|
ঢাকা: ''আমরা দুই ভাই মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার কারণে একাত্তর সালের ১৪ আগস্ট আমার পিতা শহিদ কোবাদ আলী মাগরিবের নামাজ পড়ে বাড়ি ফেরার সময় আলবদর বাহিনীর সদস্য আজিজুল, মাসুদ, লালু, ফোরকান ও চেতনসহ আরো ৪/৫ জন বাবাকে আমাদের বাড়ির সামনে হত্যা করেন। দেশ স্বাধীনের পর আজিজুলসহ কয়েকজন রাজাকারকে ধরি। জিজ্ঞাসাবাদে আজিজুল স্বীকার করে বলেন, আলবদর বাহিনীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর নির্দেশে তারা আমার বাবাকে হত্যা করেছেন।''
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ সাক্ষ্য দিতে এসে এভাবেই নিজামীর নির্দেশে বাবাকে হত্যার ঘটনা বর্ণনা করেছেন হাবিবুর রহমান হাবিব। তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের চতুর্থ সাক্ষী।
মঙ্গলবার সাক্ষ্য দেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সন্তান হাবিবুর রহমান হাবিব। তিনি তার সাক্ষ্যে আরও বলেন, ''আমি সে সময় যুদ্ধে থাকার কারণে বাবাকে হত্যার ৩/৪ দিন পর এ খবর জানতে পাই।''
সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে এই সাক্ষীকে জেরা শুরু করেছেন আসামিপক্ষ। জেরা অসমাপ্ত অবস্থায় বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত মুলতবি করেছেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবিরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।
বর্তমানে ৫৬ বছর বয়সী সাক্ষী হাবিবুর রহমান হাবিব পাবনার বাসিন্দা। একাত্তর সালে তিনি এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে বড় ভাই ও আরও ৩/৪শ' ছাত্রের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন তিনি।
সাক্ষী বলেন, ''একাত্তর সালের ২৬ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত পাবনা পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত ছিল। ১১ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পাবনা দখল করে নেয়।"
তিনি বলেন, ''আমি এবং আমার বড় ভাই শহিদুল্লাহ এবং আমাদের সঙ্গে আরো তিন চারশ' ছাত্র ভারতে চলে যাই। সেখানে একটি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের উচ্চতর ট্রেনিং নেই।''
সাক্ষী বলেন, ''আমরা দুই ভাই মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার কারণে একাত্তর সালের ১৪ আগস্ট আমার পিতা শহীদ কোবাদ আলী মাগরিবের নামাজ পড়ে বাড়ি ফেরার সময় আলবদর বাহিনীর সদস্য আজিজুল, মাসুদ, লালু, ফোরকান ও চেতনসহ আরো ৪/৫ জন বাবাকে আমাদের বাড়ির সামনে হত্যা করেন।''
''আমি সে সময় যুদ্ধে থাকার কারণে হত্যার ৩/৪ দিন পর এ খবর জানতে পাই। দেশ স্বাধীনের পর ১৯ ডিসেম্বর আমার আত্মীয়-স্বজন ও এলাকার মানুষের কাছে খবর পেয়ে আজিজুলসহ কয়েকজন রাজাকারকে ধরি।
জিজ্ঞাসাবাদে আজিজুল স্বীকার করে বলেন, আলবদর বাহিনীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর নির্দেশে তারা আমার বাবাকে হত্যা করেছেন। এরপর আজিজুলকে থানায় সোপর্দ করি। এরপর তার কি হয়েছে তা আর জানি না।''
সাক্ষী হাবিবুর রহমান হাবিব তার বন্ধু শিবলীর বাবার হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও উল্লেখ করেন। তিনি তার সাক্ষ্যে বলেন, ''ট্রেনিং শেষে ১৯ আগস্ট দেশে ফিরে আমার বন্ধু শিবলীর কাছে শুনি, তার বাবার হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা। আমার বন্ধু শিবলী আমাকে জানান, একাত্তর সালে ৪ জুন তার বাবা মাওলানা কছিম উদ্দিন বাড়ি থেকে তাদেরকে পালাতে বলেন। কারণ, মতিউর রহমান নিজামী তার বাবাকে মেরে ফেলতে তালিকা করেছিলেন। এ সময় তিনি তার পরিবারের লোকদেরকে সাবধানে থাকার পরামর্শ দিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য মোসলেম পরামাণিকের তেমাথা নামক স্থান থেকে গাড়িতে ওঠার চেষ্টা করেন। এ সময় জামায়াতের কিছু লোকজন তাকে চিনতে পেরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নিয়ে তুলে দেন।''
