জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ মিররের প্রতিবেদন মন গড়া ভিত্তিহীন। এমন প্রতিবেদন দায়িত্বশীল সংবাদ মাধ্যমের কাছ থেকে অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত বলে উল্লেখ করেছে সেনা কর্তৃপক্ষ। সাভারের ওই দুর্ঘটনায় নবম পদাতিক ডিভিশন তাৎক্ষণিক উদ্ধার তৎপরতায় নেমে পড়ে। রেশমাকে ঘটনার ১৭ দিন পরে উদ্ধার করা হয়। এই সত্য দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট। এ নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেশ ও সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করা হয়েছে। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) মিররের প্রতিবেদনের প্রতিবাদ জানিয়েছে। এদিকে আন্তর্জাতিক বেশ কয়েকটি সংবাদ মাধ্যম বাংলাদেশ নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে নানা বিষয়ে অপপ্রচার চালিয়ে আসছে। রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে বহুল আলোচিত রেশমা উদ্ধার অভিযানের বিষয়টি সেই অপপ্রচারের একটি অংশ। দেশবিরোধী একটি গোষ্ঠী এই অপপ্রচারের জন্য অর্থসহ মন গড়া তথ্য দিয়ে এসব করাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধী বিচার থেকে শুরু করে গার্মেন্টস শিল্পের জিএসপি সুবিধা বাতিলের বিষয় নিয়ে ওই গোষ্ঠী বিদেশী কয়েকটি চিহ্নিত সংবাদ মাধ্যম একের পর এক নেতিবাচক প্রতিবেদন প্রকাশ করিয়েছে। এতে শুধু সরকারের ক্ষতিই করা হচ্ছে নাÑ দেশের মানুষের সবচেয়ে বড় ক্ষতি করা হচ্ছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া দৈনিক আমার দেশ কাগজের অনলাইনে রেশমাকে নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন হুবহু ব্রিটেনের প্রভাবশালী পত্রিকা ডেইলি মিরর ও ডেইলি মেইলে প্রকাশ করা হয়েছে। মিররের প্রতিনিধি সিমন রাইট দিনাজপুরে রেশমার বাড়িতে গিয়ে ছিলেন। মূল প্রতিবেদন লিখেছেন, আমার দেশের প্রতিবেদক শিশির আব্দুল্লাহ। ওই প্রতিবেদনটি মিরর ও ডেইলি মেইলে প্রকাশ করা হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বাংলাদেশ নিয়ে এমন ষড়যন্ত্র চলছেই। রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে রেশমা উদ্ধারের ঘটনাকে মিথ্যা অভিহিত করে প্রতিবেদন লেখা ব্রিটিশ সাংবাদিক সিমন রাইটের বিরুদ্ধে অতীতেও নাটক সাজানোর অনেক অভিযোগ রয়েছে।
মিররের প্রতিবেদন নিয়ে সোমবার মন্ত্রিপরিষদ কঠোর প্রতিবাদ জানানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদে মিররের প্রতিবেদন নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে সেখানে একাধিক মন্ত্রী বলেন, এই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে শক্তভাবে প্রতিবাদ করা উচিত। একটি ভিত্তিহীন প্রতিবেদন প্রকাশ করে আমাদের সাফল্যকে ম্লান করতে চায়। আমাদের শক্তিশালী মিডিয়া ও দেশের সাধারণ মানুষ জনগণ এ উদ্ধার কাজ পর্যবেক্ষণ করেছে। হাজার হাজার মানুষের সামনে রেশমাকে উদ্ধার করা হয়। যা দেশে-বিদেশে প্রশংসা পেয়েছে। এত বড় সাফল্যকে ধূলিসাত করতে মিরর এই অপপ্রচার চালিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে আমার দেশ পত্রিকাকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের জোরাল অবস্থানের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ব্রিটেনে অবস্থিত হাইকমিশনের মাধ্যমে মিররের প্রকাশিত প্রতিবেদনের কঠোর প্রতিবাদ জানানো হবে।
