৭ মার্চ বজ্র-নির্ঘোষে ধ্বনিত হলো- 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' ২৫ মার্চ ক্ষুধার্ত হায়েনার দল ঝাঁপিয়ে পড়ল নিরস্ত্র জনতার ওপর। রক্তে লাল হলো বাংলার শ্যামল প্রান্তর, যেমনটি পরিকল্পনা করেছিল পাকিস্তানের বর্বর জান্তা আর যা লিখিত হয়েছিল রাও ফরমান আলীর কলমে। কিন্তু এবার আর বাঙালিরা শুধু মার খেয়ে বসে থাকেনি। একাত্তরে বাঙালি দেখাল তারা শুধু মার খাওয়া নয়, মার দিতেও জানে।
কেন এমন হলো? ২৪ বছর আগেও তো বাঙালিরা পাকিস্তান চেয়েছিল। চেয়েছিল মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমি। মানসিকতার এই পরিবর্তন কেন ঘটেছিল আমাদের? সাতচল্লিশের আগে আমাদের পূর্বসূরিরা যা চেয়েছিলেন, সে চাওয়ায় কি ভুল ছিল? একাত্তরে আমরা যা চেয়েছি, সে চাওয়ায় কি ভুল ছিল? আজকের বাংলায় যে রাজনৈতিক অস্থিরতা সেটা কি আমাদের সাতচল্লিশ আর একাত্তরের চাওয়া-পাওয়ার ভারসাম্যহীনতা? শুধু বর্তমানের নয়, ভবিষ্যতের প্রয়োজনে আমাদের করতে হবে সাতচল্লিশ আর একাত্তরের বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ। এ জন্য প্রয়োজন হবে আমাদের ইতিহাসচেতনা। ইতিহাস সমীক্ষণে প্রয়োজন বস্তুনিষ্ঠতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, পরমতসহিষ্ণুতা আর ঠাণ্ডা মস্তিষ্ক। আবার রাও ফরমান আলীর কথায় ফিরে আসতে হয়। তাঁর প্রতি সব অশ্রদ্ধা সত্ত্বেও বলতে হয়, তাঁর একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য, আর সেটি হচ্ছে 'মুসলমানরা উচ্চকণ্ঠে অতীত গৌরবের কথা বলতে ভালোবাসে।' অতীত গৌরবের কথা বলব না কেন। অতীত গৌরব অনুপ্রেরণা জোগাতে পারে; কিন্তু তা বর্তমান বাস্তবতাকে কুয়াশাচ্ছন্ন না করে যেন।
'দ্বিজাতিতত্ত্বের' ভিত্তিতে মুসলমানদের আলাদা আবাসভূমি পাকিস্তানের জন্ম হলো। কিন্তু এর পরই বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হলো পাকিস্তানিদের। জর্জ অরওয়েল তাঁর একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন, 'দেশপ্রেম' ও জাতীয়তাবাদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। 'যেখানে জাতীয়তাবাদের কোনো একটি উপাদানের দিকে বেশি জোর দেওয়া হয়, সেখানে লুক্কায়িত থাকে কারো ক্ষমতালিপ্সা।' ১৯৪০ সালে লাহোরে একটি ভাষণে জিন্নাহ সাহেব দ্বিজাতিতত্ত্বের কথা তুলে ধরেন। কিন্তু পাকিস্তানের জন্মের ঠিক আগে ভারতের অংশের মুসলমানদের তিনি বলেন, তাঁরা যেন ভারতের প্রতি অনুগত থাকেন। আবার পাকিস্তানের জন্মের ঠিক পরই তিনি পাকিস্তানিদের বলেন, কারো ধর্ম রাষ্ট্রের কোনো বিষয় হবে না। ক্ষোভে-দুঃখে মুসলিম লীগের তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী খালিকুজ্জামান বলেছিলেন, 'জিন্নাহ সাহেব প্রথম সুযোগেই তাঁর দ্বিজাতিতত্ত্বকে বিসর্জন দিলেন।' আসলে সম্পূর্ণ বিষয়টি ছিল অত্যন্ত জটিল। জিন্নাহ সাহেবের মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে ধর্মকে ফিরিয়ে আনলেন। বিষয়টি এমন দাঁড়াল যে দেশটি চালাবে সেনাবাহিনী আর গৌরীসেন হবে আমেরিকা। ফল এই হলো যে ক্ষুদ্র প্রদেশগুলোর প্রয়োজন উপেক্ষিত হলো। এমনকি ৫৬ শতাংশ মানুষের বাসভূমি পূর্ব পাকিস্তানকেও অবহেলা করা হলো, আর তখনই বাঙালি মুসলমানদের 'মেকি আজাদির সোনালি বর্ণচ্ছটা শূন্যে মিলিয়ে গেল।'
বাঙালিরা নিজেদের সংস্কৃতি সম্পর্কে সজাগ। তাদের মুখের ভাষা পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ মানুষের মুখের ভাষা। কিন্তু পাকিস্তানের কর্তারা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতেও রাজি হলেন না। ক্রমাগত বৈষম্য আর বঞ্চনায় মুখোমুখি হয়ে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের মোহমুক্তি ঘটল বাঙালিদের।
