হাজার নারীকণ্ঠে একই স্লোগান
হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা মানি না, মানব না
নিজস্ব প্রতিবেদক | তারিখ: ১১-০৫-২০১৩
জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে প্রতিবাদী নারী গণসমাবেশের মঞ্চ। মঞ্চ থেকে একটু পরপর স্লোগান উঠছে, 'হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা মানি না, মানব না।' প্রেসক্লাবের সামনের সড়ক বিভাজনের দুই পাশের গণসমাবেশ থেকেও হাজার কণ্ঠে একই স্লোগান।
আজ শনিবার হেফাজতে ইসলামের অসাংবিধানিক ১৩ দফার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী নারী গণসমাবেশে এই স্লোগানের পাশাপাশি হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে যারা নারীর মানবাধিকার খর্ব করতে চায়, সেসব ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি তোলা হয়। একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের বিচার সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে যত বাধাই আসুক, তা প্রতিহত করারও অঙ্গীকার করেন সমাবেশে অংশগ্রহণকারীরা। জাতীয় সংগীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে সমাবেশ শুরু হয়।
সমাবেশ মঞ্চের একজন হেফাজতে ইসলামকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, নারীদের মাত্র একটি অংশ সমাবেশে হাজির হয়েছে। সারা দেশের নারীরা একত্র হলে কী অবস্থা হবে, তা ভেবে দেখতে হবে।
তৃণমূলের সংগঠনসহ প্রায় ৫০০-৬০০ সংগঠনের প্রতিনিধিরা হাতে প্ল্যাকার্ড, ব্যানার নিয়ে সমাবেশে অংশ নেন। সমাবেশ আয়োজকদের মতে, পূর্বনির্ধারিত এ সমাবেশে পোশাক শিল্পকারখানার শ্রমিক, দলিত নারী, আদিবাসী নারীসহ বিভিন্ন পেশা-শ্রেণীর তিন হাজারের বেশি মানুষ অংশ নেন। সমাবেশ উপলক্ষে প্রেসক্লাবের আশপাশে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এ ছাড়া প্রেসক্লাবে যাওয়ার জন্য পল্টন মোড় ও কদম ফোয়ারার সামনে দিয়ে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন। তিনি বলেন, নারীরা যখন এগিয়ে চলেছে, জাতিসংঘ এ কারণে যখন প্রশংসাপত্র দিচ্ছে, সেই সময় দেশের রাজনীতিতে হেফাজতে ইসলাম নামে একটি আগাছা জন্ম নিয়েছে। এই আগাছা দলটি ১৩ দফার নামে যে দাবি তুলেছে, সূচনাতেই তা নির্মূল করতে হবে।
হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের দিন সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে হেফাজতের কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত সাংবাদিক নাদিয়া শারমিনের কথা উল্লেখ করে আয়শা খানম বলেন, নাদিয়ার ওপর যারা আক্রমণ করেছে, তাদের দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া হবে।
সমাবেশে ঘোষণাপত্র পড়ে শোনান জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ফওজিয়া খোন্দকার। ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, জাতীয় স্বার্থে, জাতির অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য নারীর বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে হবে। নারীর বিরুদ্ধে সব ধরনের সহিংসতা বন্ধ করা এবং নির্যাতনে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এ ঘোষণাপত্রে ১০ দফা দাবি জানানো হয়েছে।
সংহতি প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফায় নারী ও পুরুষের মধ্যে বিভাজন তৈরির চেষ্টা চালানো হয়েছে। অথচ জাতীয় সংবিধানে নারী-পুরুষে বিভাজন নেই, কার কী ধর্ম, তাতেও বিভাজন নেই। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাইরে আর কোনো রাষ্ট্রীয় দর্শন বা আদর্শ থাকতে পারে না।
মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল সরকারের উদ্দেশে বলেন, নির্বাচনের আগে ৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার অঙ্গীকার করলেও সরকার তা করেনি। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামসহ জনবিরোধী ও নারীবিরোধী ধারাগুলো রয়েই গেছে।
