লন্ডন থেকে আঙ্কারা (দুই) জামায়াতের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক ॥ বিপন্ন ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র
শাহরিয়ার কবির
লন্ডনে ১৩ জুলাই পর্যন্ত নির্ধারিত কয়েকটি বৈঠক সুলতানা কামালের জন্য রেখে ৯ জুলাই আমি প্রথমে ইস্তাম্বুল এবং পরে আঙ্কারা গিয়েছি প্রধানত সরকারী কাজে। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকারে এসে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশের যেসব বিশিষ্ট নাগরিক, সরকার ও প্রতিষ্ঠান আমাদের সমর্থন ও সহযোগিতা করেছিল তাদের সম্মাননা প্রদান করা হবে। এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনিকে প্রধান করে যে জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে আমি তার একজন সদস্য। কমিটির গত বৈঠকে আমি বলেছিলাম, জামায়াত ওআইসির বিভিন্ন দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে ব্যাপক অপপ্রচার চালাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এসব দেশের সরকার পাকিস্তানী সামরিক জান্তার গণহত্যা সমর্থন করলেও সেখানকার ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিবাদী শক্তি নিশ্চয় তাদের সরকারের বাংলাদেশবিরোধী অবস্থান সমর্থন করেনি। তখন পাকিস্তানেও এমন কিছু বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকার নেতা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আমরা জানি গণহত্যার প্রতিবাদ করে যাঁরা কারানির্যাতনসহ নানা ধরনের লাঞ্ছনা ও গঞ্জনার শিকার হয়েছিলেন। তাঁদের কয়েকজনকে গত ২৫ মার্চের সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। মিসর ও তুরস্কে জামায়াতের সমমনারা ক্ষমতায়। তুরস্কের রাষ্ট্রপতি গত বছর ডিসেম্বরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে তার মনোভাব ব্যক্ত করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে চিঠি লিখেছিলেন। এরপর সেখানকার সরকার সমর্থক কিছু আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী ঢাকায় এসে বিনা অনুমতিতে ট্রাইব্যুনাল পরিদর্শন করে, গোলাম আযম ও তার আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে দেশে ফিরে অত্যন্ত নেতিবাচক ও উস্কানিমূলক বিবৃতি দিয়েছেন, যা জামায়াতের কাগজে ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। আমার প্রস্তাব ছিলÑএ সব দেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান খুঁজে বের করা দরকার; যাঁরা তাঁদের দেশে জামায়াতের এসব অপতৎপরতার জবাব দিতে পারবেন। মূলত এ উদ্দেশ্যেই আমার সাম্প্রতিক মিসর ও তুরস্ক সফর।
তুরস্কে যাওয়ার আগেই আমাদের রাষ্ট্রদূত জুলফিকার রহমান '৭১-এর দৈনিক পত্রিকা ঘেঁটে বাংলাদেশ সম্পর্কে তখন যে সব খবর বেরিয়েছে সেগুলো ইংরেজী অনুবাদসহ সে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আমার সাক্ষাতের সময়সূচী তৈরি করে রেখেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় 'বিশ্বশান্তি পরিষদ' বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সংগঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের সভাপতিম-লীর সদস্য হিসেবে আমি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী আবুল কাশেমের মাধ্যমে গত মাসে তুরস্কের শান্তি পরিষদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। ১০ জুলাই ইস্তাম্বুলে আমার সঙ্গে প্রথম বৈঠক হয়েছিল তুরস্কের শান্তি পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ নেতা আয়েদিমির গুলেরের সঙ্গে।
আয়েদিমির আগেই জানিয়েছিলেন, '৭১-এ তুরস্কে এক ধরনের গৃহযুদ্ধ চলছিল। প্রগতিশীল শক্তির বিরুদ্ধে সামরিক জান্তার ধারবাহিক হামলা ও নির্যাতনের কারণে অন্য দেশে কী ঘটছে সে বিষয়ে শান্তি পরিষদের কিছু জানবার বা করবার সুযোগ ছিল না। তাছাড়া তখন তুরস্কের শান্তি পরিষদ সাংগঠনিকভাবেও খুব একটা শক্তিশালী ছিল না।
আয়েদিমির আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন নাজিম হিকমত কালচারাল সেন্টারে। দেড় শ' বছরের পুরনো জমিদার বাড়িতে বিরাট আঙ্গিনায় ইস্তাম্বুলের বামপন্থী ও প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখক, শিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, থিয়েটারকর্মী, সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদদের বিশাল মেলা। আঙ্গিনাজুড়ে বহু টেবিল-চেয়ার পাতা, পাশে রেস্তরাঁ। চা আর কফির সঙ্গে সধুম আড্ডায় আমিও শরিক হলাম। আমাকে ঘিরে ধরলেন সেন্টারের পরিচালকসহ তাকসিম স্কয়ারের তরুণ নেতারা। ইস্তাম্বুল যাওয়ার আগেই আমি আয়েদিমিরকে জানিয়েছিলাম ঢাকার শাহবাগ ও মিসরের তাহরির স্কয়ারের আদলে গড়ে ওঠা ইস্তাম্বুলের তাকসিম স্কয়ারে তারুণ্যের অভ্যুত্থান সম্পর্কে আমি জানতে চাই এবং নেতাদের সাক্ষাতকারও গ্রহণ করতে চাই। আয়েদিমির আমার জন্য এইচডি ক্যামেরাসহ ক্যামেরাম্যান উমুত সেলিককে বলে রেখেছিলেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, তুরস্ক ও বাংলাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদের সাম্প্রতিক উত্থান এবং তাদের গ্লোবাল নেটওয়ার্ক, দেশে দেশে ধর্মনিরপেক্ষ মানবাধিকারের সংগ্রাম ইত্যাদি বিষয়ে তুরস্কের ইস্তাম্বুল ও আঙ্কারায় যাঁদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে তাঁদের ভেতর উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন রিপাবলিকান পিপল্স পার্টির ডেপুটি চেয়ারম্যান ওসমান ফারুক লাগোগলু, মানবাধিকার নেত্রী ভাসফিয়ে জামান, টার্কিশ পেন সেন্টারের সভাপতি তারিক গুনেরসেলসহ অন্য নেতৃবৃন্দ, তুরস্কের সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি তুর্গে ওলচেটোসহ অন্য নেতৃবৃন্দ, রাইটার্স সিন্ডিকেটের সভাপতি মুস্তফা কোজ ও অন্যান্য লেখক, বিলগি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিয়াজি দালিয়ানজি, প্রবীণ লেখক, সাংবাদিক ও জাতিসংঘের সাবেক আমলা ড. হিফজি টপুযসহ সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ, মওলানা জালালউদ্দিন রুমীর মাজার ও কালচারাল সেন্টারের কর্মকর্তাবৃন্দ। এ ছাড়া অন্যতম প্রধান দৈনিক সোল, দৈনিক ইয়েনিগুণ, দৈনিক এভরেনসেল ও হায়াৎ টেলিভিশন আমার বিশেষ সাক্ষাতকারসহ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রতিবেদন ছেপেছে। ১৫ জুলাই কোনিয়ার দৈনিক ইয়েনিগুণ-এর প্রথম পাতার প্রধান সংবাদ শিরোনাম ছিল আমার তুরস্ক সফরসহ বাংলাদেশ ও তুরস্কের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বক্তব্য।
প্রধান বিরোধী দল কামাল আতাতুর্কের অনুসারী রিপাবলিকান পিপলস পার্টির ডেপুটি চেয়ারম্যান ওসমান ফারুক পেশায় কূটনীতিক। ১৯৭৭ সালে ঢাকায় তুরস্কের প্রথম রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন। অবসরের আগে যুক্তরাষ্ট্রে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। অবসরের পর রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন; ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক তুরস্কের এক বলিষ্ঠ কণ্ঠ, ক্ষমতাসীন জাস্টিস এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (একে.) পার্টির কঠোর সমালোচক। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে তুরস্কের রাষ্ট্রপতির চিঠির বিষয়ে ওসমান ফারুক বললেন, আমরা পার্লামেন্টে প্রেসিডেন্টের এই অনভিপ্রেত কাজের কঠোর সমালোচনা করেছি। আমি বলেছি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ নিয়ে কোন মন্তব্য করা, বিচারের সমালোচনা করে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টকে চিঠি লেখা আমাদের প্রেসিডেন্টের উচিত হয়নি।
আমি জানতে চেয়েছিলামÑ আপনার এই বক্তব্য কি কোন পত্রিকায় ছাপা হয়েছে?
