মুজিবনগর দিবসে যুদ্ধাপরাধীর বিচার দ্রুত সম্পন্ন, সরকারী ছুটি ঘোষণা ও অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার দাবি
বিশেষ প্রতিনিধি ॥ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুত সম্পন্ন করে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করা, মুজিবনগর দিবসকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সরকারী ছুটি ঘোষণা এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জোর দাবির মধ্য দিয়ে মঙ্গলবার রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়েছে ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস।
দেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণ ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠের ৪১ বছর পূর্তি উপলক্ষে ঐতিহাসিক এ দিনটি স্মরণে রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি স্মৃতিবিজড়িত মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননেও জাতীয়ভাবে নানা কর্মসূচী পালিত হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে আয়োজিত প্রতিটি অনুষ্ঠানেই ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবসে সরকারী ছুটি ঘোষণার দাবি উঠেছে।
মেহেরপুরের মুজিবনগর দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনাসভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, একাত্তরের মুজিবনগর সরকার কোন বিপ্লবী বা অস্থায়ী সরকার ছিল না, জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রথম সাংবিধানিক সরকার ছিল। জ্ঞানপাপিরা ইতিহাস বিকৃত করেছে। যার কারণে আমরা নতুন প্রজন্মের কাছে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে পারিনি। দেশের সব সরকারের ধারাবাহিকতায় এই মুজিবনগর সরকার। সাংবিধানিকভাবে মুজিবনগর আম্রকাননে প্রথম বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরা শপথ নিয়েছিলেন। বিরোধীদল যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তাদের ইচ্ছামতো ইতিহাস বিকৃত করেছে। এ সরকার আর কোন ইতিহাস বিকৃত করতে দেবে না।
এদিকে ঢাকায় ভোরে ধানম-ির ৩২ নম্বর ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবন, কেন্দ্রীয়সহ সারাদেশের দলীয় কার্যালয়ে দলীয় ও জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে দিবসের কর্মসূচী শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকাল ৭টায় বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে রক্ষিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করেন। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর প্রধানমন্ত্রী সেখানে এক মিনিট নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, প্রতিমন্ত্রীগণ এবং দলীয় সংসদ সদস্যবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। পরে প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দলের পক্ষে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
এ সময় সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, সভাপতিম-লীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, সতীশ চন্দ্র রায়, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খান, গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আফম বাহাউদ্দিন নাছিম, আহমেদ হোসেন, মেজবাহউদ্দিন সিরাজ, স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, মৃণাল কান্তি দাস, অসীম কুমার উকিল, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, একেএম রহমতউল্লাহ এমপি, আখতারুজ্জামান, মির্জা আজম এমপি, সুজিত রায় নন্দী, এনামুল হক শামীমসহ সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
ধানম-িতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের পর সকাল সাড়ে ৭টায় বনানী কবরস্থানে তিন জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর সমাধিতে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন। এ সময় কবর জিয়ারতসহ বিদেহীদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতারা সেখানে চিরনিন্দ্রায় শায়িত আরেক জাতীয় নেতা এইচএম কামরুজ্জামানের মাজারে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন।
বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে মানুষের ঢল
সকাল থেকেই আওয়ামী লীগ এবং এর সকল সহযোগী সংগঠন ছাড়াও অসংখ্য সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন, স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী এবং সর্বস্তরের মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর প্রাঙ্গণ। সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে। কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে ধানম-ির ৩২ নম্বর সড়ক ও এর আশপাশের এলাকা। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু ভবন ত্যাগ করার পর বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি সকলের জন্য উš§ুক্ত করে দেয়া হয়। এরপর যুবলীগ, ছাত্রলীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগ ও কৃষক লীগসহ আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে। এছাড়া স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ, মৎস্যজীবী লীগ, যুব শ্রমিক লীগ, হকার্স লীগ, তাঁতী লীগ, মুক্তিযোদ্ধা জনতা লীগ, বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ, মোটরচালক লীগ, ওলামা লীগ, জাতীয় বিদ্যুত শ্রমিক লীগ, ছিন্নমূল হকার্স লীগ, বাস্তুহারা লীগ, জয়বাংলা সাংস্কৃতিক ঐক্যজোট, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ, বঙ্গবন্ধু শিল্পী গোষ্ঠী, মুক্তিযোদ্ধা ঐক্যজোট, রিকশা-ভ্যান শ্রমিক লীগ, নির্মাণ শ্রমিক লীগসহ অসংখ্য দল ও সংগঠন এবং সর্বস্তরের মানুষ বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে।
এ সময় বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে উপস্থিত হাজার হাজার নারী-পুরুষের কণ্ঠে উচ্চারিত হতে থাকে 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু', 'জামায়াত-শিবির রাজাকার এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়', 'যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই দিতে হবে', 'মুজিবের বাংলায় খুনীদের ঠাঁই নাই' ইত্যাদি।
মুজিবনগরে মানুষের ঢল
মেহেরপুরের মুজিবনগর বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে মুজিবনগর দিবসের মূল কর্মসূচী পালিত হয়। সেখানে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, শেখ হাসিনা মঞ্চে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গার্ড অব অনার প্রদান ছাড়াও বিভিন্ন কর্মসূচী পালিত হয়।
মেহেরপুর থেকে ফজলুল হক জানান, সকালে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে মেহেরপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসক সাহান আরা বানু জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে দিনের কর্মসূচী সূচনা করেন। বেলা ১১টায় আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। বেলা সোয়া ১১টায় দলীয় পতাকা উত্তোলন করেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এবং জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। পতাকা উত্তোলন শেষে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের পক্ষ থেকে গার্ড অব অনার গ্রহণ করেন নেতারা। খুলনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক এমপির পরিচালনায় আলোচনাসভা শেষে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক পরিবেশন করা হয়।
পরে শেখ হাসিনা মঞ্চে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনাসভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ছাড়াও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব) এবি তাজুল ইসলামসহ কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা বক্তব্য রাখেন।
মোহাম্মদ নাসিম বলেন, খালেদা জিয়ার প্রথম প্রেম হলো পাকিস্তান। তাই তিনি পাকিস্তানকে ভুলতে পারেন না। খন্দকার মুশতাক আহাম্মেদ জাতির সঙ্গে বেইমানি করেছিল। আজকের বেইমান খালেদা জিয়া। শেখ হাসিনা সব হারিয়ে গণতন্ত্রকে ধরে রেখে দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন। মানুষকে জিম্মি করে হাওয়া ভবন তৈরি করেননি শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু আমাদের দিয়েছিলেন একটি বাংলাদেশ, শেখ হাসিনা সমুদ্র জয় করে দিয়েছেন আরেকটি বাংলাদেশ।
মাহাবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পদত্যাগ করে ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এতে সরকারের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হয়েছে। এ সরকার যে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয় না তার প্রমাণ মিলেছে। আমরা দৃঢ়ভাবে আশাবাদী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নয় তার প্রমাণ মিলবে। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া স্বাধীনতার ৪১ বছরে একবারও মুজিবনগরে আসেনি। বিএনপি আইএসআইর কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন তার জন্য খালেদা জিয়াকে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এবি তাজুল ইসলাম বলেন, শেখ হাসিনা না থাকলে যুদ্ধাপরাধের বিচার কেউ করবে না। কাজেই শেখ হাসিনাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আমরা আর জাতির পিতার মতো শেখ হাসিনাকে হারাতে চাই না। তিনি প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানান।