মেয়েকে বাঁচাতে বখাটেকে খুন, মায়ের কারাবরণ ও আমাদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন
Sunday, 23 March 2014 - 10:08pm
আজকের দৈনিক ইত্তেফাকের একটা খবরের শিরোনাম ছিল এরকম 'বিচার না পেয়ে ঘাতক হয়েছি'। প্রতিদিন পত্রিকা আর অনলাইন মিডিয়াতে এতো এতো খবর আসে, অনেক কিছুই হয়তো আমাদের, একইসাথে নীতি-নির্ধারকদেরও চোখ এড়িয়ে যায়। আর অনেকক্ষেত্রে সুবিচার এদেশের দরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছায় না কিংবা দরিদ্ররাই হয়তো আদালত পর্যন্ত যেতে পারেন না, অবশ্যই প্রতিপক্ষ রাঘব বোয়ালদের ভয়ে। তো এই যখন অবস্থা তখন এই শিরোনামটি অবশ্যই চমকে দেয়ার মতো। কারণ ছোটকাল থেক আমরা শুনে এসেছি 'আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না!'
চলুন জানা যাক ঘটনার সার-সংক্ষেপ। যশোরের সদর উপজেলার দেয়ারা ইউনিয়নের ভেকুটিয়া গ্রামের কৃষাণী খাদিজা বেগম (৪৫)। গত ১২ মার্চ নিজ বাড়িতে তিনি হাসুয়া (বড় দা) দিয়ে হত্যা করেন উত্ত্যক্তকারী একই এলাকার বাসিন্দা পাঁচ সন্তানের পিতা মফিজুর রহমান মফিকে (৪৪)। প্রিয় পাঠক, সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন না এতটকু পড়েই। ঘটনার শুরু কীভাবে হয়েছিল জানা যাক খাদিজার মুখ থেকেই। পুলিশের কাছে তিনি বলেন, "প্রচুর বিষয় বৈভব না থাকলেও সংসারে সুখ ছিল অনেক। কিন্তু মানুষরূপী দানব মফি আমার সেই সুখের সংসার তছনছ করে দিয়েছে। তার হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য পুলিশ-দারোগা, মেম্বার, পার্টির লোকের কাছে গিয়েছি। কেউ আমার সাহায্যে এগিয়ে আসেনি।
একই ইউনিয়নের তেতুলবাড়িয়া গ্রামের মোসলেম শেখের ছেলে মফিজুর রহমান মফি। সে আমার বোনের ননদের মেয়েকে প্রথম বিয়ে করে। ঐ ঘরে তার চার মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। বড় মেয়ে কলেজে পড়ে। তারপরও সে কোটচাঁদপুরে গিয়ে আমার বোনের মেয়ে রুনাকে উত্ত্যক্ত করত। সেখান থেকে রুনার বাবা-মা রুনাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেয়। আমার বাড়িতে এসেও মফি তাকে বিরক্ত করত। একটা সময় রুনা বাধ্য হয়ে মফিকে বিয়ে করে।
এখানেই শেষ নয়। এরপর মফি আমার অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়েকে উত্ত্যক্ত করা শুরু করে। আমি তাকে নানাভাবে বুঝাই যে, ও তোমার মেয়ের চেয়েও ছোট। ওকে বিরক্ত করো না। কিন্তু সে আমার কথা না শুনে সাঙ্গপাঙ্গদের সঙ্গে নিয়ে মাঝেমধ্যেই বাড়িতে এসে শাসাত এবং বিয়ের জন্য চাপ দিত। এ নিয়ে এলাকার লোকজনও নানা বাজে মন্তব্য করতে শুরু করে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে মফির বিরুদ্ধে থানায় জিডি করেছি, জানিয়েছি এলাকার মেম্বারকে, ধর্না দিয়েছি রাজনৈতিক নেতাদের কাছে। কিন্তু মফির বিরুদ্ধে কেউ ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টা মফির উত্পাত আরও বেড়ে যায়। এ অবস্থায় মাসখানেক আগে মেয়েকে আমার মেজ ছেলের ( রাজমিস্ত্রী) কাছে ঢাকায় পাঠিয়ে দেই।ঘটনার দিন মাগরিবের নামাজের পর কোরআন শরীফ পড়ছিলাম। এ সময় মফি ঘরে ঢুকে আমার মেয়ে কোথায় তা জানতে চায় এবং এখনই মেয়েকে তার হাতে তুলে দিতে বলে। এ সময় কৌশল করে রান্নাঘর থেকে বেটে রাখা মরিচ এনে মফির চোখে লাগিয়ে দেই। এরপর হাসুয়া (বড় দা) দিয়ে কুপিয়ে তাকে হত্যা করি।"
