মঙ্গলবার, ১৯ আগষ্ট ২০১৪, ৪ ভাদ্র ১৪২১
কী চাইছে বিএনপি?
মাসুদা ভাট্টি
১৫ আগস্ট, জাতীয় শোক দিবস পালিত হলো। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা তো ছিলই; কিন্তু লক্ষ্য করার মতো যা ছিল তাহলো সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে তরুণ প্রজন্ম যেভাবে এই দিনটি নিয়ে আলোচনা করেছে তাতে মনে হয়েছে সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন বঙ্গবন্ধু তার স্বমহিমায় বাঙালী জাতি ইতিহাসে তার প্রকৃত আসনটি প্রতিষ্ঠা করে নেবেন। একথা মানতেই হবে যে, এখনও আমরা বঙ্গবন্ধুকে তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান দিতে পারিনি। এবারও যথারীতি দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়া ১৫ আগস্টের এই শোকাবহ দিনে ৬৯ পাউন্ড ওজনের ঢাউস কেক কেটে তার ভুয়া জন্মদিন পালন করেছেন। হাসিমুখে তার পাশে দাঁড়িয়ে ছবির জন্য পোজ দিয়েছেন তার দলের সিনিয়র-জুনিয়র নেতৃবৃন্দ। এবং ১৫ আগস্ট নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বেগম জিয়া বঙ্গবন্ধুকে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বোঝাই যাচ্ছে, এত দূরবস্থাতেও তার নোংরা মনমানসিকতা একটুও কমেনি।
এই নোংরামোর শুরুও সেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টেই। বঙ্গবন্ধুর মৃতদেহ তখনও পড়ে আছে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের সিঁড়িতে। তখনই রেডিও স্টেশনে গিয়ে খুনীরা ঘোষণা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে অপমান করা শুরু করেছে। চলচ্চিত্রকার খান আতা'র মতো চিহ্নিত পাকিস্তানপ্রেমীগণ গিয়ে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের সূর্যসন্তান আখ্যা দিয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গান লিখে তাতে সুরারোপ করে রেডিওতে প্রচারের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। আপেল মাহমুদের মতো তথাকথিত শব্দসৈনিকরা খুনীদের সহযোগিতায় নেমেছিল হাত-পা ধুয়ে। তারপর তো দীর্ঘ অন্ধকারের যুগ এদেশে। বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগ বিরোধিতায় বহু রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল রাতারাতি। যার প্রথম ও প্রধানটি ছিল জেনারেল জিয়াউর রহমানের বিএনপি (প্রথমে জাগদল নামে ও পরে বিএনপি নামে)। আওয়ামী লীগ একটি রাজনৈতিক দল, তার বিরোধী শক্তি হিসেবে গণতান্ত্রিক নিয়মে যদি কোন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত হয় তাতে আপত্তির কিছু থাকার কথা নয়। কিন্তু কার্যত দেখা গেল যে, এদেশে আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করে নয়, কেবল বঙ্গবন্ধু-বিরোধিতায় যে রাজনৈতিক শক্তিটি মাথাচাড়া দিয়ে উঠল তা সরকারী অর্থে অতি দ্রুত ফুলে-ফেঁপে উঠল। পাকিস্তান, সৌদি আরব ও চৈনিক অর্থ-সাহায্যে এই প্লাটফরমগুলো বাংলাদেশে রাজনীতির ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে বসল। পাকিস্তান, সৌদি আরব ও লন্ডন থেকে ফিরে এলো দেশবিরোধীরা এবং দেশের ভেতর আত্মগোপনে থাকা স্বাধীনতা-বিরোধীরাও সাপের মতো শীতনিদ্রা থেকে বেরিয়ে এলো দ্রুত। আর এই সব কু-রাজনীতির মধ্যে বঙ্গবন্ধু এক প্রকার নিষিদ্ধই হয়ে পড়লেন। আওয়ামী লীগ তো ভেঙ্গেচুরে দলামোচড়া হয়ে পড়েই ছিল শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত।