সরকারের একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে, আমার দেশ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তারা অনলাইনে সরকারবিরোধী নানা অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে তারা সারাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি ও যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে অবস্থান নেয়। পত্রিকাটি শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চকে নাস্তিক হিসেবে আখ্যায়িত করে নানা অপপ্রচার চালায়। এতে সারাদেশে চরম অরাজকতা দেখা দেয়। যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর ফাঁসির রায়কে কেন্দ্র করে ডাহা মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করে দেশের মানুষকে দুটি শিবিরে বিভক্ত করে ফেলে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভাংচুর, লুটতরাজ, মানুষ হত্যাসহ নানা অপরাধ ঘটায় যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের শক্তি। সেই পত্রিকার অনলাইনে প্রকাশিত প্রতিবেদন হুবহু প্রকাশ করে মিরর তার গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। যদিও মিরর ও ডেইলি মেইল ব্রিটেনে জনপ্রিয় 'ট্যাবলয়েট' হিসেবে পরিচিত। কিন্তু তাদের অতীত ইতিহাস খুব বেশি ভাল না। কারণ এই কাগজগুলো বিভিন্ন সময় এমন সব প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যা পরবর্তীতে ক্ষমাও চেয়েছে। রেশমাকে উদ্ধার নিযে যে মিথ্যা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেÑ এ নিয়েও তাদের ক্ষমা চাইতে হবে। কারণ রানা প্লাজার উদ্ধার অভিযান পরিচালিত হয়েছে সাভার ক্যান্টমেন্টের জিওসি মেজর জেনারেল চৌধুরী হাসান সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে। এ ঘটনাকে তারা সাজানো নাটক হিসেবে উল্লেখ করেছে। এত বড় মিথ্যা প্রচার সংবাদপত্রের নীতির পরিপন্থী। পত্রিকাটি সেনাবাহিনী সম্পর্কে ভিত্তিহীন বানোয়াট বক্তব্য উপস্থাপন করেছে। গোটা জাতি রেশমার উদ্ধার অভিযানটি মিডিয়ার মাধ্যমে দেখেছে। এখানে লুকানো ছাপানোর কিছু নেই। উদ্ধার অভিযানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রথম কাজটি করে আমার দেশ পত্রিকার অনলাইন। শিশির আব্দুল্লাহর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটিই হচ্ছে মন গড়া ভিত্তিহীন। উদ্ধার অভিযানের সময় সাভারে রানা প্লাজার সামনে সংবাদ মাধ্যমের শতাধিক প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। শিশির আব্দুল্লাহ সেই সময় রানা প্লাজার সামনে ছিলেন কিনা এ নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থাটি পুরো ঘটনাটি তদন্ত করছে। ঘটনাটি দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। এই রাষ্ট্রদ্রোহি কাজের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। কারা মিররের প্রতিবেদককে টাকা দিযে দেশে এনেছে তাদের ব্যাপারেও খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। প্রাথমিক তদন্তে ওই সংস্থা এ ঘটনার পিছনে জামায়াতের সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছে। জামায়াতের টাকায় যে মিররের প্রতিবেদক সিমন রাইট বাংলাদেশে এসেছে এমন সন্দেহ তারা উড়িযে দেয়নি। গোয়েন্দা তদন্তে সব সত্য উঠে আসবে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
মিরের প্রতিবেদক সিমন তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন সরকারবিরোধী পত্রিকা দৈনিক আমার দেশের সাংবাদিকরা রেশমার ঘটনাটি যাচাই করেছেন। রেশমা ঘটনার দিনই বেরিয়েছিলেন। তাকে এনাম হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিল। রেশমার সঙ্গে বেঁচে যাওয়া এক সহকর্মী ও রানা প্লাজার আশপাশের রাস্তায় যাদের দিন কাটে তারা বলেছেন, রহস্যময় ওই উদ্ধার অভিযানের আগে তাদের সেখান থেকে উঠিয়ে দেয়া হয় জোর করে। কোন ব্যাখ্যা না দিয়ে তার পরের দিন তাদের স্ব স্ব স্থানে ফেরার অনুমতি দেয়া হয়। একই সঙ্গে উদ্ধার অভিযানের দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী না করতে ২৪ ঘণ্টার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এছাড়া রেশমার শারীরিক অবস্থা, তার পোশাকের অবস্থা দেখেও প্রশ্নের উদ্রেক হয়। এই তথ্য আমার দেশ অনলাইনে গত কয়েকদিন আগে ছাপা হয়েছে। একই তথ্য মিররেও প্রকাশ করা হয়েছে। এ থেকে প্রমাণিত হচ্ছে, মিররের প্রতিবেদনটি দেশবিরোধী একটি গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র। মিররের প্রতিবেদনটি ঢাকার কয়েকটি সংবাদ মাদ্যম ফলাও করে প্রচার করে দেশের আরও বড় ক্ষতি করেছে।