ওসমান ফারুক বললেন, পত্রিকায় নিশ্চয় ছাপা হয়েছে। আপনি চাইলে আমি পার্লামেন্টের ধারাবিবরণীর কপি পাঠিয়ে দেব। এরপর তিনি সরকারের কার্যকলাপ সম্পর্কে বললেনÑ তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষতা এখন বড় ধরনের হুমকির মুখে। রাজনীতি ও সমাজে ব্যাপকভাবে ইসলামীকরণ আরম্ভ হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা তুরস্ককে অতীতের ইসলামী ধারায় নিয়ে যেতে চাইছেন। পাঠ্যসূচিতে ধর্মশিক্ষা ও কোরান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। টেলিভিশনে ধর্মীয় অনুষ্ঠান বেড়েছে। অধিকাংশ টেলিভিশন ও সংবাদপত্র সরকারি দলের নিয়ন্ত্রণে। সরকারের সমালোচনা করলে সন্ত্রাসের অভিযোগে গ্রেফতার করা হচ্ছে। একে. পার্টির হাইব্রিড ইসলাম তুরস্ককে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ভেবে আমি অত্যন্ত শঙ্কিত। আমরা ইসলামের বিরুদ্ধে নই, তবে আমি মনে করি রাজনীতিতে ধর্মের কোন জায়গা থাকা উচিত নয়।
ওসমান ফারুক এ কথাও বললেন, আধুনিক তুরস্কে তিন প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশে। ১৯২৭ সালে কামাল আতাতুর্ক রাষ্ট্রের অন্যতম নীতি হিসেবে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা সংযোজন করে সকল ধর্মভিত্তিক সংগঠন নিষিদ্ধ করেছিলেন। পরে তুরস্ক কামাল আতাতুর্কের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। তিনি আরও জানালেন, বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী কিংবা মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে তুরস্কের ক্ষমতাসীন একে. পার্টির সম্পর্ক ও ভালবাসা গোপন কোন বিষয় নয়। গত বছর জামায়াতে ইসলামীর নেতারা তুরস্ক সফর করে একে. পার্টির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। দু'দিন আগে মিসরের ক্ষমতাচ্যুত মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এরদোগান বলেছেন, মুরসি আমার প্রেসিডেন্ট। এই বলে হা হা করে হাসলেন ওসমান ফারুক।
আমি মন্তব্য করলাম, আমরা তো জানি তুরস্ক একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। মিসরের প্রেসিডেন্ট কীভাবে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রীর প্রেসিডেন্ট হন? শুনে তিনি দ্বিগুণ হাসলেন।
তুরস্কে সাংবাদিক নির্যাতনের কথা বিস্তারিতভাবে বলেছেন সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট তুর্গে ওলচেটো ও প্রবীণ সাংবাদিক অধ্যাপক নিয়াজী দালিয়ানজি। ইস্তাম্বুলের কাওয়াললুতে সাংবাদিক ইউনিয়নের বিশাল কার্যালয়। বর্তমানে ইউনিয়নের সদস্যসংখ্যা ৩৬০০। এটি ছাড়া বামদের ছোট ছোট কয়েকটি ইউনিয়ন আছে, তবে মূল ইউনিয়নে সব মতের সাংবাদিকরাই সদস্য। তুরস্কে ১৯৬১ সালে সংবিধান সংশোধন করে সাংবাদিকদের কিছু অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, তার ভেতর আইডেন্টিটি কার্ড প্রদান একটি। কার্ড থাকলে সাংবাদিকদের অনেক সুযোগ-সুবিধা দিতে হবেÑসেজন্য এখন সাংবাদিকদের খ-কালীন বা কর্মনবীশ করে রেখে দেয়া হয়, স্থায়ী করা হয় না। সরকারের সমালোচনা করলে সাংবাদিকদের চাকরি চলে যায়, নইলে জেলে যেতে হয়। ওলচেটো জানালেন, এখন কেউ চাকরি হারাতে বা জেলে যেতে চায় না। বহু সিনিয়র সাংবাদিক জেলে। তাকসিম স্কয়ারের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে ৬০ সাংবাদিক পুলিশের দ্বারা নিগৃহীত ও নির্যাতিত হয়েছেন। ফ্রিডম রেডিওর সাংবাদিক ফুসুন আরদোয়ান সাত বছর ধরে জেলে, এখন পর্যন্ত চার্জশিট দেয়া হয়নি, মামলাও শুরু হয়নি। তুরস্কের সাংবাদিকদের অবস্থা চীন ও রাশিয়ার চেয়েও খারাপ।
সাংবাদিক, লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের গ্রেফতার ও নির্যাতনের কথা বললেন রাইটার্স সিন্ডিকেটের প্রেসিডেন্ট মুস্তফা কোজ। লেখকদের অনেকেই ছিলেন বৈঠকে, ইংরেজী বুঝলেও বলতে পারেন না। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে তুরস্কের রাষ্ট্রপতির অনাকাক্সিক্ষত মন্তব্যের কঠোর সমালোচনা করলেন রাইটার্স সিন্ডিকেটের শীর্ষ নেতারা। ইসলামের নামে '৭১-এ বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে জেনে অত্যন্ত বিচলিত বোধ করলেন তাঁরা। বললেন, বাংলাদেশের লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করতে চান তাঁরা। তাঁদের বললাম, দেশে ফিরে আমি সরকারকে বলব তুরস্ক ও মিসর থেকে লেখক, শিল্পী, সাংবাদিকদের দুটি দল বাংলাদেশ সফরে আমন্ত্রণের জন্য। বিশ্বের সব দেশের ধর্মনিরপেক্ষ মানবতায় বিশ্বাসী শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম গঠন জরুরী হয়ে উঠেছে। দেশে দেশে আমরা মৌলবাদীদের দ্বারা ক্রমাগত আক্রান্ত হব, নিহত হব, কারাগারে যাব কিংবা তাদের হুমকির কারণে দেশান্তরি হবÑএমনটি চলতে পারে না। মৌলবাদের বিরুদ্ধে আমাদের একজোট হয়ে লড়তে হবে। '৭১-এ না পারলেও এখন থেকে আমরা একে অপরের বিপদে পাশে যেন দাঁড়াতে পারি সেভাবে প্রস্তুত হতে হবে।