কিন্তু সামরিক শাসনকাল পেরিয়ে যখন বাংলাদেশ নতুন করে ভোটের রাজনীতির যুগে প্রবেশ করল তখন বঙ্গবন্ধু পড়লেন নতুনতর বিপাকে। এতদিন তাঁর নাম মুছে ফেলার চেষ্টা করা হলেও তাঁকে কেউ বিকৃত করে উপস্থাপন করার সাহস দেখায়নি। এই গণতান্ত্রিক আমলের পরই পরবর্তী সময় থেকে বঙ্গবন্ধুর বিরোধীরা তাঁকে নানাভাবে অপদস্থ করতে শুরু করলেন। অপমান করার দুঃসাহস দেখাতে শুরু করল। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে থাকলেন বিএনপিনেত্রী খালেদা জিয়া। ১৫ আগস্ট তিনি ঘোষণা করলেন তার তথাকথিত জন্মদিনের। স্বাভাবিকভাবেই হিযবুল বাহারে ঘোরা প্রজন্ম বেগম জিয়ার এই কেক কাটার অশ্লীল আনন্দে উদ্বেলিত হতে শুরু করল। বেগম জিয়ার পারিষদবর্গ, তাকে তুস্ট করতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ইতিহাস বিকৃতির চরম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলো। আর সেই সময়ে জেনারেল জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বানিয়ে দেয়া হলো প্রথমে ২৭ মার্চ তারিখে এবং পরে ২৬ মার্চেই তার ঘোষণার দিন তারিখ ঠিক হলো। যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ মানেই বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ মানেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ সেহেতু মুক্তিযুদ্ধকে বিএনপি'র কোলে টানতেই হবে। অথচ জেনারেল জিয়া কিন্তু এর ধার মোটেও ধারেননি। তিনি জীবিতাবস্থায় নিজেকে কোনদিন মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক দাবি করেননি। একথা সত্য, তিনি পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধীদের দেশে ফিরিয়ে এনেছেন। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সংবিধানের চার মূলনীতিকে উচ্ছেদ করেছেন। দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালুর মাধ্যমে মূলত তিনি স্বাধীনতা-বিরোধীদের পুনর্বাসন করেছেন। এবং সেনাবাহিনীর ভেতর অগণিত মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ যে আসলে জিয়াউর রহমানের কাছে খুব বড় কোন বিষয় ছিল না কিংবা তার সঙ্গে নিজেকে জড়ানোটা যে খুব বড় সম্মানের সে সম্পর্কে তার ভেতর কোন ভিন্ন আবেগ কাজ করেনি, তা তার জীবন ও কর্মকে একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়। কিন্তু তার স্ত্রী বুঝেছিলেন যে, এদেশে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে রাজনীতি করতে পারলে আওয়ামী লীগের হাত থেকে মুক্তিযুদ্ধকে হাইজ্যাক করা সম্ভব হবে এবং তিনি এতে অনেকটাই সফল হয়েছেন বলা যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশকে তিনি লোভ দেখিয়ে হোক কিংবা অন্য যেভাবেই হোক নিজের দিকে আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। এবং মজার ব্যাপার হলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিতে তিনি এই মুক্তিযোদ্ধাদেরই কাজে লাগিয়েছেন সবচেয়ে বেশি। তিনি হয়ত ভেবেছেন যে, এদের দিয়ে যদি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিএনপি'র মতো করে বলানো যায় তাহলে মানুষ বিশ্বাস করলেও করতে পারে। বলাই বাহুল্য কেউ কেউ এই চাতুর্যে বিশ্বাসও করতে শুরু করেছেন, বিশেষ করে ৮০ ও ৯০-এর প্রজন্ম।
কিন্তু মাঝখানে ১৯৯৬ চলে আসায় বেগম জিয়া ও তার দলকে একটুখানি অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয়। কারণ, এই সময়েই বাংলাদেশে আবার মুক্তিযুদ্ধের স্বাভাবিক ও সত্য ইতিহাস উদ্ভাসিত হতে শুরু করে। এতে শেখ হাসিনার প্রথম সরকার খুব যে সফল হয়েছে তা বলা যাবে না; কিন্তু যতটুকুই হয়েছে তাতেও মানুষের চেতনায় নতুন করে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া শুরুর ফলে দেশের মানুষের সামনে ইতিহাসের যে অকথিত নিষিদ্ধ অধ্যায় উন্মোচিত হতে শুরু করে তাতে এদেশে বিএনপির রাজনীতিই প্রশ্নের মুখে পড়ে। অন্য যে কোন স্বাভাবিক দেশ হলে এই ষড়যন্ত্র ও হত্যার রাজনীতির জন্য এই রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল হতো এবং নিক্ষিপ্ত হতো ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে। কিন্তু এটা বাংলাদেশ বলেই হয়ত ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত আবার ক্ষমতায় বসে। কিন্তু এটাও ইতিহাসের বাস্তবতা যে, ২০০১ সালে জোট সরকারের ক্ষমতায় আসাটা আসলে প্রয়োজন ছিল, কারণ তা না হলে মানুষ বুঝতেই পারত না যে, এদেশে মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধিতা কেমন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। এদেশে দুর্নীতিই বা কেমন লাগামহীন হতে পারে তাও মানুষের অজানাই থেকে যেত যদি না হাওয়া ভবন প্রতিষ্ঠিত হতো। এদেশে জঙ্গীবাদের ভয়াবহতা মানুষের অজ্ঞাত থেকে যেত যদি না সারা দেশে একযোগে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা না ঘটত। এদেশের বিরোধী রাজনীতি যে কাম্য নয় সে ধারণা পাওয়া যেত না, যদি ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা না হতো। এরকম বহু উদাহরণ দেয়া যেতে পারে জোট আমলের। কিন্তু তাতে লেখার কলেবর বাড়ানো ছাড়া আর কোন উপকার হবে না। আর এই সময়ই বঙ্গবন্ধুকে সবচেয়ে বেশি অপমানের শিকার হতে হয়েছে এবং তাতেই এদেশের মানুষ বুঝতে সক্ষম হয়েছে যে, এরা কারা? কী তাদের উদ্দেশ্য? কেন তারা মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে বার বার অপমান করে? কেন তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দাবি করেও বার বারই নিজেদের পাকিস্তানের একনিষ্ঠ সেবক হিসেবে প্রমাণ করে? যদি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের সঙ্গে তারা জড়িত নাই-ই হবে তাহলে কেন তারা এই দিনে নৃত্যগীত উৎসব পালন করে? এরকম বহু প্রশ্নের মুখোমুখি আমাদের করেছে বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনামল।
আর ২০০৮ সালে যখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে তখন তো দুধ এবং পানি আলাদা হতে মোটেও সময় লাগেনি। মানুষের সামনে বিএনপি ও জামায়াতের নগ্ন চেহারা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু তখন যে সমস্যাটি বিএনপি সমর্থকদের হয়েছে তাহলো, তারা আসলে বুঝতে পারেনি যে, বিএনপি বলে আলাদা কোন দল আদৌ কি আছে? যেমন এখন অনেকেই প্রশ্ন করছেন যে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জামায়াতের যে অবস্থান বিএনপিরও সেই একই অবস্থান, ১৫ আগস্ট নিয়ে জামায়াতের যে অবস্থান বিএনপিরও সেই একই অবস্থান; বিএনপি'র রাজনীতি আর জামায়াতের রাজনীতিতে পার্থক্য খুব সামান্য- তাহলে বিএনপি নামক একটি আলাদা রাজনৈতিক দলের আদৌ কোন প্রয়োজন আছে কি? কিংবা বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে আলাদা অস্তিত্বই বা কোথায়? তারেক জিয়া যেমন বলেছিলেন, বিএনপি ও জামায়াত হচ্ছে একই মায়ের পেটের দুই ভাই। কিন্তু সামাজিক গণমাধ্যমে এখন কেউ কেউ কৌতুক করে বলছেন, জামায়াত যদি মওদুদীর বৈধ সন্তান হয় তাহলে বিএনপি তার অবৈধ সন্তান। এটা নিছকই কৌতুক হয়ত, কিন্তু কৌতুক হলেও প্রশ্নগুলো যখন উঠছে তখন বিএনপিকে এর জবাব দিতে হবে এবং না দিতে পারলে দলের দুরবস্থা ক্রমশ আরও নিম্নগামী হবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। হয়ত আরও কিছুকাল ১৫ আগস্টে বিশাল কেক কেটে আনন্দ উৎসব করা সম্ভব হবে বেগম জিয়ার পক্ষে; কিন্তু কিছুকাল পরে হয়ত এই আনন্দে অংশগ্রহণের লোকেরও অভাব পড়বে। যে মুসলিম লীগকে গলাধঃকরণ করে বিএনপি আজ রাজনীতি করছে, তার পরিণতি বিএনপিকেও বরণ করতে হতে পারে সে কথা তো অনেকেই অনেকদিন থেকেই বলে আসছেন। বেগম জিয়া না বুঝুন, দলের নেতাদের অনেকেই যে সেটা বুঝতে পেরেছেন তা তো বোঝা যাচ্ছে দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকেই। তবে কি এখন কেবলই সেই সময় গণনা?