ব্রিটিশ সাংবাদিক সিমন রাইট দক্ষিণ আফ্রিকায় ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত ফুটবল বিশ্বকাপের নিরাপত্তাকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে নাটক সাজিয়েছিলেন ট্যাবলয়েড সানডে মিররের। ওই অভিযোগে তাকে গ্রেফতারের খবরও সে সময় প্রকাশ করে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (বিবিসি)। রবিবার সানডে মিররে 'এক্সক্লুসিভ' হিসেবে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে রেশমা বেগমকে উদ্ধারের ঘটনার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। ২৪ এপ্রিল নয় তলা রানা প্লাজা ধসে পড়ার ১৭ দিন পর রেশমাকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।
বিবিসির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকায় আয়োজিত বিশ্বকাপের নিরাপত্তা ব্যবস্থা মানসম্মত নয়Ñ এটি প্রমাণ করতে পাভলোস জোসেফ নামে এক সমর্থককে ইংল্যান্ড ফুটবলে দলের ড্রেসিং রুমে প্রবেশের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন সিমন। আলজেরিয়ার সঙ্গে ম্যাচ শেষে ইংল্যান্ড ড্রেসিং রুমে প্রবেশের দায়ে ওই সমর্থককেও গ্রেফতার করা হয়। সানডে মিররও সে সময় সিমনের গ্রেফতার হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছিল। অবশ্য সিমনের বিরুদ্ধে নাটক সাজানোর বিষয়টি অস্বীকার করেছিল পত্রিকাটি। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার পুলিশ কমিশনার ভেকি সেলে বলেছিলেন, ক্লোড সার্কিট ক্যামেরায় পাওয়া ড্রেসিং রুমের ফুটেজ থেকে বোঝা যাচ্ছিল যে বিষয়টি সাজানো। বিশ্বকাপের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে ফেলতেই এ কাজ হয়েছে বলে পুলিশ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। সমর্থক পাভলোসকে যখন গ্রেফতার করার জন্য পুলিশ খুঁজছিল তখন তাকে আশ্রয় দিয়ে তার সাক্ষাতকার নেয়ার কথা স্বীকার করেছেন সিমন রাইট। ওই সময় মিথ্যা তথ্য দিয়ে পাভলোসের জন্য একটি বিলাসী হোটেলে রুমও ভাড়া করেছিলেন সিমন। সানডে মিররের রেশমা বিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়, রানা প্লাজা ধসের দিন রেশমা তার (ওই সহকর্মী) সঙ্গে ধ্বংসস্তূপ থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। তারা দুইদিন হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। এরপর রেশমা নিখোঁজ হন। আর দুর্ঘটনার ১৭ দিন পর রেশমাকে দেখা যায় ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করে আনা হচ্ছে।'
অন্যদিকে, মিররের এ বক্তব্যকে 'হাস্যকর ষড়যন্ত্র' বলে মন্তব্য করেছেন এনাম মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. মোঃ এনামুর রহমান। ভবন ধসের ওই ঘটনায় বিনা অর্থে হাজার হাজার পোশাককর্মীকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত এনাম হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা বলেন, হাসপাতালের রেজিস্টারে কোথাও 'রেশমা' নামে কোন রোগীর নাম নেই। অথচ আমাদের হাসপাতালে ২ দিন চিকিৎসা নেয়ার পর সে মিসিং হয়েছে বলে উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। এটি হাস্যকর। রেশমা যদি নিখোঁজই হত তবে তার আত্মীয়স্বজন নিশ্চয়ই তাৎক্ষণিক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের জবাব চাইত। ওই সময় সাভারে দেশী-বিদেশী গণমাধ্যমেরও সরব উপস্থিতি ছিল। আমাদের হাসপাতাল থেকে কোন রোগী নিখোঁজ হয়ে গেলে সেটিও সংবাদ শিরোনাম হত। এমন কোন কিছুই হয়নি। রেশমাকে নিয়ে যারা মিথ্যা ভিত্তিহীন খবর প্রকাশ করেছেÑ তা সত্যিই দুঃখজনক এবং এটি দেশের বিরুদ্ধে একটা বড় ধরনের ষড়যন্ত্র।