আমেরিকা কীভাবে মুসলমানপ্রধান দেশগুলোতে মৌলবাদকে মদদ দিচ্ছে এ সম্পর্কে আমার বক্তব্য তারা সমর্থন করলেন। বললেন, অন্যান্য দেশের প্রগতিশীল লেখকদের নিয়ে একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলন করা যায় কি না। বললাম, এ বিষয়ে মিসরের লেখক ইউনিয়নের সভাপতি মোহামেদ সালমাওয়ের সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছে। তাদের বিশাল অবকাঠামোগত সুবিধে রয়েছে। মিসরের লেখক ইউনিয়ন আমাকে লিখিত প্রস্তাব প্রদানের জন্য অনুরোধ করেছে। একই ধরনের আলোচনা হয়েছে লেখকদের অপর সংগঠন টার্কিশ পেন ক্লাবের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। পরদিন তাদের বুলেটিনে আমার সঙ্গে বৈঠকের সচিত্র প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে। তাঁরা বলেছেন পেন-এর আগামী সম্মেলনে আমাকে আমন্ত্রণ জানাবেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে নিজেদের অজ্ঞতায় তাঁরা লজ্জিত হলেন।
ইস্তাম্বুলে শেষদিন গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক ছিল সংখ্যালঘু আলাভী মুসলিমদের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে। সুন্নি ও শিয়াদের মতো কোরানে বর্ণিত মুসলমানদের ৭৩টি ফেরকার মধ্যে একটি হচ্ছে আলাভী। শিয়াদের মতো আলাভীরা মনে করেন, হযরত আলীর (রাঃ) যোগ্যতা ছিল নবী হওয়ার। আলাভীরা হযরত মহম্মদ (সাঃ) ও তাঁর জামাতা হযরত আলীকে (রাঃ) সমপর্যায়ের মনে করেন। যে কারণে অটোমান খলিফাদের যুগ থেকে আলাভীদের তুরস্কের সুন্নিরা মুসলমান বলে গণ্য করেন না। আলাভীরা তুরস্কের মোট জনসংখ্যার ১৫-২০%। সুন্নি মৌলবাদীরা সুযোগ পেলেই আলাভীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৯৩ সালে আলাভীদের একটি সম্মেলনে হোটেলে আগুন ধরিয়ে মৌলবাদীরা ৩৫ আলাভীকে জ্যান্ত পুড়িয়ে হত্যা করে। তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতির আন্দোলনে প্রধান শক্তি হচ্ছে আলাভীরা। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে, তুরস্কে আলাভীদের ওপর ধারাবাহিক নির্যাতন ও হত্যাকা-ের ঘটনায় 'হিউম্যান রাইটস ওয়াচ' বা 'এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালে'র মতো মানবাধিকার সংগঠনগুলো কখনও উচ্চকণ্ঠ হয়নি; অথচ বাংলাদেশে গণহত্যাকারীদের বিচার সম্পর্কে তারা প্রতিনিয়ত উদ্বেগ প্রকাশ করছে।
মিসর ও তুরস্ক সফরের সময় যখন বলেছি বর্তমান মুসলিম বিশ্বে শুধু বাংলাদেশেই ধর্মনিরপেক্ষ দল ক্ষমতায় আছে, জেনে তাঁরা চমৎকৃত হয়েছেন। বাংলাদেশের মৌলবাদীরা কীভাবে এসব দেশের মৌলবাদীদের সঙ্গে একজোট হয়ে কাজ করছে, এ বিষয়ে সর্বত্র মতবিনিময় করেছি।
মুসলমানপ্রধান দেশগুলোতে তুরস্ক প্রথম ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ গ্রহণ করছিল। তবে কামাল আতাতুর্কের ইউরোপীয় মডেলের কঠিন সেক্যুলারিজম গ্রামের সাধারণ মানুষ পছন্দ করেনি, যারা ছিল সাড়ে ছয় শ' বছর ধরে ইসলামের খলিফাদের রাজত্বে। ধর্মীয় সংগঠন নিষিদ্ধ করতে গিয়ে আতাতুর্ক সুফী ঐতিহ্যও বিলুপ্ত করতে চেয়েছিলেন। কোনিয়ায় মানবতাবাদী সুফী সাধক জালালউদ্দীন রুমীর মাজার পরিদর্শন করে সেখানকার কর্মকর্তাদের বলেছি, তুরস্কে সুফীবাদ এখন পর্যটক আকর্ষণের পণ্যে পরিণত হয়েছে। দরবেশী নাচ ও সুভেনির ছাড়া সুফী ঐতিহ্যের অন্য কোন অভিব্যক্তি কোথাও চোখে পড়েনি।
কোনিয়া ও ইস্তাম্বুলের সাংবাদিকদের বলেছি, তুরস্কে না থাকলেও রুমীর মানবিক দর্শন কীভাবে সজীব রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। রুমীর জন্ম ইরানে, তবে জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন তুরস্কে। আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি রুমীর ধর্মনিরপেক্ষ মানবতার দর্শন পরবর্তীকালে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে তুরস্ক, ইরাক, সিরিয়া, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের সুফী সাধকদের। প্রায় এক হাজার বছর আগে রুমী লিখেছেন, 'হে মুসলিম, আমি তো জানি না নিজেকে/ আমি তো নই খ্রীস্টান, ইহুদী, হিন্দু, নই মুসলিম/ আমি প্রাচ্যের নই, পাশ্চাত্যেরও নই, আমি জলের নই, স্থলেরও নই/ আমি ভারতের নই, চীনের নই, বুলগেরিয়া, সাকসিনেরও নই/ আমি ইহলোকের নই, পরলোকের নই, স্বর্গের নই, নরকেরও নই।...' এর সঙ্গে অদ্ভুত মিল খুঁজে পেয়েছি পাকিস্তানের বুল্লে শাহ, ভারতের কবীর আর বাংলাদেশের লালনের। লালন তো রুমীরই প্রতিধ্বনি করেন যখন তিনি বলেনÑ'সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে/ লালন কয় জাতের কী রূপ দেখলাম না এই নজরে।' কিংবা 'সবে বলে লালন ফকির হিন্দু কি যবন।/ লালন বলে আমার আমি না জানি সন্ধান।'
কোনিয়ার সাংবাদিকদের বলেছি, রুমী মৃত্যুবরণ করেছেন তুরস্কে, কিন্তু তাঁর দর্শন মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়া হয়ে দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। রুমীর প্রত্যক্ষ শিষ্য হযরত শাহজালাল কোনিয়া থেকে বাংলাদেশে এসেছিলেন ইসলাম প্রচারের জন্য। রুমীর মানবতাবাদের শেষ উত্তরাধিকারী বাংলাদেশের লালন ফকির। আমি তুরস্ক ও বাংলাদেশের সরকারের কাছে প্রস্তাব করব কোনিয়া ও কুষ্টিয়াকে 'জমজ নগর' ঘোষণার জন্য। জঙ্গী মৌলবাদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রামে সুফী ইসলামের সাম্য ও মানবিকতার দর্শন অন্যতম হাতিয়ার হতে পারে। যে কারণে মৌলবাদীরা সুযোগ পেলেই সুফীদের মাজারে হামলা করছে। ধর্মের মানবিক অভিব্যক্তি সব সময় তারা ধ্বংস করতে চেয়েছে।