অবশ্য অনেকেই বলছেন যে, বিএনপি ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সময় নিচ্ছে। কেউ কেউ আবার এও বলছেন যে, বড় ধরনের ষড়যন্ত্র নিয়ে দলটি সামনের দিকে এগুচ্ছে। ষড়যন্ত্র আর বিএনপি এখন সমার্থক শব্দ হয়ে উঠছে। সম্প্রতি বিএনপি নেতা রাজশাহীর মেয়র মিনু সাহেব সদম্ভে বলেছেন, আগামী ২১ দিনের মধ্যে শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করা হবে। তিনি নিশ্চয়ই কোন আভাস থেকে এই ভবিষ্যত বাণীটি করেছেন। বেগম জিয়া বলেছেন, নতুন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। রিজভী সাহেব বলেছেন, প্রয়োজনে বিএনপি ভিন্ন পথে হাঁটবে। ষড়যন্ত্র করে বার বার সফল হওয়ার ইতিহাস তাদের রয়েছে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের কিন্তু মানুষ বিশ্বাস করে না বলেও প্রমাণিত হয়েছে। আবারও যদি সে পথে হেঁটেই বিএনপি ঘুরে দাঁড়াতে চায় তাহলে আগামী দিনে দলটির অস্তিত্ব নিয়ে যে টানাটানি পড়বে তাতে সন্দেহ নেই। এই আধুনিক ও সচেতন সময়ে ষড়যন্ত্র করে বেশিদূর এগুনো যাবে না। এটা যে ১৯৭৫ সাল নয়, নয় ২০০১ সালও, সেকথা বিএনপি যত মনে রাখবে ততই দলটির জন্য মঙ্গল।
ঢাকা ॥ ১৮ আগস্ট, সোমবার ॥ ২০১৪ ॥
masuda.bhatti@gmail.com
এই নোংরামোর শুরুও সেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টেই। বঙ্গবন্ধুর মৃতদেহ তখনও পড়ে আছে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের সিঁড়িতে। তখনই রেডিও স্টেশনে গিয়ে খুনীরা ঘোষণা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে অপমান করা শুরু করেছে। চলচ্চিত্রকার খান আতা'র মতো চিহ্নিত পাকিস্তানপ্রেমীগণ গিয়ে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের সূর্যসন্তান আখ্যা দিয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গান লিখে তাতে সুরারোপ করে রেডিওতে প্রচারের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। আপেল মাহমুদের মতো তথাকথিত শব্দসৈনিকরা খুনীদের সহযোগিতায় নেমেছিল হাত-পা ধুয়ে। তারপর তো দীর্ঘ অন্ধকারের যুগ এদেশে। বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগ বিরোধিতায় বহু রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল রাতারাতি। যার প্রথম ও প্রধানটি ছিল জেনারেল জিয়াউর রহমানের বিএনপি (প্রথমে জাগদল নামে ও পরে বিএনপি নামে)। আওয়ামী লীগ একটি রাজনৈতিক দল, তার বিরোধী শক্তি হিসেবে গণতান্ত্রিক নিয়মে যদি কোন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত হয় তাতে আপত্তির কিছু থাকার কথা নয়। কিন্তু কার্যত দেখা গেল যে, এদেশে আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করে নয়, কেবল বঙ্গবন্ধু-বিরোধিতায় যে রাজনৈতিক শক্তিটি মাথাচাড়া দিয়ে উঠল তা সরকারী অর্থে অতি দ্রুত ফুলে-ফেঁপে উঠল। পাকিস্তান, সৌদি আরব ও চৈনিক অর্থ-সাহায্যে এই প্লাটফরমগুলো বাংলাদেশে রাজনীতির ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে বসল। পাকিস্তান, সৌদি আরব ও লন্ডন থেকে ফিরে এলো দেশবিরোধীরা এবং দেশের ভেতর আত্মগোপনে থাকা স্বাধীনতা-বিরোধীরাও সাপের মতো শীতনিদ্রা থেকে বেরিয়ে এলো দ্রুত। আর এই সব কু-রাজনীতির মধ্যে বঙ্গবন্ধু এক প্রকার নিষিদ্ধই হয়ে পড়লেন। আওয়ামী লীগ তো ভেঙ্গেচুরে দলামোচড়া হয়ে পড়েই ছিল শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত।
