বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত রিপোর্ট রহিম শেখ ॥ আবারও জঙ্গী ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়নের অভিযোগ উঠেছে বেসরকারী খাতের ইসলামী ব্যাংকের বিরুদ্ধে। সন্ত্রাসী ও জঙ্গী কার্যক্রমে অর্থায়ন বিষয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা এক গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনুমোদনহীন 'এডুকেশন এইড বাংলাদেশ' নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে সোয়া ৫৫ লাখ টাকা দিয়ে সে টাকার ব্যবহার সম্পর্কে কোন তথ্য দিতে পারেনি ইসলামী ব্যাংক। এ ছাড়া 'সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এ্যান্ড পলিসি স্টাডিজ (সিএসপিএস)' নামক একটি তথাকথিত গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে ১ কোটি ২৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছে ইসলামী ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন। গত ১৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমানের কাছে ইসলামী ব্যাংকে 'ঘটে যাওয়া দুর্নীতি' সম্পর্কে দ্রুত তথ্য পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়। ওই চিঠির প্রেক্ষিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। জানা গেছে, ১২ বছর চলার পর এডুকেশন এইড নামের প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত হয়ে যায়। এক মাসে গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের ইংরেজী ভাষা শিক্ষা দেয়ার নাম করে চালানো হতো এডুকেশন এইড বাংলাদেশ। এক মাস কোন শিক্ষার্থী নির্দিষ্ট একটি বাসার বাইরে যেতে পারত না। তবে এ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সরকারের কাছ থেকে কোন অনুমোদন ছিল না প্রতিষ্ঠানটির। তারপরও এ অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠানে সোয়া ৫৫ লাখ টাকা অনুদান দেয় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। অভিযোগ উঠেছে, ১৯৯৭ সাল থেকে শুরু করে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বিপুল পরিমাণ এ অর্থ ইংরেজী ভাষা শিক্ষার নামে সন্ত্রাসী ও জঙ্গী কার্যক্রমে অর্থ দিয়েছে বেসরকারী খাতের এ ব্যাংকটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়, এডুকেশন এইড নামের প্রতিষ্ঠানটি ইংরেজী ও কম্পিউটার শিক্ষার নামে জঙ্গী প্রশিক্ষণ দিত। এক মাস একটি নির্দিষ্ট বাসায় উঠতি বয়সের ইসলামের প্রতি দুর্বল শিক্ষার্থীদের আলকায়দার আদলে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন কর্তৃক এডুকেশন এইড বাংলাদেশ নামক একটি অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠানকে দেয়া বিপুল অঙ্কের অর্থের ব্যবহার সরজমিনে যাচাই করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল উক্ত প্রতিষ্ঠানে যেতে চায়। কিন্তু ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ জানায়, আর্থিক সঙ্কটের কারণে প্রতিষ্ঠানটি ২০০৯ সালে বন্ধ হয়ে গেছে। তবে ওই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. মীর মোঃ আকরামুজ্জামান এবং নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. এম কোরবান আলীর সঙ্গে ফাউন্ডেশন কার্যালয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দলের বৈঠকের ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে পরিদর্শন দলকে তারা জানান, ১৯৯৭ সালে ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় ৪৫, পূর্ব তেজতুরী বাজার হোল্ডিং এ অবস্থিত ভাড়া বাড়িতে তারা মূলত ইংরেজী ভাষা কার্যক্রম পরিচালনা এবং কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রদান করতেন। তবে প্রতিষ্ঠানটি তাদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সরকারের কোন দফতর থেকে কোন প্রকার রেজিস্ট্রেশন কিংবা অনুমোদন গ্রহণ করেনি। ইংরেজী ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম ছিল সম্পূর্ণ আবাসিক একটি কোর্স। যার মেয়াদকাল ছিল এক মাস। মেয়াদকালে কোন শিক্ষার্থীর ওই বাসার বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। প্রশিক্ষণার্থীদের কাছ থেকে নির্ধারিত ফিও নেয়া হতো। প্রতিষ্ঠানটিকে ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন অনুদান দেয় ৫৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা। পরিদর্শক দলের কাছে মনে হয়েছে, ইসলামী ব্যাংকের টাকা ও প্রশিক্ষণার্থীদের কাছ থেকে ফি আদায়ের পরও প্রতিষ্ঠানটি আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে ২০০৯ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া রহস্যজনক। এ ধরনের অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সহায়তা প্রদানের বিষয়ে ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন বলছে, যেহেতু প্রতিষ্ঠানটি গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান করে, তাই তাদের অনুদান হিসেবে আলোচ্য অর্থ সরবরাহ করা হয়েছে। তবে বক্তব্যের সমর্থনে তারা কোন কাগজপত্র সরবরাহ করতে পারেনি। সোমবার ফার্মগেট এলাকার ৪৫, পূর্ব তেজতুরী বাজার হোল্ডিং এ অবস্থিত ভাড়া বাড়িতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্ট কাউকেই পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান জনকণ্ঠকে বলেন, এ ধরনের বিনিয়োগ কবে নাগাদ হয়েছে আমার জানা নেই। যদি বিনিয়োগ হয়ে থাকে তবে বাংলাদেশ ব্যাংক যদি কোন পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দেয়, ইসলামী ব্যাংক তা পরিপালন করবে। সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এ্যান্ড পলিসি স্টাডিজ (সিএসপিএস) নামক একটি তথাকথিত গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে ১ কোটি ২৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছে বেসরকারী ইসলামী ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন। প্রদত্ত অর্থের পরিমাণ, উদ্দেশ্য ইত্যাদি বিষয়ে ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্র সরবরাহ করলেও অর্থগ্রহীতা প্রতিষ্ঠান এসব বিষয়ে কোন তথ্য প্রদান করেনি। ফলে বরাদ্দকৃত অর্থ সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠান যথার্থ ব্যবহার করেছে কিনা তা নিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ ছাড়া দীর্ঘ ১০ বছরে তাদের গবেষণার ফলাফল বিষয়ে বা তাদের গবেষণালব্ধ জ্ঞান সমাজে কী অবদান রেখেছে সে সংক্রান্ত কোন তথ্য ফাউন্ডেশন প্রদান করেনি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্য সরবরাহের জন্য লিখিত অনুরোধ করে। কিন্তু কোন আইনে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের কাছে তথ্য চায় তা জানতে চেয়ে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শাহ আবদুল হান্নান বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি চিঠি দেন। চিঠিতে প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইট িি.িপংঢ়ংনফ.পড়স উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে এ ওয়েবসাইট খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এ সংক্রান্ত যে ওয়েবসাইট খুঁজে পাওয়া যায় সেটির ঠিকানা ইন্দোনেশিয়ার বোর্নিওতে। এ বিষয়ে পরিদর্শন দল বলছে, অন্যান্য প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন দলকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করলেও ওই প্রতিষ্ঠান কোন ধরনের তথ্য দিয়ে সহায়তা করেনি। তারা মনে করে, শাহ আবদুল হান্নান ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনেরও চেয়ারম্যান হওয়ায় এক্ষেত্রে তিনি নিজের প্রতিষ্ঠানকে অর্থ বরাদ্দ দেয়া ও তার ব্যবহার পরিদর্শন দলকে সরজমিনে পরিদর্শন করতে না দেয়ায় প্রতিষ্ঠানটির কর্মকাণ্ড নিয়ে তীব্র সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিবেদনে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, ইসলামী ব্যাংক গুলশান শাখায় ওই প্রতিষ্ঠানের আল-ওয়াদিয়াহ্ চলতি হিসাব ০১০০৬৭৫৮ এর হিসাব খোলার ফরম ও নমুনা স্বাক্ষর কার্ড থেকে দেখা যায়, মেজর জেনারেল (অব) গোলাম কাদের, মোহাম্মদ ইব্রাহিম, শাহ আবদুল মান্নান, মীর কাসেম আলী, মেজর জেনারেল (অব) আজীজুর রহমান (বীর উত্তম), মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মাদ ইব্রাহিম (বীর প্রতীক) ব্যক্তিগণ বিভিন্ন সময়ে হিসাব পরিচালনাকারী হিসেবে ছিলেন। নমুনা ভিত্তিতে সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এ্যান্ড স্টাডিজের আল-ওয়াদিয়াহ চলতি হিসাব ০১০০৬৭৫৮ এর কতিপয় চেক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, তারা ওই শাখায় পরিচালিত সিএসপিএস পেটি ক্যাশ খাতে অধিকাংশ অর্থ স্থানান্তর করে সেখান থেকে লেনদেন করেছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান জনকণ্ঠকে বলেন, কোন প্রতিষ্ঠানে কবে নাগাদ টাকা দেয়া হয়েছে তা বলা সম্ভব নয়। সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এ্যান্ড পলিসি স্টাডিজ (সিএসপিএস) প্রতিষ্ঠানে টাকা দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ ধরনের কোন প্রতিষ্ঠানে ইসলামী ব্যাংক বা ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে টাকা দেয়া হয়নি। জানা যায়, গত ১৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক মোহাম্মদ মোখলেছুর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠি পাঠানো হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবর্নর আতিউর রহমানের কাছে। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ইসলামী ব্যাংকে ঘটে যাওয়া অনিয়ম-দুর্নীতি সম্পর্কে ইতোপূর্বে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু তথ্য দিয়ে সরকারকে সহযোগিতা করেছে। আরও কিছু অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এসেছে। এসব ক্ষেত্রে যে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রয়োজন। আশা করছি, দ্রুত তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করবেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আসা ইসলামী ব্যাংকের 'দুর্নীতির' অভিযোগের নথিপত্রের অনুলিপি ওই চিঠির সঙ্গে সংযুক্ত করে গবর্নরের কাছে পাঠানো হয়েছে। ওই চিঠির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক গোপন প্রতিবেদনটি তৈরি করে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শীঘ্রই প্রতিবেদনটি পাঠানো হবে। প্রসঙ্গত, জঙ্গী অর্থায়নের অভিযোগ ওঠার পর কয়েক বছর ধরেই আন্তর্জাতিক চাপে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক। এইচএসবিসি যুক্তরাজ্য, সিটি ব্যাংক এনএ, ব্যাংক অব আমেরিকা ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন বন্ধ করে দেয়। দেশের মধ্যে ঋণ বিতরণেও ইসলামী ব্যাংকের বিভিন্ন অনিয়ম ধরা পড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক পরিদর্শনে। |
__._,_.___