সাভার রানা প্লাজা ভবন ধসে আটকা পড়া রেশমাকে উদ্ধার সম্পর্কে প্রকাশিত বিভ্রান্তিকর প্রতিবেদন প্রসঙ্গে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতরের (আইএসপিআর) বক্তব্য সাভার রানা প্লাজা ভবন ধসে আটকা পড়া গার্মেন্টস কর্মী রেশমার উদ্ধার সম্পর্কে গত ৩০ জুন ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড 'সানডে মিরর' পত্রিকা প্রকাশিত একটি বিভ্রান্তিমূলক প্রতিবেদনকে উদ্ধৃত করে কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে ১ জুলাই অপরিনামদর্শী ও অমানবিকভাবে মন গড়া প্রতিবেদন প্রকাশ করেÑ যা দায়িত্বশীল সংবাদ মাধ্যমের নিকট হতে অনাকাক্সিক্ষত এবং অনভিপ্রেত। এসব বিভ্রান্তিকর প্রতিবেদনের প্রতিবাদে একটি বিস্তারিত বিবৃতি সংশ্লিষ্ট সকলের জ্ঞাতার্থে উপস্থাপন করা হলো।
গত ২৪ এপ্রিল সাভারের ৯ তলা বিশিষ্ট রানা প্লাজা আকস্মিকভাবে ধসে পড়ে। দুর্ঘটনার পরপরই সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসির নেতৃত্বে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষিত সেনা সদস্যগণ এবং ফায়ার সার্ভিস, স্থানীয় জনগণ ও স্বেচ্ছাসেবকদের সহযোগিতায় ধসে পড়া ভবনে আটকা পড়া মানুষকে উদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেন। উদ্ধারকারীরা আটকা পড়া জীবিতদের উদ্ধারের ব্যাপারে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেন। উক্ত ভবনে কয়েকটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির ইউনিট থাকায় সেখানে আটকে পড়াদের অধিকাংশই গার্মেন্টস কর্মী ছিলেন। এই উদ্ধার কাজ দুর্ঘটনার দিন হতে অর্থাৎ ২৪ এপ্রিল ১৩ মে ২০১৩ পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে পরিচালনা করা হয়েছিল। উদ্ধার স্থলে দেশী-বিদেশী মিডিয়ার অবাধ বিচরণ ছিল। কোন কোন টিভি মিডিয়া উদ্ধার তৎপরতা সরাসরি সম্প্রচার করেছিল।
উদ্ধার কাজ চলাকালে ২৮ এপ্রিল আরেকটি হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছিল। উদ্ধারকর্মীরা নিজের জীবনের নিরাপত্তা উপেক্ষা করে শাহিনা নামের আটকা পড়া একজন গার্মেন্টস কর্মীকে উদ্ধারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টার শেষ মুহূর্তে হঠাৎ করে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। এর ফলে তাকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এই উদ্ধার কাজে নিবেদিত উদ্ধার কর্মী ইজাজ কায়কোবাদ মারাত্মকভাবে আহত হয়ে কয়েকদিন পর মৃত্যুবরণ করেন। ঝুঁকি সত্ত্বেও আরও অনেককে যেন উদ্ধার করা যায়Ñ এই আশায় ২৮ এপ্রিল রাত ১২টার দিকে উদ্ধার কাজের ২য় পর্যায় অর্থাৎ যান্ত্রিক উদ্ধার কাজ শুরু করা হয়েছিল। এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন যে, ভিতরে কতজন আটকা পড়ে আছে এর সঠিক পরিসংখ্যান কারও কাছেই ছিল না। তবে উদ্ধার কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে ৯ম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি এবং আইএসপিআর সময়ে সময়ে মিডিয়াকে অবহিত করে যাচ্ছিল। এছাড়াও দুর্ঘটনাস্থলে ৯ম পদাতিক ডিভিশন কর্তৃক স্থাপিত অস্থায়ী কন্ট্রোল রুম সব সময়ের জন্য খোলা রাখা হয়েছিল, যেখান থেকে মিডিয়া কর্মীসহ যে কেউ উদ্ধার কাজের আপডেট যে কোন সময় সংগ্রহ করতে পারত।