মৌলবাদীদের দৌরাত্ম্যের কারণে পাকিস্তান ও বাংলাদেশে রোজার মাসে সব রেস্তরাঁ, খাবার দোকান বন্ধ থাকে। অথচ তুরস্কের প্রধান শহরগুলোতে ইফতারের বিশাল আয়োজন ছাড়া অন্য সময়ে বোঝার উপায় নেই এটা রোজার মাস, যদিও সেখানে ক্ষমতায় রয়েছে জামায়াতবান্ধব এ.কে. পার্টি। ইস্তাম্বুলে বোরকা আর মিনি স্কার্ট পরা মেয়েদের নিঃসঙ্কোচে রাস্তায় হাঁটতে দেখেছি। ঐতিহাসিক সুলতানআহমেত মসজিদের ভেতরে দেখেছি ইসলামের ইতিহাসের অনন্যসাধারণ স্থাপত্য নিদর্শন দেখবার জন্য দেশী-বিদেশী নারী-পুরুষের বিপুল সমাগম। শুধু মসজিদের ভেতর স্কার্ট বা শর্টস পরে প্রবেশ নিষেধ, কিন্তু মসজিদের প্রাঙ্গণে খোলামেলা পোশাকের পর্যটকদের অবস্থান সম্পর্কে কারো কোন মাথাব্যথা নেই। নারীদের সম্পর্কে হেফাজতের শফী সাহেব যা বলেছেন তুরস্কের মৌলবাদীরা শুনলে কানে আঙ্গুল দেবেন। কামাল আতাতুর্ক সমন জারি করে মেয়েদের বোরকা পরা ও মাথায় হেজাব বাঁধা নিষিদ্ধ করেছিলেন। এখন আবার বোরকা ও হেজাব ফিরে এসেছে। এ নিয়ে কেউ জবরদস্তি করেনি। রোজার মাসে সেখানে খোলামেলা বেলি ড্যান্স হতেও দেখেছি-আমাদের দেশে হলে হাটহাজারীর হুজুররা কেয়ামত বাঁধিয়ে দিতেন। তুরস্কে কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইসলাম স্বমহিমায় স্ব স্ব অবস্থানে রয়েছে। তারপরও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তুরস্কের চেয়ে বাংলাদেশে বেশি বলতে হবে। আতাতুর্কের জমানায়ও তুরস্কে ধর্মীয় সংখ্যালঘু আলাভী নির্যাতন অব্যাহত ছিল।
তুরস্কের মৌলবাদীরা বহু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মৌলবাদীদের চেয়ে মার্জিত। তারা মদ্যপানের বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছে স্বাস্থ্যগত কারণের কথা বলে। তারা একথা বলছে না- মদ্যপান ইসলামসম্মত নয়। যে কামাল আতাতুর্ক তুরস্ক থেকে ধর্মকে নির্বাসনে পাঠাতে চেয়েছিলেন তার প্রতি রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতির পিতার সম্মান জানাতে সে দেশের মৌলবাদীরা বিব্রত বোধ করে না। কেউ এমন কথা বলে না- মোস্তফা কামাল নয়, মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আঃ), যেমনটি বলা হয় বাংলাদেশে। সাড়ে ছয়শ বছর ধরে ইসলামের সদর দুর্গ তুরঙ্কে মাওলানা একজনই আছেন, তিনি জালাল উদ্দিন রুমী। আমাদের মত পাড়ায় পাড়ায় মাওলানার ছড়াছড়ি তুরস্ক কেন, আরববিশ্বের কোথাও নেই। তুরস্কের মৌলবাদীরা মুক্তচিন্তার বুদ্ধিজীবী, কমিউনিস্ট ও সংখ্যালঘু আলাভীদের ওপর নির্যাতন করলেও '৭১-এর মতো গণহত্যা সংঘটনের রেকর্ড তাদের নেই। কামাল আতাতুর্ক এমনই প্রবল জাতীয়তাবোধের জন্ম দিয়েছিলেন যে, ওহাবীবাদ এখনও তুরস্কে শেকড় গাড়তে পারেনি আরবে উদ্ভূত হওয়ার কারণে। চরিত্রগতভাবে তুর্কীরা আরববিদ্বেষী। এখনও গ্রামের অনেক মানুষ বিশ্বাস করেন, ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) আরবের নন, তিনি তুর্কী। ইসলাম সম্পর্কে বলা হয়Ñকোরান নাজেল হয়েছে আরবে, লেখা ও প্রচার হয়েছে তুরস্কে। মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুড ক্ষমতায় আসার প্রথম বছরে সব এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নিজেদের পতন ডেকে এনেছে। তুরস্কের মৌলবাদীরা এগুচ্ছে ধীরে, তবে সবারই আক্রমণের মূল লক্ষ্য নিঃসন্দেহে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ।
কামাল আতাতুর্কের চেয়ে বঙ্গবন্ধুর সেক্যুলারিজম অনেক বেশি যুগোপযোগী- এ কথা তুরস্কের বন্ধুরাও স্বীকার করেছেন। বঙ্গবন্ধুর সেক্যুলারিজমে ধর্মের স্পেস ছিল, যা আতাতুর্কের তুরস্কে ছিল না। বঙ্গবন্ধু যেমনটি বলেছিলেন, 'ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ধর্মহীনতা নয়'- তুরস্ক সেভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার পথে যায়নি। যার ফলে গত ১২ বছর ধরে ইসলামপন্থীরা তুরস্কে ক্ষমতায়। এ বিষয়ে তুরস্কে ও মিসরে আমরা সবাই একমত হয়েছি- ধর্মনিরপেক্ষতার ভেতর ধর্মের জায়গা থাকতে হবে। মানুষ ধর্ম পালন করবে, প্রচারও করবে; কিন্তু রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে সব সময় ধর্ম থেকে দূরে রাখতে হবে। ধর্ম আর রাজনীতি যুক্ত হলে কী হয় আমরা '৭১-এ দেখেছি, এখনও দেখছি। আমাদের মতো একই অভিজ্ঞতা তুরস্ক, মিসর, তিউনিশিয়া, আলজিরিয়া, সুদান, পাকিস্তান, ইরান ও আফগানিস্তানে। দেশে দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার নিরন্তর চর্চাই আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজকে বাঁচাতে পারে।
বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের 'জামায়াতে ইসলামী', মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার 'মুসলিম ব্রাদারহুড' এবং তুরস্কের মৌলবাদী 'জাস্টিস এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি' একই পথের পথিক, একই নৌকার যাত্রী। প্রয়োজনে মৌলবাদীরা যদি একে অপরের পাশে দাঁড়াতে পারে, অভীষ্ট লক্ষ্যের জন্য জীবন দিতে পারে-প্রগতির আন্দোলনে যারা যুক্ত, একইভাবে তাদেরও পরস্পরের পাশে দাঁড়াতে হবে। সকল দেশের ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদী শক্তিকে এক মঞ্চে সমবেত হতে হবে। মৌলবাদের তামসিকতা থেকে মুক্ত করতে হবে সমগ্র বিশ্বকে।