কিন্তু সামরিক শাসনকাল পেরিয়ে যখন বাংলাদেশ নতুন করে ভোটের রাজনীতির যুগে প্রবেশ করল তখন বঙ্গবন্ধু পড়লেন নতুনতর বিপাকে। এতদিন তাঁর নাম মুছে ফেলার চেষ্টা করা হলেও তাঁকে কেউ বিকৃত করে উপস্থাপন করার সাহস দেখায়নি। এই গণতান্ত্রিক আমলের পরই পরবর্তী সময় থেকে বঙ্গবন্ধুর বিরোধীরা তাঁকে নানাভাবে অপদস্থ করতে শুরু করলেন। অপমান করার দুঃসাহস দেখাতে শুরু করল। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে থাকলেন বিএনপিনেত্রী খালেদা জিয়া। ১৫ আগস্ট তিনি ঘোষণা করলেন তার তথাকথিত জন্মদিনের। স্বাভাবিকভাবেই হিযবুল বাহারে ঘোরা প্রজন্ম বেগম জিয়ার এই কেক কাটার অশ্লীল আনন্দে উদ্বেলিত হতে শুরু করল। বেগম জিয়ার পারিষদবর্গ, তাকে তুস্ট করতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ইতিহাস বিকৃতির চরম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলো। আর সেই সময়ে জেনারেল জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বানিয়ে দেয়া হলো প্রথমে ২৭ মার্চ তারিখে এবং পরে ২৬ মার্চেই তার ঘোষণার দিন তারিখ ঠিক হলো। যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ মানেই বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ মানেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ সেহেতু মুক্তিযুদ্ধকে বিএনপি'র কোলে টানতেই হবে। অথচ জেনারেল জিয়া কিন্তু এর ধার মোটেও ধারেননি। তিনি জীবিতাবস্থায় নিজেকে কোনদিন মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক দাবি করেননি। একথা সত্য, তিনি পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধীদের দেশে ফিরিয়ে এনেছেন। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সংবিধানের চার মূলনীতিকে উচ্ছেদ করেছেন। দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালুর মাধ্যমে মূলত তিনি স্বাধীনতা-বিরোধীদের পুনর্বাসন করেছেন। এবং সেনাবাহিনীর ভেতর অগণিত মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ যে আসলে জিয়াউর রহমানের কাছে খুব বড় কোন বিষয় ছিল না কিংবা তার সঙ্গে নিজেকে জড়ানোটা যে খুব বড় সম্মানের সে সম্পর্কে তার ভেতর কোন ভিন্ন আবেগ কাজ করেনি, তা তার জীবন ও কর্মকে একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়। কিন্তু তার স্ত্রী বুঝেছিলেন যে, এদেশে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে রাজনীতি করতে পারলে আওয়ামী লীগের হাত থেকে মুক্তিযুদ্ধকে হাইজ্যাক করা সম্ভব হবে এবং তিনি এতে অনেকটাই সফল হয়েছেন বলা যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশকে তিনি লোভ দেখিয়ে হোক কিংবা অন্য যেভাবেই হোক নিজের দিকে আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। এবং মজার ব্যাপার হলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিতে তিনি এই মুক্তিযোদ্ধাদেরই কাজে লাগিয়েছেন সবচেয়ে বেশি। তিনি হয়ত ভেবেছেন যে, এদের দিয়ে যদি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিএনপি'র মতো করে বলানো যায় তাহলে মানুষ বিশ্বাস করলেও করতে পারে। বলাই বাহুল্য কেউ কেউ এই চাতুর্যে বিশ্বাসও করতে শুরু করেছেন, বিশেষ করে ৮০ ও ৯০-এর প্রজন্ম।
