বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাত বর্তমানে প্রায় ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ২ হাজার কোটি ডলারের বাজার। এই খাতে বর্তমানে প্রায় ৪০ লাখ লোক নিয়োজিত আছে। বৈদেশিক রফতানী আয়ের বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, দেশের মোট বৈদেশিক আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশই আসছে তৈরী পোশাক শিল্পখাত থেকে। কিন্তু খোদ প্রধানমন্ত্রী থেকে বাণিজ্যমন্ত্রীও দ্বার্থহীন কণ্ঠে বলছেন বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প নিয়ে বিদেশীদের গভীর ষডযন্ত্রের কথা। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের পোশাক কারখানা পরিদর্শন এবং কথিত কর্মপরিবেশ উন্নয়নের কর্মপরিকল্পনার নামে এদেশের গার্মেন্টস খাত পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিতে গড়ে তোলা হয় 'অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটি' নামে উত্তর আমেরিকার পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি জোট এবং 'দি অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ' নামে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর আরেকটি জোট। নিরাপত্তার অজুহাতে দেশের পোশাক কারখানাগুলোকে একের পর এক তারা বন্ধ করে দিচ্ছে। কিন্তু পাশের দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা বা চীনের মান নিয়ে তারা কোনো প্রশ্ন তুলছে না। অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের পরিদর্শনে এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে বাংলাদেশের শত শত কারখানা। বেকার হয়ে পড়েছে লাখ লাখ শ্রমিক। কারখানা মালিকদের মতে, অ্যাকর্ড বা অ্যালায়েন্স যা করছে, তাতে কমপক্ষে ১০ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে। উল্লেখ্য, সম্প্রতি অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স সংগঠনের নেতারা বাংলাদেশের ১১ হাজার কারখানা পরিদর্শন করে। তারা এসব কারখানার ৮০ হাজারের মতো ত্রুটি চিহ্নিত করে। যা ইউরোপ-আমেরিকার মিডিয়ায় গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয়। এ প্রসঙ্গে গত ১ ডিসেম্বর ২০১৪ ঈসায়ী তারিখে মন্ত্রিসভার বৈঠকে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের কর্মকা-ের বিষয়টি তুলে ধরেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। এ সময় অ্যাকর্ড এবং অ্যালায়েন্সদের গুরুত্ব না দেয়ার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ১ ডিসেম্বর ২০১৪ ঈসায়ী সোমবার সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় তিনি এ নির্দেশনা দিয়ে বলেন, তারা (অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স) আমদানি বন্ধ করে দিলে কিংবা বাংলাদেশের গার্মেন্টস বন্ধ হলে তাদেরই বস্ত্রের অভাব হবে। ভারত ও চীনের তুলনায় বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্যের কম মূল্যের বিষয়টিও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। প্রসঙ্গত, আমরা মনে করি- প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনা দেরিতে হলেও প্রশংসার দাবিদার। বলা চলে, এই প্রথম প্রধানমন্ত্রী আকর্ড ও অ্যালয়েন্সের বিরুদ্ধে বললেন। যা অনেক আগেই বলা উচিত ছিল। এবং তাদের কার্যক্রম শুরুতেই বন্ধ করা উচিত ছিল। বলাবাহুল্য, এ প্রসঙ্গে দৈনিক আল ইহসানের এ নিবন্ধেই কয়েকবার বলা হয়েছিল। দেরিতে হলেও প্রধানমন্ত্রীর বোধোদয়ের জন্য তাকে ধন্যবাদ দেয়া যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের মন্ত্রী, রাজনীতিকদের মধ্যে নিজেদের শক্তিমত্তা সম্পর্কে সচেতনতার বড়ই অভাব। পাশাপাশি বিদেশীদের অক্ষমতা সম্পর্কেও তারা খুবই অজ্ঞ। এ কথা ঠিক যে বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রী বর্তমানে প্রকাশ্যেই বলছেন- আমেরিকা বাংলাদেশকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত জিএসপি দিবে না। জিএসপি নিয়ে আমেরিকা রাজনীতি করছে। ড্যান মজিনা মিথ্যাচার করছে। উল্লেখ্য, বাণিজ্যমন্ত্রীর জিএসপি নিয়ে এতোদিনের দৃঢ় বাস্তবতা হলো, যে পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে আমেরিকাকে বাংলাদেশের জন্য তোয়াজ করার কিছু নেই। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরী পোশাক রপ্তানি করতে বাংলাদেশ ২০১৩ সালে ১৫.৬২% হারে ৮২৮.৪২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার শুল্ক দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। অথচ চীন দেয় ৩.০৮% হারে, ভিয়েতনাম ৮.৩৮% হারে, জাপান ১.৭৫% হারে, ভারত দেয় ২.২৯% হারে। সেক্ষেত্রে পোশাক আমদানি না করলে আমেরিকা নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে অনেক বেশি। অথচ অপরদিকে জিএসপি সুবিধা না দেয়ায় বাংলাদেশ যতটুকু বঞ্চিত হচ্ছে আমেরিকা নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি। রানা প্লাজা ধস ও তাজরীন কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকা-ের জের ধরে ২০১৩ সালের ২৭ জুন বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে দেয়া জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে যুক্তরাষ্ট্র। এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ৪০টি রাজ্যে ব্যবসারত বিভিন্ন কোম্পানির উপর জরিপ চালিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে এই সঙ্কটময় পরিস্থিতি তুলে ধরে গত ১৬ সেপ্টেম্বর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন কোম্পানিগুলোর সংগঠন কোয়ালিশন ফর জিএসপি। জানা গেছে, কোয়ালিশন ফর জিএসপি'র জরিপ প্রকাশের পর মার্কিন নীতি নির্ধারণে ভূমিকা রাখে এমন প্রভাবশালী কংগ্রেসম্যানদের উপর এক ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নেয়ার ব্যাপারে। গত ৮ অক্টোবর (২০১৪) সংস্থাটি এক টুইটার বার্তায় বলেছে, ব্যবসা-বাণিজ্য বাঁচাতে যত দ্রুত সম্ভব জিএসপি স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নেয়ার জন্য অন্তত ৬২০টি আমেরিকান কোম্পানি মার্কিন কংগ্রেসকে অনুরোধ জানিয়েছে। পরদিন ৯ অক্টোবর সংস্থাটি আরেক টুইটে বলেছে, জিএসপি স্থগিতাদেশের কারণে চলতি ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে মার্কিন আমদানিকারকদের ৫৮ মিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত কর প্রদান করতে হয়েছে। কংগ্রেসম্যানরা স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারে বিলম্ব করায় ব্যবসায় ব্যয় বেড়েই যাচ্ছে। ২০১৪ সালের মধ্যে এই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে না নিলে এই ব্যয় বেড়ে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর উপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে প্রতিবেদনে তার উল্লেখযোগ্য অংশ তুলে ধরে বলা হয়েছে, জিএসপি সুবিধা স্থগিতাদেশের কারণে মার্কিন কোম্পানিগুলোকে প্রতিদিন ২ মিলিয়ন ডলার করে অতিরিক্ত কর দিতে হচ্ছে। এর ফলে স্থগিতাদেশের এক বছরে কর বাবদ ৬৭২ মিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয়েছে ব্যবসায়ীদের। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, জিএসপি স্থগিতাদেশের কারণে বেশিরভাগ কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ছোট ছোট কোম্পানিগুলোর। প্রতিভাত হচ্ছে- বাংলাদেশ বা বাংলাদেশী গার্মেন্টস আমেরিকার মুখাপেক্ষী নয়। বরং খোদ আমেরিকাই বাংলাদেশের মুখাপেক্ষী। কিন্তু এ সম্পর্কিত সচেতনতার অভাবেই আমেরিকা মিথ্যা আস্ফালন করে যাচ্ছে। জিএসপি'র মুলা দেখিয়ে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করছে। সঙ্গতকারণেই এসব ষড়যন্ত্র শুরুতেই নস্যাৎ করতে হবে। দেশের সম্পদ ও সম্ভাবনা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান ও গূঢ় উপলব্ধি থাকতে হবে। সবসময়ই সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। মূলত, এসব দায়িত্ববোধ আসে ইসলামী অনুভূতি ও প্রজ্ঞা থেকে। |
__._,_.___