২৫ জুলাই ২০১৩
তুরস্কে যাওয়ার আগেই আমাদের রাষ্ট্রদূত জুলফিকার রহমান '৭১-এর দৈনিক পত্রিকা ঘেঁটে বাংলাদেশ সম্পর্কে তখন যে সব খবর বেরিয়েছে সেগুলো ইংরেজী অনুবাদসহ সে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আমার সাক্ষাতের সময়সূচী তৈরি করে রেখেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় 'বিশ্বশান্তি পরিষদ' বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সংগঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের সভাপতিম-লীর সদস্য হিসেবে আমি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী আবুল কাশেমের মাধ্যমে গত মাসে তুরস্কের শান্তি পরিষদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। ১০ জুলাই ইস্তাম্বুলে আমার সঙ্গে প্রথম বৈঠক হয়েছিল তুরস্কের শান্তি পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ নেতা আয়েদিমির গুলেরের সঙ্গে।
আয়েদিমির আগেই জানিয়েছিলেন, '৭১-এ তুরস্কে এক ধরনের গৃহযুদ্ধ চলছিল। প্রগতিশীল শক্তির বিরুদ্ধে সামরিক জান্তার ধারবাহিক হামলা ও নির্যাতনের কারণে অন্য দেশে কী ঘটছে সে বিষয়ে শান্তি পরিষদের কিছু জানবার বা করবার সুযোগ ছিল না। তাছাড়া তখন তুরস্কের শান্তি পরিষদ সাংগঠনিকভাবেও খুব একটা শক্তিশালী ছিল না।
আয়েদিমির আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন নাজিম হিকমত কালচারাল সেন্টারে। দেড় শ' বছরের পুরনো জমিদার বাড়িতে বিরাট আঙ্গিনায় ইস্তাম্বুলের বামপন্থী ও প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখক, শিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, থিয়েটারকর্মী, সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদদের বিশাল মেলা। আঙ্গিনাজুড়ে বহু টেবিল-চেয়ার পাতা, পাশে রেস্তরাঁ। চা আর কফির সঙ্গে সধুম আড্ডায় আমিও শরিক হলাম। আমাকে ঘিরে ধরলেন সেন্টারের পরিচালকসহ তাকসিম স্কয়ারের তরুণ নেতারা। ইস্তাম্বুল যাওয়ার আগেই আমি আয়েদিমিরকে জানিয়েছিলাম ঢাকার শাহবাগ ও মিসরের তাহরির স্কয়ারের আদলে গড়ে ওঠা ইস্তাম্বুলের তাকসিম স্কয়ারে তারুণ্যের অভ্যুত্থান সম্পর্কে আমি জানতে চাই এবং নেতাদের সাক্ষাতকারও গ্রহণ করতে চাই। আয়েদিমির আমার জন্য এইচডি ক্যামেরাসহ ক্যামেরাম্যান উমুত সেলিককে বলে রেখেছিলেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, তুরস্ক ও বাংলাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদের সাম্প্রতিক উত্থান এবং তাদের গ্লোবাল নেটওয়ার্ক, দেশে দেশে ধর্মনিরপেক্ষ মানবাধিকারের সংগ্রাম ইত্যাদি বিষয়ে তুরস্কের ইস্তাম্বুল ও আঙ্কারায় যাঁদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে তাঁদের ভেতর উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন রিপাবলিকান পিপল্স পার্টির ডেপুটি চেয়ারম্যান ওসমান ফারুক লাগোগলু, মানবাধিকার নেত্রী ভাসফিয়ে জামান, টার্কিশ পেন সেন্টারের সভাপতি তারিক গুনেরসেলসহ অন্য নেতৃবৃন্দ, তুরস্কের সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি তুর্গে ওলচেটোসহ অন্য নেতৃবৃন্দ, রাইটার্স সিন্ডিকেটের সভাপতি মুস্তফা কোজ ও অন্যান্য লেখক, বিলগি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিয়াজি দালিয়ানজি, প্রবীণ লেখক, সাংবাদিক ও জাতিসংঘের সাবেক আমলা ড. হিফজি টপুযসহ সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ, মওলানা জালালউদ্দিন রুমীর মাজার ও কালচারাল সেন্টারের কর্মকর্তাবৃন্দ। এ ছাড়া অন্যতম প্রধান দৈনিক সোল, দৈনিক ইয়েনিগুণ, দৈনিক এভরেনসেল ও হায়াৎ টেলিভিশন আমার বিশেষ সাক্ষাতকারসহ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রতিবেদন ছেপেছে। ১৫ জুলাই কোনিয়ার দৈনিক ইয়েনিগুণ-এর প্রথম পাতার প্রধান সংবাদ শিরোনাম ছিল আমার তুরস্ক সফরসহ বাংলাদেশ ও তুরস্কের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বক্তব্য।
প্রধান বিরোধী দল কামাল আতাতুর্কের অনুসারী রিপাবলিকান পিপলস পার্টির ডেপুটি চেয়ারম্যান ওসমান ফারুক পেশায় কূটনীতিক। ১৯৭৭ সালে ঢাকায় তুরস্কের প্রথম রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন। অবসরের আগে যুক্তরাষ্ট্রে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। অবসরের পর রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন; ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক তুরস্কের এক বলিষ্ঠ কণ্ঠ, ক্ষমতাসীন জাস্টিস এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (একে.) পার্টির কঠোর সমালোচক। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে তুরস্কের রাষ্ট্রপতির চিঠির বিষয়ে ওসমান ফারুক বললেন, আমরা পার্লামেন্টে প্রেসিডেন্টের এই অনভিপ্রেত কাজের কঠোর সমালোচনা করেছি। আমি বলেছি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ নিয়ে কোন মন্তব্য করা, বিচারের সমালোচনা করে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টকে চিঠি লেখা আমাদের প্রেসিডেন্টের উচিত হয়নি।
আমি জানতে চেয়েছিলামÑ আপনার এই বক্তব্য কি কোন পত্রিকায় ছাপা হয়েছে?