সাক্ষী বলেন, ''এরপর মাওলানা সাহেবকে নূরপুরা আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। শিবলী আমাকে আরো জানান, তার বাবা মাওলানা কছিম উদ্দিনকে ক্যাম্পে নিয়ে প্রথমে শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়।''
''সে সময় শিবলী ও তার মা ভাই-বোনেরা তার বাবাকে ছাড়িয়ে আনতে আর্মি ক্যাম্পে যান। তখন তারা নিজামীকে আর্মি ক্যাম্পের গেট দিয়ে ঢুকতে দেখেন। তারা নিজামীর পায়ে ধরে মাওলানাকে বাঁচাতে আকুতি-মিনতি জানান।''
''তখন নিজামী সাহেব শিবলীর মাকে বলেন, তোমার স্বামীকে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিতে বলো গিয়ে।''
সাক্ষ্যে সাক্ষী আরও বলেন, ''মাওলানা কছিম উদ্দিন অসহযোগ আন্দোলনের সময় পাবনা জেলা স্কুলে ছাত্রদেরকে ডামি রাইফেল দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং দিতেন।
''বন্ধু শিবলী আমাকে জানান, একাত্তর সালের ১০ জুন আর্মি ক্যাম্প থেকে মাওলানা কছিম উদ্দিনসহ আরো দুই জনকে মাধবপুর ইছামতি নদীর পাড়ের বাঁশ বাগানে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।''
''হত্যার খবর পেয়ে শিবলীদের পরিবারের লোকজন সেখানে গিয়ে স্থানীয়দের কাছে শুনতে পারেন, মতিউর রহমান নিজামী হত্যার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন।''
এরপর সাক্ষী বলেন, ''একাত্তর সালের এপ্রিল থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত আলবদর, রাজাকার এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে পাবনার প্রায় ৫০ হাজার লোক শহীদ হন। হাজার খানেক মা-বোনের সম্ভ্রমহানি হয়। হাজার হাজার ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সে সময় ৮/১০ লাখ লোক ভারতে আশ্রয় নেন।''
''পাবনার ডেমরা, ধুলাউড়ি, আটঘরিয়া, পাকশি, রাজপুর, ওয়াপদা পাম্প হাউজ, সাতঘরিয়া এবং পাবনা সদরের ভাড়ারা ইউনিয়নসহ অনেক স্থানে আলবদর, রাজাকার ও হানাদার বাহিনী সম্মিলিতভাব হত্যাযজ্ঞ চালায়।''
''মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক আলবদর, রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা ধরা পড়েন। তাদের কাছে মতিউর রহমান নিজামীর স্বাক্ষরিত আইডি কার্ড পাওয়া যায়।''
সাক্ষী বলেন, ''এছাড়া একাত্তর সালে নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে নাজিরপুর, হেমায়েতপুর ইউনিয়নে আলবদর বাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনী সম্মিলিতভাবে হামলা চালিয়ে ১৭৫ জনকে হত্যা করে। সেখানে এখনো অনেক গণকবর আছে।''
সাক্ষ্যগ্রহণের সময় মতিউর রহমান নিজামীকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। সাক্ষী হাবিব নিজামীকে তার বাবা ও বন্ধুর বাবাকে হত্যাসহ পাবনায় গণহত্যাসহ নানা মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য অভিযুক্ত ও চিহ্নিত করেন। এ সময় আসামির ডকে থাকা নিজামীকে সনাক্তও করেন তিনি।
পরে সাক্ষীকে জেরা শুরু করেন নিজামীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম। জেরা বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত মুলতবি করেন ট্রাইব্যুনাল।
গত বছরের ২৬ আগস্ট শুরুর পর এ পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষের আরও ৩ জন সাক্ষী নিজামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তারা হচ্ছেন, বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মিজবাউর রহমান চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধকালে বিচ্ছু বাহিনীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা গেরিলা যোদ্ধা জহির উদ্দিন জালাল ওরফে বিচ্ছু জালাল ও মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী (নিরাপত্তারক্ষী) রোস্তম আলী মোল্লা। আসামিপক্ষ তাদের জেরা সম্পন্ন করেছেন।