এখানে উল্লেখ্য, উদ্ধার কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার সুবিধার্থে সরকার কর্তৃক নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসিকে প্রধান সমন্বয়ক করে সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এই কমিটির উপর সকল আটকা পড়া ব্যক্তিকে উদ্ধার এবং ধ্বস্তূপ অপসারণের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল। এখানে সরকারের স্পষ্ট নির্দেশ ছিল যে, জীবিত এবং মৃত প্রত্যেককে যথাযথ সতর্কতা ও যতেœর সঙ্গে উদ্ধার করতে হবে এবং উদ্ধার কাজ সম্পূর্ণরূপে সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত উদ্ধার কাজ অবিরতভাবে চলতে থাকবে।
উদ্ধারকারীরা এক মুহূর্তের জন্যও উদ্ধার কাজ বন্ধ না রেখে অব্যাহতভাবে উদ্ধার চালিয়ে গিয়েছিলেন এবং মিডিয়াও উদ্ধারকর্মীদের সঙ্গে রাত-দিন প্রতিটি মুহূর্ত জেগে থেকে উদ্ধার দৃশ্য এবং সংবাদ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। এর মধ্যে ১০ মে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার ১৭ দিন পর উদ্ধারকর্মীরা একজন জীবিত ব্যক্তির সন্ধান পায়। প্রশিক্ষিত সেনা সদস্য ও ফায়ার সার্ভিস অত্যন্ত সতর্কতায় ধসে পড়া ভবন হতে একজন মহিলাকে উদ্ধার করেন। তার নাম রেশমা। তিনি একজন গার্মেন্টস কর্মী। মিডিয়াসহ সকলের উপস্থিতিতে তাকে বিকাল প্রায় সাড়ে ৪টায় উদ্ধার করা হয়।
রেশমাকে উদ্ধারের পরপরই চিকিৎসার জন্য সাভার সিএমএইচএ নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাকে সুস্থ করে তোলার জন্য সেনাবাহিনীর চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে প্রয়োজনীয় সকল চিকিৎসা দেয়া হয়। মিডিয়ার অনুরোধের প্রেক্ষিতে ডাক্তারদের সম্মতি সাপেক্ষে ১৩ মে বিকেলে রেশমাকে মিডিয়ার সামনে নিয়ে আসা হয়। যদিও তখনও তার ট্রমা কাটেনি, তৎসত্ত্বেও প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী সাংবাদিকগণ তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। রেশমা সাংবাদিকদের সামনে ভবনে আটকা পড়ার দুঃসহ স্মৃতিচারণ করেছিলেন, যা দেশী-বিদেশী (বিবিসি, সিএনএন, আল জাজিরা ইত্যাদি) মিডিয়ায় তার বিস্তারিত বক্তব্য প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েছিল।
এরপর রেশমা সুস্থ হয়ে উঠলে তাকে সিএমএইচ থেকে ৬ জুন রিলিজ দেয়া হয়। হাসপাতাল থেকে বিদায় নেয়ার মুহূর্তে তিনি দেশী-বিদেশী সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন যা সঠিকভাবে প্রচার/প্রকাশ করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, চিকিৎসাধীন অবস্থায় রেশমাকে বিভিন্ন সংস্থা চাকরির অফার দেয়। এর মধ্যে হোটেল ওয়েস্টিনের অফার রেশমা গ্রহণ করেন। সাভার সিএমএইচ থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি হোটেল ওয়েস্টিনে যোগদান করেন। উদ্ধার ঘটনার প্রায় দীর্ঘ ৫০ দিন পর 'সানডে মিরর' নামে ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড পত্রিকা রেশমা উদ্ধার সংক্রান্ত যে বিভ্রান্তিকর সংবাদ পরিবেশন করে, তা উদ্ধারকারীদের মনে চরম আঘাত দিয়েছে। তাদের ত্যাগ, সততা ও মানবতাবোধ প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি এ ধরনের বিভ্রান্তিমূলক তথ্য পরিবেশনের ফলে রেশমার মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। কেননা, তার ট্রমা এখনও সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হয়ে যায়নি। সানডে মিররের প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে দেশীয় কিছু গণমাধ্যমও অনুরূপ কাজ করে যাচ্ছে। এ সকল বিভ্রান্তিমূলক প্রতিবেদন প্রকাশের পথ পরিহার করে ১৩ মে ও ৬ জুন রেশমার সংবাদ বিবৃতিগুলো সংবাদ মাধ্যমে পুনরায় প্রচার ও প্রকাশের ব্যবস্থা নেয়া বাঞ্ছনীয়। তাদের এ পদক্ষেপ অবশ্যই সকলের সাধুবাদ অর্জন করবে।