ওসমান ফারুক বললেন, পত্রিকায় নিশ্চয় ছাপা হয়েছে। আপনি চাইলে আমি পার্লামেন্টের ধারাবিবরণীর কপি পাঠিয়ে দেব। এরপর তিনি সরকারের কার্যকলাপ সম্পর্কে বললেনÑ তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষতা এখন বড় ধরনের হুমকির মুখে। রাজনীতি ও সমাজে ব্যাপকভাবে ইসলামীকরণ আরম্ভ হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা তুরস্ককে অতীতের ইসলামী ধারায় নিয়ে যেতে চাইছেন। পাঠ্যসূচিতে ধর্মশিক্ষা ও কোরান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। টেলিভিশনে ধর্মীয় অনুষ্ঠান বেড়েছে। অধিকাংশ টেলিভিশন ও সংবাদপত্র সরকারি দলের নিয়ন্ত্রণে। সরকারের সমালোচনা করলে সন্ত্রাসের অভিযোগে গ্রেফতার করা হচ্ছে। একে. পার্টির হাইব্রিড ইসলাম তুরস্ককে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ভেবে আমি অত্যন্ত শঙ্কিত। আমরা ইসলামের বিরুদ্ধে নই, তবে আমি মনে করি রাজনীতিতে ধর্মের কোন জায়গা থাকা উচিত নয়।
ওসমান ফারুক এ কথাও বললেন, আধুনিক তুরস্কে তিন প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশে। ১৯২৭ সালে কামাল আতাতুর্ক রাষ্ট্রের অন্যতম নীতি হিসেবে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা সংযোজন করে সকল ধর্মভিত্তিক সংগঠন নিষিদ্ধ করেছিলেন। পরে তুরস্ক কামাল আতাতুর্কের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। তিনি আরও জানালেন, বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী কিংবা মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে তুরস্কের ক্ষমতাসীন একে. পার্টির সম্পর্ক ও ভালবাসা গোপন কোন বিষয় নয়। গত বছর জামায়াতে ইসলামীর নেতারা তুরস্ক সফর করে একে. পার্টির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। দু'দিন আগে মিসরের ক্ষমতাচ্যুত মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এরদোগান বলেছেন, মুরসি আমার প্রেসিডেন্ট। এই বলে হা হা করে হাসলেন ওসমান ফারুক।
আমি মন্তব্য করলাম, আমরা তো জানি তুরস্ক একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। মিসরের প্রেসিডেন্ট কীভাবে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রীর প্রেসিডেন্ট হন? শুনে তিনি দ্বিগুণ হাসলেন।
তুরস্কে সাংবাদিক নির্যাতনের কথা বিস্তারিতভাবে বলেছেন সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট তুর্গে ওলচেটো ও প্রবীণ সাংবাদিক অধ্যাপক নিয়াজী দালিয়ানজি। ইস্তাম্বুলের কাওয়াললুতে সাংবাদিক ইউনিয়নের বিশাল কার্যালয়। বর্তমানে ইউনিয়নের সদস্যসংখ্যা ৩৬০০। এটি ছাড়া বামদের ছোট ছোট কয়েকটি ইউনিয়ন আছে, তবে মূল ইউনিয়নে সব মতের সাংবাদিকরাই সদস্য। তুরস্কে ১৯৬১ সালে সংবিধান সংশোধন করে সাংবাদিকদের কিছু অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, তার ভেতর আইডেন্টিটি কার্ড প্রদান একটি। কার্ড থাকলে সাংবাদিকদের অনেক সুযোগ-সুবিধা দিতে হবেÑসেজন্য এখন সাংবাদিকদের খ-কালীন বা কর্মনবীশ করে রেখে দেয়া হয়, স্থায়ী করা হয় না। সরকারের সমালোচনা করলে সাংবাদিকদের চাকরি চলে যায়, নইলে জেলে যেতে হয়। ওলচেটো জানালেন, এখন কেউ চাকরি হারাতে বা জেলে যেতে চায় না। বহু সিনিয়র সাংবাদিক জেলে। তাকসিম স্কয়ারের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে ৬০ সাংবাদিক পুলিশের দ্বারা নিগৃহীত ও নির্যাতিত হয়েছেন। ফ্রিডম রেডিওর সাংবাদিক ফুসুন আরদোয়ান সাত বছর ধরে জেলে, এখন পর্যন্ত চার্জশিট দেয়া হয়নি, মামলাও শুরু হয়নি। তুরস্কের সাংবাদিকদের অবস্থা চীন ও রাশিয়ার চেয়েও খারাপ।
সাংবাদিক, লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের গ্রেফতার ও নির্যাতনের কথা বললেন রাইটার্স সিন্ডিকেটের প্রেসিডেন্ট মুস্তফা কোজ। লেখকদের অনেকেই ছিলেন বৈঠকে, ইংরেজী বুঝলেও বলতে পারেন না। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে তুরস্কের রাষ্ট্রপতির অনাকাক্সিক্ষত মন্তব্যের কঠোর সমালোচনা করলেন রাইটার্স সিন্ডিকেটের শীর্ষ নেতারা। ইসলামের নামে '৭১-এ বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে জেনে অত্যন্ত বিচলিত বোধ করলেন তাঁরা। বললেন, বাংলাদেশের লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করতে চান তাঁরা। তাঁদের বললাম, দেশে ফিরে আমি সরকারকে বলব তুরস্ক ও মিসর থেকে লেখক, শিল্পী, সাংবাদিকদের দুটি দল বাংলাদেশ সফরে আমন্ত্রণের জন্য। বিশ্বের সব দেশের ধর্মনিরপেক্ষ মানবতায় বিশ্বাসী শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম গঠন জরুরী হয়ে উঠেছে। দেশে দেশে আমরা মৌলবাদীদের দ্বারা ক্রমাগত আক্রান্ত হব, নিহত হব, কারাগারে যাব কিংবা তাদের হুমকির কারণে দেশান্তরি হবÑএমনটি চলতে পারে না। মৌলবাদের বিরুদ্ধে আমাদের একজোট হয়ে লড়তে হবে। '৭১-এ না পারলেও এখন থেকে আমরা একে অপরের বিপদে পাশে যেন দাঁড়াতে পারি সেভাবে প্রস্তুত হতে হবে।