উল্লেখ্য, গত বছরের ২৮ মে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৬টি অভিযোগ এনে নিজামীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ), ৩(২)(সি), ৩(২)(জি), ৩(২)(এইচ), ৪(১), ৪(২) ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়। তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, লুট, ধর্ষণ, উস্কানি ও সহায়তা, পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র এবং বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ মোট ১৬টি ঘটনায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগের মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন মতিউর রহমান নিজামীকে গ্রেফতার করা হয়। পরে একই বছরের ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।
২০১১ সালের ১১ ডিসেম্বর মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষ। এতে তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হত্যা, খুন, ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ আনা হয়।
এ বিষয়ে প্রসিকিউশন ৩৩৬ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে। আর আনুষঙ্গিক কাগজপত্রসহ প্রায় আড়াই থেকে ৩ হাজার পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট তৈরি করা হয়।
গত বছরের ৯ জানুয়ারি নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। এতে মোট ১৫টি অভিযোগ ছিল। অভিযোগ গঠনকালে বুদ্ধিজীবী হত্যা যোগ হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০১৩
জেএ/জেপি/এমএইচপি/ সম্পাদনা: অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর- eic@banglanews24.com
http://www.banglanews24.com/detailsnews.php?nssl=8493a68ae987a49e95bf6cd67c25eb29&nttl=16042013189355
তদন্তদলের কাছে সাক্ষ্যনিজামীর নির্দেশে সাঁথিয়ায় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চলে পাবনা ও আঞ্চলিক প্রতিনিধিhttp://www.kalerkantho.com/index.php?view=details&type=gold&data=Tax&pub_no=335&cat_id=1&menu_id=14&news_type_id=1&index=1&archiev=yes&arch_date=07-11-2010#.UW0qW6Ku8vw
Nov 7, 2010 – তাছাড়া মাওলানা নিজামীর নির্দেশে করমজা গ্রামে গণহত্যা চালায় তৎকালীন জামায়াত নেতা এবং যুদ্ধাপরাধী সিরাজ ডাক্তারের ছেলে এএম রফিকুন্নবী। ... মুক্তিযোদ্ধা ও প্রত্যক্ষদর্শী শাহজাহান আলী তদন্ত দলকে জানান, ১৯৭১ সালে নিজামীর নির্দেশে রাজাকাররা তাকে ধরে নিয়ে জবাই করার জন্য গলায় ছুরি চালিয়েছিল। ঘাতকরা ...
Sep 9, 2010 – নিজামীর নির্দেশে পাবনায় গণহত্যা. জাকিয়া আহমেদ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ও শাহীন রহমান, জেলা প্রতিনিধি বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডি. ঈশ্বরদী (পাবনা): আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সদস্যরা শুক্রবার দুপুরে ঈশ্বরদীর পাকশীতে গিয়ে তদন্ত কাজ করেছেন। প্রথমে তারা যান রেলওয়ে কলোনীতে। সেখানে ডা. রফিক আহমেদ ও ... স্টাফ রিপোর্টার: মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় গ্রেফতার জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের প্রথম সাক্ষী বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান চৌধুরীর (৫৭) জেরা করেছেন নিজামীর আইনজীবী। জেরাকালে সাক্ষীর কাছে জানতে চাওয়া হয়, মতিউর রহমান নিজামী কী আলবদর বাহিনীর ...