নারীনেত্রী শিরীন আখতার বলেন, 'হেফাজতে ইসলাম বলেছে নারীনীতি চলবে না। ১৩ দফার কথা শুনে আমরা অবাক হলাম। বিনয়ের সঙ্গে প্রশ্ন করতে চাই, হজ করতে তো নারী-পুরুষ এক সঙ্গেই যান। অবশ্য এ বিষয়ে শফী হুজুরই ভালো বলতে পারবেন।'
একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী এবং নিজে মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বাস করলে হেফাজতদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার জন্য বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার প্রতি শিরীন আখতার আহ্বান জানান।
আদিবাসী ও কৃষক নারীর প্রতিনিধি রেবেকা সরেন বলেন, 'হেফাজতে ইসলাম নারীদের ঘরের ভেতরে আবদ্ধ করে রাখতে চায়। তাদের বলতে চাই, সতর্ক হয়ে যান। দ্বিতীয়বার কোনো কথা বললে জিহ্বা কেটে রেখে দেব।'
শহীদজায়া শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী বলেন, 'নারী-সমাজ ১৩ দফা কেন, ৫০ দফা করলেও তা মেনে নেবে না এবং তা এ দেশে বাস্তবায়িত হবে না।'
আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী তুরিন আফরোজ বলেন, 'ইসলাম রক্ষার দায়িত্ব কেন শুধু নারীদেরই বহন করতে হবে? একাত্তরে নারীদের যারা ধর্ষণ করেছে, সে সময় ইসলাম বা মানবতাবোধ কোথায় ছিল?' ইসলামকে হেফাজতের নামে হেফাজতে ইসলাম যেসব কথা বলছে, তা ইসলাম সমর্থন করে না বলেও উল্লেখ করেন এ আইনজীবী।
শ্রমিকনেত্রী লাভলী ইয়াসমীন বলেন, 'হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কোনো ভূমিকা রাখে না। তারা মধ্যপ্রাচ্য থেকে টাকা এনে নারীদের ঘরে অবরুদ্ধ করতে চায়। পোশাকশিল্প কারখানার ৪০ লাখ শ্রমিকের সঙ্গে তাঁদের পরিবারে আরও পাঁচ কোটি মানুষ যুক্ত। তাই হেফাজতে ইসলামকে এখন থেকেই সাবধান হয়ে যেতে হবে।'
শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের আহ্বায়ক ইমরান এইচ সরকার বলেন, গণজাগরণ মঞ্চ প্রথম থেকেই হেফাজতে ইসলামের অসাংবিধানিক ১৩ দফা দাবির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
সাংসদ আশরাফুন নেসা মোশাররফ, জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান মমতাজ বেগম, সালমা আলী, রোকেয়া কবির, খুশী কবির, হাজেরা সুলতানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গীতিআরা নাসরিন, কণ্ঠশিল্পী মিতা হক, অনিন্দ সাহা, চৈতালী ত্রিপুরা, শ্রমিকনেত্রী নাজমা আক্তার প্রমুখ সমাবেশে বক্তব্য দেন।
এ ছাড়া লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, নারীনেত্রী মাহফুজা খানম, ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেলসহ বিভিন্ন পেশা-শ্রেণীর প্রতিনিধিরা সমাবেশে সংহতি জানান।
সমাবেশে সাভারের রানা প্লাজায় নিহত শ্রমিকদের স্মরণে শোক প্রস্তাব এবং দাঁড়িয়ে সবাই এক মিনিট নীরবতা পালন করেন।
http://prothom-alo.com/detail/date/2013-05-11/news/351470
Related:
হেফাজতের নিগ্রহের শিকার নারী সাংবাদিকরা (আপডেটেড)সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | ||
ঢাকা: ওরা আমাকে পরিকল্পিতভাবে গণপিটুনি দিয়ে হত্যার চেষ্টা করেছিল। সহকর্মীরা এগিয়ে না আসলে ওরা আমাকে মেরে ফেলতো। পল্টন মোড় থেকে বিজয়নগর পর্যন্ত ওরা আমাকে মারতে মারতে ছয় থেকে সাত বার ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে এলোপাতাড়ি লাথি মারে। উঠে দৌড়ানো শুরু করলে পেছন থেকে আবার ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়, মাথায় লাথি মারে। বারবার তারা আমার কাপড় টেনে হিঁচড়ে কিল ঘুষি মারে। শনিবার দায়িত্ব পালনকালে হেফাজতে ইসলামের লোকজনের নির্মমতার শিকার একুশে টেলিভিশনের স্টাফ রিপোর্টার নাদিয়া শারমিন এভাবে বাংলানিউজের কাছে হামলার ঘটনার বর্ণনা দেন। http://www.banglanews24.com/detailsnews.php?nssl=11ec302aa0da18be3fe87f447644e0e7&nttl=07042013187227 |
নাদিয়া শারমিনের উপর হামলার ঘটনায় মামলা
সিনিয়র ও স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
__._,_.___