আমেরিকা কীভাবে মুসলমানপ্রধান দেশগুলোতে মৌলবাদকে মদদ দিচ্ছে এ সম্পর্কে আমার বক্তব্য তারা সমর্থন করলেন। বললেন, অন্যান্য দেশের প্রগতিশীল লেখকদের নিয়ে একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলন করা যায় কি না। বললাম, এ বিষয়ে মিসরের লেখক ইউনিয়নের সভাপতি মোহামেদ সালমাওয়ের সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছে। তাদের বিশাল অবকাঠামোগত সুবিধে রয়েছে। মিসরের লেখক ইউনিয়ন আমাকে লিখিত প্রস্তাব প্রদানের জন্য অনুরোধ করেছে। একই ধরনের আলোচনা হয়েছে লেখকদের অপর সংগঠন টার্কিশ পেন ক্লাবের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। পরদিন তাদের বুলেটিনে আমার সঙ্গে বৈঠকের সচিত্র প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে। তাঁরা বলেছেন পেন-এর আগামী সম্মেলনে আমাকে আমন্ত্রণ জানাবেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে নিজেদের অজ্ঞতায় তাঁরা লজ্জিত হলেন।
ইস্তাম্বুলে শেষদিন গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক ছিল সংখ্যালঘু আলাভী মুসলিমদের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে। সুন্নি ও শিয়াদের মতো কোরানে বর্ণিত মুসলমানদের ৭৩টি ফেরকার মধ্যে একটি হচ্ছে আলাভী। শিয়াদের মতো আলাভীরা মনে করেন, হযরত আলীর (রাঃ) যোগ্যতা ছিল নবী হওয়ার। আলাভীরা হযরত মহম্মদ (সাঃ) ও তাঁর জামাতা হযরত আলীকে (রাঃ) সমপর্যায়ের মনে করেন। যে কারণে অটোমান খলিফাদের যুগ থেকে আলাভীদের তুরস্কের সুন্নিরা মুসলমান বলে গণ্য করেন না। আলাভীরা তুরস্কের মোট জনসংখ্যার ১৫-২০%। সুন্নি মৌলবাদীরা সুযোগ পেলেই আলাভীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৯৩ সালে আলাভীদের একটি সম্মেলনে হোটেলে আগুন ধরিয়ে মৌলবাদীরা ৩৫ আলাভীকে জ্যান্ত পুড়িয়ে হত্যা করে। তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতির আন্দোলনে প্রধান শক্তি হচ্ছে আলাভীরা। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে, তুরস্কে আলাভীদের ওপর ধারাবাহিক নির্যাতন ও হত্যাকা-ের ঘটনায় 'হিউম্যান রাইটস ওয়াচ' বা 'এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালে'র মতো মানবাধিকার সংগঠনগুলো কখনও উচ্চকণ্ঠ হয়নি; অথচ বাংলাদেশে গণহত্যাকারীদের বিচার সম্পর্কে তারা প্রতিনিয়ত উদ্বেগ প্রকাশ করছে।
মিসর ও তুরস্ক সফরের সময় যখন বলেছি বর্তমান মুসলিম বিশ্বে শুধু বাংলাদেশেই ধর্মনিরপেক্ষ দল ক্ষমতায় আছে, জেনে তাঁরা চমৎকৃত হয়েছেন। বাংলাদেশের মৌলবাদীরা কীভাবে এসব দেশের মৌলবাদীদের সঙ্গে একজোট হয়ে কাজ করছে, এ বিষয়ে সর্বত্র মতবিনিময় করেছি।
মুসলমানপ্রধান দেশগুলোতে তুরস্ক প্রথম ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ গ্রহণ করছিল। তবে কামাল আতাতুর্কের ইউরোপীয় মডেলের কঠিন সেক্যুলারিজম গ্রামের সাধারণ মানুষ পছন্দ করেনি, যারা ছিল সাড়ে ছয় শ' বছর ধরে ইসলামের খলিফাদের রাজত্বে। ধর্মীয় সংগঠন নিষিদ্ধ করতে গিয়ে আতাতুর্ক সুফী ঐতিহ্যও বিলুপ্ত করতে চেয়েছিলেন। কোনিয়ায় মানবতাবাদী সুফী সাধক জালালউদ্দীন রুমীর মাজার পরিদর্শন করে সেখানকার কর্মকর্তাদের বলেছি, তুরস্কে সুফীবাদ এখন পর্যটক আকর্ষণের পণ্যে পরিণত হয়েছে। দরবেশী নাচ ও সুভেনির ছাড়া সুফী ঐতিহ্যের অন্য কোন অভিব্যক্তি কোথাও চোখে পড়েনি।
কোনিয়া ও ইস্তাম্বুলের সাংবাদিকদের বলেছি, তুরস্কে না থাকলেও রুমীর মানবিক দর্শন কীভাবে সজীব রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। রুমীর জন্ম ইরানে, তবে জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন তুরস্কে। আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি রুমীর ধর্মনিরপেক্ষ মানবতার দর্শন পরবর্তীকালে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে তুরস্ক, ইরাক, সিরিয়া, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের সুফী সাধকদের। প্রায় এক হাজার বছর আগে রুমী লিখেছেন, 'হে মুসলিম, আমি তো জানি না নিজেকে/ আমি তো নই খ্রীস্টান, ইহুদী, হিন্দু, নই মুসলিম/ আমি প্রাচ্যের নই, পাশ্চাত্যেরও নই, আমি জলের নই, স্থলেরও নই/ আমি ভারতের নই, চীনের নই, বুলগেরিয়া, সাকসিনেরও নই/ আমি ইহলোকের নই, পরলোকের নই, স্বর্গের নই, নরকেরও নই।...' এর সঙ্গে অদ্ভুত মিল খুঁজে পেয়েছি পাকিস্তানের বুল্লে শাহ, ভারতের কবীর আর বাংলাদেশের লালনের। লালন তো রুমীরই প্রতিধ্বনি করেন যখন তিনি বলেনÑ'সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে/ লালন কয় জাতের কী রূপ দেখলাম না এই নজরে।' কিংবা 'সবে বলে লালন ফকির হিন্দু কি যবন।/ লালন বলে আমার আমি না জানি সন্ধান।'
কোনিয়ার সাংবাদিকদের বলেছি, রুমী মৃত্যুবরণ করেছেন তুরস্কে, কিন্তু তাঁর দর্শন মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়া হয়ে দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। রুমীর প্রত্যক্ষ শিষ্য হযরত শাহজালাল কোনিয়া থেকে বাংলাদেশে এসেছিলেন ইসলাম প্রচারের জন্য। রুমীর মানবতাবাদের শেষ উত্তরাধিকারী বাংলাদেশের লালন ফকির। আমি তুরস্ক ও বাংলাদেশের সরকারের কাছে প্রস্তাব করব কোনিয়া ও কুষ্টিয়াকে 'জমজ নগর' ঘোষণার জন্য। জঙ্গী মৌলবাদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রামে সুফী ইসলামের সাম্য ও মানবিকতার দর্শন অন্যতম হাতিয়ার হতে পারে। যে কারণে মৌলবাদীরা সুযোগ পেলেই সুফীদের মাজারে হামলা করছে। ধর্মের মানবিক অভিব্যক্তি সব সময় তারা ধ্বংস করতে চেয়েছে।