কিন্তু মাঝখানে ১৯৯৬ চলে আসায় বেগম জিয়া ও তার দলকে একটুখানি অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয়। কারণ, এই সময়েই বাংলাদেশে আবার মুক্তিযুদ্ধের স্বাভাবিক ও সত্য ইতিহাস উদ্ভাসিত হতে শুরু করে। এতে শেখ হাসিনার প্রথম সরকার খুব যে সফল হয়েছে তা বলা যাবে না; কিন্তু যতটুকুই হয়েছে তাতেও মানুষের চেতনায় নতুন করে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া শুরুর ফলে দেশের মানুষের সামনে ইতিহাসের যে অকথিত নিষিদ্ধ অধ্যায় উন্মোচিত হতে শুরু করে তাতে এদেশে বিএনপির রাজনীতিই প্রশ্নের মুখে পড়ে। অন্য যে কোন স্বাভাবিক দেশ হলে এই ষড়যন্ত্র ও হত্যার রাজনীতির জন্য এই রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল হতো এবং নিক্ষিপ্ত হতো ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে। কিন্তু এটা বাংলাদেশ বলেই হয়ত ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত আবার ক্ষমতায় বসে। কিন্তু এটাও ইতিহাসের বাস্তবতা যে, ২০০১ সালে জোট সরকারের ক্ষমতায় আসাটা আসলে প্রয়োজন ছিল, কারণ তা না হলে মানুষ বুঝতেই পারত না যে, এদেশে মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধিতা কেমন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। এদেশে দুর্নীতিই বা কেমন লাগামহীন হতে পারে তাও মানুষের অজানাই থেকে যেত যদি না হাওয়া ভবন প্রতিষ্ঠিত হতো। এদেশে জঙ্গীবাদের ভয়াবহতা মানুষের অজ্ঞাত থেকে যেত যদি না সারা দেশে একযোগে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা না ঘটত। এদেশের বিরোধী রাজনীতি যে কাম্য নয় সে ধারণা পাওয়া যেত না, যদি ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা না হতো। এরকম বহু উদাহরণ দেয়া যেতে পারে জোট আমলের। কিন্তু তাতে লেখার কলেবর বাড়ানো ছাড়া আর কোন উপকার হবে না। আর এই সময়ই বঙ্গবন্ধুকে সবচেয়ে বেশি অপমানের শিকার হতে হয়েছে এবং তাতেই এদেশের মানুষ বুঝতে সক্ষম হয়েছে যে, এরা কারা? কী তাদের উদ্দেশ্য? কেন তারা মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে বার বার অপমান করে? কেন তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দাবি করেও বার বারই নিজেদের পাকিস্তানের একনিষ্ঠ সেবক হিসেবে প্রমাণ করে? যদি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের সঙ্গে তারা জড়িত নাই-ই হবে তাহলে কেন তারা এই দিনে নৃত্যগীত উৎসব পালন করে? এরকম বহু প্রশ্নের মুখোমুখি আমাদের করেছে বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনামল।