এদিকে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে দেশের দুই অংশের বৈষম্য দ্রুত বেড়ে চলল। তবু বাংলার মানুষ গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাবান রইল। কিন্তু ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনের ফলাফলকে পাকিস্তানের কর্তারা জানালা দিয়ে বাইরে নিক্ষেপ করলেন। টালবাহানায় কালাতিপাত করে অবশেষে একটি সংবিধান তাঁরা রচনা করলেন ১৯৫৬ সালে। কিন্তু এ সংবিধান বাস্তবায়িত হলো না, সেনাবাহিনী আইয়ুবের নেতৃত্বে নিজ দেশের ক্ষমতা জয় করে বসল। পাকিস্তানের সেনাভক্তরা পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে 'বিশ্বের সেরা' বলত। তাদের কিছু তো জয় করতেই হবে।
ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে স্বনিয়োজিত ফিল্ড মার্শালের পতন হলো। কিন্তু ক্ষমতা দখল করলেন ইয়াহিয়া খান। বাংলার মানুষের সচেতনতায় ভীত ইয়াহিয়া নির্বাচন দিলেন। মনে মনে অন্য ফন্দি আঁটলেন। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল তাঁর পরিকল্পনাকে ভেঙে চুরমার করে দিল। দুটি বাদে সব আসনে বিজয়ী বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার জন্য তিনি টালবাহানা শুরু করলেন। পাকিস্তানের সর্বস্তরের মানুষের আসল রূপ এবার দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়ে দেখা দিল বাংলার মানুষের চোখে। বাংলার মানুষকে তারা মনে করে হিন্দুঘেঁষা। কাজেই বাংলার মুসলমানরা নিম্নশ্রেণীর মুসলমান। তারা পাকিস্তানে থাকতে পারে; কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের অধীনস্থ হয়ে থাকতে হবে তাদের। তারা প্রকৃত স্বাধীনতা পেলে হিন্দুরা সব নিয়ে যাবে। পশ্চিম পাকিস্তানের বেশির ভাগ আসনে বিজয়ী দলের নেতা ভুট্টো সোজাসুজি বলেই দিলেন যে পাকিস্তানকে দুই ভাগ করতে হবে, যার এক ভাগের নেতা হবেন তিনি। তিনি বললেন, 'ইধার হাম আওর উধার তুম।' ইয়াহিয়া আর ভুট্টো মিলে লারকানায় ষড়যন্ত্র করলেন। ২৫ মার্চ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল খানসেনারা। ৯ মাসে ৩০ লাখ বাঙালি হত্যা করল তারা। মুসলমান পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর হাতে ধর্ষিত হলেন বাংলার চার লাখ মুসলমান নারী। ধর্মের নামে পরিচালিত পাকিস্তানের নেতৃত্বে ছিলেন ইয়াহিয়া আর নিয়াজির মতো মদ্যপ ও লম্পট সামরিক-বেসামরিক নেতারা। আর পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ? তাদের মনোভাব কেমন ছিল? পূর্ব পাকিস্তানে যখন গণহত্যা আর গণধর্ষণ চলছিল তখন তারা 'স্পিকটি নট'। ২৫ বছর ধরে তারা পাকিস্তানের সুফল উপভোগ করেছে। সেটা চলতেই থাকুক- এই ছিল তাদের মনোবাঞ্ছা। প্রতিবাদ যে একেবারে হয়নি তা নয়, তবে কণ্ঠস্বর ছিল এত ক্ষীণ যে তা শোনা যায়নি। পাকিস্তানের সেনানায়করা একাত্তরের যুদ্ধের স্মৃতিকথা লিখেছেন কেউ কেউ। তাঁরা বলেছেন, তাঁরা পরাজিত হয়েছেন ভারতের কাছে। সব কিছুই হিন্দুদের ষড়যন্ত্র। বাংলার মানুষের কোনো অভিযোগ তাদের কাছে ধর্তব্য নয়। মুক্তিবাহিনীর কাছে পরাজয় বড্ড লজ্জার। এদেরই আমরা ভাই মনে করে বুকে টেনে নিয়েছিলাম। ভবিষ্যতে এদের মত-মতবাদের কথা বলে কেউ যদি ভ্রাতৃত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়, তবে যেন আমাদের মনে পড়ে পাকিস্তানের ২৪ বছরের কথা। আমাদের যেন মনে পড়ে রক্তাক্ত একাত্তরের কথা।
লেখক : রয়াল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্টের একজন ফেলো
http://www.kalerkantho.com/print-edition/sub-editorial/2014/03/07/59267
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ
০৬ ই মার্চ, ২০০৯ রাত ৮:৪০ |
মনে রাখবা, ''রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ''।
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম''।জয় বাংলা।
__._,_.___