে ফেলে দিয়েছেন, শহরের বিভিন্ন স্থানে মাটিচাপা দিয়েছেন। তিনি বিভিন্ন স্থান থেকে নিজে লোকজনকে ধরে আনতেন আবার অন্যদের দিয়েও ধরিয়ে আনতেন।'
মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনালের আদেশের পর সাংবাদিকদের কাছে প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম বলেন, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের ৫টি এনজিও তাঁর নিজের স্বার্থে পরিচালিত হয়। প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক ও প্রভাবশালী হওয়ায় তিনি এসবের জোরে সাক্ষীদের হুমকি দিচ্ছেন। এসব হুমকির বিষয়ে ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানায় সাক্ষীরা জিডিও করেছেন। তদন্তের স্বার্থে তাঁকে গ্রেফতারের আদেশ দেয়ার আবেদন জানানো হলে ট্রাইব্যুনাল ওই আদেশ দেয়।
এর আগে সোমবার বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন ডেপুটি রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে জমা দেয়া হয়। ওই দিনই শুনানি শেষে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারির আদেশের জন্য মঙ্গলবার দিন ধার্য করে চেয়ারম্যান এটিএম ফজলে কবিরের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।
২০১২ সালের ২৫ মার্চ আবুল কালাম আজাদের বিচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই আন্তর্জাতিক অপরাধ বিষয়ক দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হয়। ওই দিন তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন ২ এপ্রিলের মধ্যে প্রদান করার আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। সেদিন 'বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারির বিষয়ে আবেদন জানান প্রসিকিউশন।
আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে করা দুটি মামলার নথি থেকেও জানা গেছে, ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার দাদপুর ইউনিয়নের নতিবদিয়া গ্রামের শোভা রানী বিশ্বাস একাত্তরে এই রাজাকারের কাছে সম্ভ্রম হারান। একই গ্রামের নগেন বিশ্বাসের স্ত্রী দেবী বিশ্বাসেরও সম্ভ্রমহানি হয় তার হাতে। আরও অভিযোগ রয়েছে, বাচ্চুর রাইফেলের গুলিতে মর্মান্তিকভাবে শহীদ হন ফরিদপুরের ফুলবাড়িয়ার চিত্তরঞ্জন দাস।
স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে মামলা না করলেও ২০০৯ সালের ৩ মে বাচ্চু রাজাকার ও তাঁর শ্যালক মোহাম্মদ কাজীসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে চিত্তরঞ্জন দাসের স্ত্রী নগরকান্দা উপজেলার ফুলবাড়িয়া গ্রামের জ্যোৎস্না রানী দাস মামলা দায়ের করেন। এজাহারে হত্যাকা-ের বিষয়টিও উল্লেখ রয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০১০ সালের ২৫ মার্চ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারে ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর এ পর্যন্ত বিএনপি ও জামায়াতের ৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর ২০১০ সালের ২৯ জুন জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে গ্রেফতার করা হয়। অন্যদিকে ১৩ জুলাই গণহত্যা মামলায় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং আব্দুল কাদের মোল্লাকে গ্রেফতার করা হয়। সর্বশেষ ১৬ ডিসেম্বর বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়। ২০১১ সালের ২৭ মার্চ জয়পুরহাটের বাড়ি থেকে বিএনপি নেতা আব্দুল আলীমকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি শর্ত সাপেক্ষে জামিনে রয়েছেন। অন্যদিকে ২০১২ সালের ১১ জানুয়ারি জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
ফরিদপুরে স্বস্তি
নিজস্ব সংবাদদাতা ফরিদপুর থেকে জানান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রদত্ত ফরিদপুরের কুলাঙ্গার মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ওরফে খারদিয়ার বাচ্চু রাজাকারকে গ্রেফতারের নির্দেশে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন জেলার বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা নেতৃবৃন্দসহ সর্বস্তরের মানুষ।