মৌলবাদীদের দৌরাত্ম্যের কারণে পাকিস্তান ও বাংলাদেশে রোজার মাসে সব রেস্তরাঁ, খাবার দোকান বন্ধ থাকে। অথচ তুরস্কের প্রধান শহরগুলোতে ইফতারের বিশাল আয়োজন ছাড়া অন্য সময়ে বোঝার উপায় নেই এটা রোজার মাস, যদিও সেখানে ক্ষমতায় রয়েছে জামায়াতবান্ধব এ.কে. পার্টি। ইস্তাম্বুলে বোরকা আর মিনি স্কার্ট পরা মেয়েদের নিঃসঙ্কোচে রাস্তায় হাঁটতে দেখেছি। ঐতিহাসিক সুলতানআহমেত মসজিদের ভেতরে দেখেছি ইসলামের ইতিহাসের অনন্যসাধারণ স্থাপত্য নিদর্শন দেখবার জন্য দেশী-বিদেশী নারী-পুরুষের বিপুল সমাগম। শুধু মসজিদের ভেতর স্কার্ট বা শর্টস পরে প্রবেশ নিষেধ, কিন্তু মসজিদের প্রাঙ্গণে খোলামেলা পোশাকের পর্যটকদের অবস্থান সম্পর্কে কারো কোন মাথাব্যথা নেই। নারীদের সম্পর্কে হেফাজতের শফী সাহেব যা বলেছেন তুরস্কের মৌলবাদীরা শুনলে কানে আঙ্গুল দেবেন। কামাল আতাতুর্ক সমন জারি করে মেয়েদের বোরকা পরা ও মাথায় হেজাব বাঁধা নিষিদ্ধ করেছিলেন। এখন আবার বোরকা ও হেজাব ফিরে এসেছে। এ নিয়ে কেউ জবরদস্তি করেনি। রোজার মাসে সেখানে খোলামেলা বেলি ড্যান্স হতেও দেখেছি-আমাদের দেশে হলে হাটহাজারীর হুজুররা কেয়ামত বাঁধিয়ে দিতেন। তুরস্কে কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইসলাম স্বমহিমায় স্ব স্ব অবস্থানে রয়েছে। তারপরও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তুরস্কের চেয়ে বাংলাদেশে বেশি বলতে হবে। আতাতুর্কের জমানায়ও তুরস্কে ধর্মীয় সংখ্যালঘু আলাভী নির্যাতন অব্যাহত ছিল।
তুরস্কের মৌলবাদীরা বহু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মৌলবাদীদের চেয়ে মার্জিত। তারা মদ্যপানের বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছে স্বাস্থ্যগত কারণের কথা বলে। তারা একথা বলছে না- মদ্যপান ইসলামসম্মত নয়। যে কামাল আতাতুর্ক তুরস্ক থেকে ধর্মকে নির্বাসনে পাঠাতে চেয়েছিলেন তার প্রতি রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতির পিতার সম্মান জানাতে সে দেশের মৌলবাদীরা বিব্রত বোধ করে না। কেউ এমন কথা বলে না- মোস্তফা কামাল নয়, মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আঃ), যেমনটি বলা হয় বাংলাদেশে। সাড়ে ছয়শ বছর ধরে ইসলামের সদর দুর্গ তুরঙ্কে মাওলানা একজনই আছেন, তিনি জালাল উদ্দিন রুমী। আমাদের মত পাড়ায় পাড়ায় মাওলানার ছড়াছড়ি তুরস্ক কেন, আরববিশ্বের কোথাও নেই। তুরস্কের মৌলবাদীরা মুক্তচিন্তার বুদ্ধিজীবী, কমিউনিস্ট ও সংখ্যালঘু আলাভীদের ওপর নির্যাতন করলেও '৭১-এর মতো গণহত্যা সংঘটনের রেকর্ড তাদের নেই। কামাল আতাতুর্ক এমনই প্রবল জাতীয়তাবোধের জন্ম দিয়েছিলেন যে, ওহাবীবাদ এখনও তুরস্কে শেকড় গাড়তে পারেনি আরবে উদ্ভূত হওয়ার কারণে। চরিত্রগতভাবে তুর্কীরা আরববিদ্বেষী। এখনও গ্রামের অনেক মানুষ বিশ্বাস করেন, ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) আরবের নন, তিনি তুর্কী। ইসলাম সম্পর্কে বলা হয়Ñকোরান নাজেল হয়েছে আরবে, লেখা ও প্রচার হয়েছে তুরস্কে। মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুড ক্ষমতায় আসার প্রথম বছরে সব এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নিজেদের পতন ডেকে এনেছে। তুরস্কের মৌলবাদীরা এগুচ্ছে ধীরে, তবে সবারই আক্রমণের মূল লক্ষ্য নিঃসন্দেহে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ।
কামাল আতাতুর্কের চেয়ে বঙ্গবন্ধুর সেক্যুলারিজম অনেক বেশি যুগোপযোগী- এ কথা তুরস্কের বন্ধুরাও স্বীকার করেছেন। বঙ্গবন্ধুর সেক্যুলারিজমে ধর্মের স্পেস ছিল, যা আতাতুর্কের তুরস্কে ছিল না। বঙ্গবন্ধু যেমনটি বলেছিলেন, 'ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ধর্মহীনতা নয়'- তুরস্ক সেভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার পথে যায়নি। যার ফলে গত ১২ বছর ধরে ইসলামপন্থীরা তুরস্কে ক্ষমতায়। এ বিষয়ে তুরস্কে ও মিসরে আমরা সবাই একমত হয়েছি- ধর্মনিরপেক্ষতার ভেতর ধর্মের জায়গা থাকতে হবে। মানুষ ধর্ম পালন করবে, প্রচারও করবে; কিন্তু রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে সব সময় ধর্ম থেকে দূরে রাখতে হবে। ধর্ম আর রাজনীতি যুক্ত হলে কী হয় আমরা '৭১-এ দেখেছি, এখনও দেখছি। আমাদের মতো একই অভিজ্ঞতা তুরস্ক, মিসর, তিউনিশিয়া, আলজিরিয়া, সুদান, পাকিস্তান, ইরান ও আফগানিস্তানে। দেশে দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার নিরন্তর চর্চাই আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজকে বাঁচাতে পারে।
বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের 'জামায়াতে ইসলামী', মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার 'মুসলিম ব্রাদারহুড' এবং তুরস্কের মৌলবাদী 'জাস্টিস এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি' একই পথের পথিক, একই নৌকার যাত্রী। প্রয়োজনে মৌলবাদীরা যদি একে অপরের পাশে দাঁড়াতে পারে, অভীষ্ট লক্ষ্যের জন্য জীবন দিতে পারে-প্রগতির আন্দোলনে যারা যুক্ত, একইভাবে তাদেরও পরস্পরের পাশে দাঁড়াতে হবে। সকল দেশের ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদী শক্তিকে এক মঞ্চে সমবেত হতে হবে। মৌলবাদের তামসিকতা থেকে মুক্ত করতে হবে সমগ্র বিশ্বকে।
২৫ জুলাই ২০১৩
Also Read:
লন্ডন থেকে আঙ্কারা (এক) '৭১-এর গণহত্যাকারীদের বিচার ॥ বিভ্রান্তি ও বানচালের চক্রান্ত
__._,_.___