ঘটনা এখানেই শেষ। কিন্তু আমরা যারা নারী অধিকার ও তাদেরকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের কথা বলি, তাদের এ ঘটনা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। বাংলাদেশে এখনো নারীরা হোক শিশু কিংবা বৃদ্ধা, নানা ভাবে অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অনেক স্থানে মেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বখাটেদের উৎপাতের কারণে। কত মেয়েকে যে অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যা করতে হয়েছে তার সঠিক হিসেব আমাদের কাছে নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন সেই মেয়েটিকে আত্মহত্যা করতে হবে যে কিনা অপরাধের শিকার? কারণ সমাজ ও পরিবার সব দোষ চাপিয়ে দেয় সে মেয়েটির উপর। অপরাধী পুরুষ ঘুরে বেড়ায় বুক ফুলিয়ে। অনেক শিক্ষিত পরিবারের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, কোনো ঘটনা ঘটলে সাথে সাথে দোষ দেয়া হয় মেয়েটিকে। সে হিসেবে একজন দরিদ্র কৃষাণী খাদিজা বেগম সবার সামনে এক দৃষ্টান্ত, যিনি তার মেয়ের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। যিনি প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন বখাটের উৎপাত থেকে মেয়েকে রক্ষা করতে। তিনি খুন করার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে তৎপরতা দেখিয়েছে, তা কী আগে দেখানো হয়েছিল কিনা সে প্রশ্ন থেকেই যায়। শুধু তাই নয়, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও তার পক্ষে এগিয়ে আসেন নি বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। মফি নামের পশুর বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ানো কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, নারীর প্রতি এদেশের বিভিন্ন পেশার মানুষ কিংবা কিছু মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির দৈন্যতাই ফুটে ওঠে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা কিছুতেই তাদের দায় এড়াতে পারেন না।
খাদিজা যেহেতু খুন করেছেন তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন মাননীয় আদালত। তবে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের আবেদন থাকবে, মহামান্য আদালত যেন পুরো বিষয়টি বিবেচনা করেন। কারণ এখনো যখন সব আশা শেষ হয়ে যায়, রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান অকার্যকর হয়ে পড়ে, তখনো সাধারণ মানুষ আশা করে সে সুবিচার পাবে। আর আমরা সাধারণ মানুষ যারা, তাদের উচিত একজন স্নেহময়ী মা, একজন নিরুপায় নারীর মনের তীব্র ক্ষোভ বুঝতে চেষ্টা করা। যিনি প্রচণ্ড ভালোবাসা আর সাহস নিয়ে তার মেয়ের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। আজ যদি আমরা না বুঝি, তবে মফিদের মতো পিশাচরা হয়তো আমাদেরই মা, বোন, বন্ধু কিংবা স্ত্রীকে উত্যক্ত করবে।
আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাতেই এগিয়ে যাক বাংলাদেশ।
দৈনিক ইত্তেফাকের নিউজ লিঙ্ক দেখুন
http://www.ittefaq.com.bd/index.php?ref=MjBfMDNfMjNfMTRfMV8yXzFfMTE3ODYy
মেয়ের উত্ত্যক্তকারীকে হত্যা করেছি, বিচার না পেয়ে ঘাতক হয়েছি ...
Debate It!
Intruder killing appears justified ?
__._,_.___