আর ২০০৮ সালে যখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে তখন তো দুধ এবং পানি আলাদা হতে মোটেও সময় লাগেনি। মানুষের সামনে বিএনপি ও জামায়াতের নগ্ন চেহারা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু তখন যে সমস্যাটি বিএনপি সমর্থকদের হয়েছে তাহলো, তারা আসলে বুঝতে পারেনি যে, বিএনপি বলে আলাদা কোন দল আদৌ কি আছে? যেমন এখন অনেকেই প্রশ্ন করছেন যে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জামায়াতের যে অবস্থান বিএনপিরও সেই একই অবস্থান, ১৫ আগস্ট নিয়ে জামায়াতের যে অবস্থান বিএনপিরও সেই একই অবস্থান; বিএনপি'র রাজনীতি আর জামায়াতের রাজনীতিতে পার্থক্য খুব সামান্য- তাহলে বিএনপি নামক একটি আলাদা রাজনৈতিক দলের আদৌ কোন প্রয়োজন আছে কি? কিংবা বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে আলাদা অস্তিত্বই বা কোথায়? তারেক জিয়া যেমন বলেছিলেন, বিএনপি ও জামায়াত হচ্ছে একই মায়ের পেটের দুই ভাই। কিন্তু সামাজিক গণমাধ্যমে এখন কেউ কেউ কৌতুক করে বলছেন, জামায়াত যদি মওদুদীর বৈধ সন্তান হয় তাহলে বিএনপি তার অবৈধ সন্তান। এটা নিছকই কৌতুক হয়ত, কিন্তু কৌতুক হলেও প্রশ্নগুলো যখন উঠছে তখন বিএনপিকে এর জবাব দিতে হবে এবং না দিতে পারলে দলের দুরবস্থা ক্রমশ আরও নিম্নগামী হবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। হয়ত আরও কিছুকাল ১৫ আগস্টে বিশাল কেক কেটে আনন্দ উৎসব করা সম্ভব হবে বেগম জিয়ার পক্ষে; কিন্তু কিছুকাল পরে হয়ত এই আনন্দে অংশগ্রহণের লোকেরও অভাব পড়বে। যে মুসলিম লীগকে গলাধঃকরণ করে বিএনপি আজ রাজনীতি করছে, তার পরিণতি বিএনপিকেও বরণ করতে হতে পারে সে কথা তো অনেকেই অনেকদিন থেকেই বলে আসছেন। বেগম জিয়া না বুঝুন, দলের নেতাদের অনেকেই যে সেটা বুঝতে পেরেছেন তা তো বোঝা যাচ্ছে দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকেই। তবে কি এখন কেবলই সেই সময় গণনা?
অবশ্য অনেকেই বলছেন যে, বিএনপি ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সময় নিচ্ছে। কেউ কেউ আবার এও বলছেন যে, বড় ধরনের ষড়যন্ত্র নিয়ে দলটি সামনের দিকে এগুচ্ছে। ষড়যন্ত্র আর বিএনপি এখন সমার্থক শব্দ হয়ে উঠছে। সম্প্রতি বিএনপি নেতা রাজশাহীর মেয়র মিনু সাহেব সদম্ভে বলেছেন, আগামী ২১ দিনের মধ্যে শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করা হবে। তিনি নিশ্চয়ই কোন আভাস থেকে এই ভবিষ্যত বাণীটি করেছেন। বেগম জিয়া বলেছেন, নতুন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। রিজভী সাহেব বলেছেন, প্রয়োজনে বিএনপি ভিন্ন পথে হাঁটবে। ষড়যন্ত্র করে বার বার সফল হওয়ার ইতিহাস তাদের রয়েছে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের কিন্তু মানুষ বিশ্বাস করে না বলেও প্রমাণিত হয়েছে। আবারও যদি সে পথে হেঁটেই বিএনপি ঘুরে দাঁড়াতে চায় তাহলে আগামী দিনে দলটির অস্তিত্ব নিয়ে যে টানাটানি পড়বে তাতে সন্দেহ নেই। এই আধুনিক ও সচেতন সময়ে ষড়যন্ত্র করে বেশিদূর এগুনো যাবে না। এটা যে ১৯৭৫ সাল নয়, নয় ২০০১ সালও, সেকথা বিএনপি যত মনে রাখবে ততই দলটির জন্য মঙ্গল।
ঢাকা ॥ ১৮ আগস্ট, সোমবার ॥ ২০১৪ ॥
masuda.bhatti@gmail.com
প্রকাশ : মঙ্গলবার, ১৯ আগষ্ট ২০১৪, ৪ ভাদ্র ১৪২১
__._,_.___