মালাউন বলে বেগম রোকেয়াকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারিনি: সুভাষ দত্ত
টাইমস্ আই বেঙ্গলী ডটকম: দেশের কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্ত আর আমাদের মাঝে নেই। ১৬ নভেম্বর শুক্রবার সকালেই তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। সুভাষ দত্তের মৃত্যুতে চলচ্চিত্র ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। দেশ হারালো কালজয়ী এক চলচ্চিত্রকারকে। গেল মাসের হেমন্তের এক সকালে গোপীবাগের রামকৃঞ্চ মিশন রোডের সুভাষ দত্তের বাসায় হাজির হলাম। উদ্দেশ্য জীবন্ত কিংবদন্তী সুভাষদা'র একটি সাক্ষাৎকার নেয়া। ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল সাড়ে নটা। দরজায় ঘন্টায় সংকেত দিলে সুভাষদার বোন সামনে আসলেন। তিনি জানান, দাদা দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে মৌনব্রত পালন করে আসছেন। সকাল দশটার আগে তিনি কারো সাথে কোন কথাই বলেন না। খুব বেশী প্রয়োজন হলে ইশারা করেন। ছো্ট বৈঠকখানা। আভিজাত্য নেই কোথাও। কিন্তু কক্ষজুড়ে নান্দনিকাতার ছোঁয়া। দেয়ালে টানানো প্রয়াত বাবা-মার ছবি। দক্ষিণাংশে পূরানো দিনের তৈরী কাঁচ-আলমিরা। আলমিরার বিভিন্ন কক্ষে সারি সারি সাজানো রয়েছে এ পর্যন্ত পাওয়া অনেকগুলো চলচ্চিত্র পুরস্কার। কিন্তু দেয়ালে নকশীতে ফুল তোলা কাপড়ের হাতপাখা। পরে জানতে পারলাম, সুতারাং, ছবিতে নায়িকা কবরী যে হাতপাখা দিয়ে নায়ককে বাতাস করেছে সেটিত সাজিয়ে রেখেছেন দত্তদা।
মৌনব্রত শেষে আসলেন সুভাষদা। আড্ডা দিতে দিতে সাক্ষাৎকারের কাজটিও সেরে নিচ্ছিলাম। খেয়াল করলাম, বয়সের কারণে বর্ণাঢ্য যাপিত জীবনের অনেক কিছুই সুভাষদা ভুলে গেছেন। খেই ধরিয়ে দিলেই আবার ফিরে যান তার সোনালী অতীতে। সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে আক্ষেপ করে সুভাষ'দা বললেন, মীনা পালকে কবরী বানিয়ে ফিল্মে আনলাম। কবরী এখন আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী সংসদ সদস্য অথচ একবারও আমার খবর নেয়নি। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। আমার খবর কে রাখে। তবে মাঝে মধ্যে অপু বিশ্বাস আমার খোঁজ-খবর নেয়।
দেশের বর্তমান চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এক সময় পাকিস্তানের উর্দু ফিল্মের সাথে পাল্লা দিয়ে আমরা ছবি বানিয়েছি। হল ভর্তি দর্শক ছিল। চলচ্চিত্রের সোনালী অতীতকে ফিরিয়ে আনতে হলে প্রেক্ষাগৃহে দর্শক টানতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন ভাল গল্প ও কাহিনী এবং সুস্থধারার চলচ্চিত্র। আলমগীর কবির ও তারেক মাসুদের অকাল মৃত্যুতে দেশের চলচ্চিত্র জগতের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে উল্লেখ করে দত্তদা বলেন, তারা দেশকে আরো অনেক কিছু দিতে পারতেন।
দীর্ঘ চলচ্চিত্র জীবনের সুখকর স্মৃতিগুলি সম্পর্কে দত্তদা বলেন, পরিচালক ও প্রযোজক হিসেবে মানুষ যতখানী চেনে তারচেয়ে বেশী জনপ্রিয় অভিনেতা হিসেবে। তালাশ ছবি মুক্তি পাওয়ার পর রিকশাওলাদের কাছে আমি অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলাম। এফডিসিতে যেতে অনেক রিক্সাওয়ালা আমার কাছে যেতে টাকা নিতনা। বলতেন, আপনিতো আমাদেরই লোক। মক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র অরুণাদ্যয়ের অগ্নিসাক্ষী দেখার পর ভারতের বরণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় আমার পিঠে থাপ্পর দিয়ে বলেছিলেন, আজ থেকে তুই দত্তজিৎ। সুভাষ দত্ত বললেন, জীবনে অনেক পুরস্কার পেয়েছি; কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের দেয়া দত্তজিৎ খেতাবটিই হচ্ছে আমার জীবনে শ্রেষ্ট অর্জন।
জীবনের শেষ ইচ্ছা সম্পর্কে সুভাষদা বললেন, বাঙ্গালী নারী জাগরণের পথিকৃত বেগম রোকেয়ার জীবনী নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের সব প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। বেগম রোকেয়ার নাম ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য শাবানাও রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু প্রযোজক না পাওয়ায় অনেক বছর ধরে হাত গুটিয়ে বসে ছিলাম। আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকারে আসার পর সরকারী অনুদানের জন্য বেগম রোকেয়া চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য জমা দেই। কিন্তু সরকারী অনুদান কমিটির একজন আমাকে বললেন, ''মালাউনের বাচ্চা সুভাষ দত্তের এত খায়েশ কেন, মুসলিম নারী বেগম রোকেয়াকে নিয়ে ছবি করার''।
তিনি আক্ষেপ করে বললেন, এ দেশে মালাউন হয়ে জম্ম নেয়া কি পাপ? সকলের প্রিয় সুভাষ দত্ত সরকারী অনুদানের জন্য ছবির চিত্রনাট্য আর জমা দেবেন না। তার মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হয় সর্বস্তরের মানুষের শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। ফুলে ফুলে ছেঁয়ে যায় সুভাষ দত্তের মরদেহ। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকে যাবে মালাউনের বাচচা এই অপবাদ নিয়ে চিতার আগুনে ছাই হয়ে যাবে বাংলা চলচ্চিত্রের এক কিংবদন্তী নিথর দেহ।
__._,_.___