মুক্তমনা অভিজিৎকে কুপিয়ে হত্যা
টিএসসিতে আক্রান্ত, স্ত্রীও গুরুতর আহত, দায় স্বীকার করল আনসারুল্লাহ বাংলা-৭
নিজস্ব প্রতিবেদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি
একুশের বইমেলা থেকে ফেরার পথে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে লেখক ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা
লেখক অভিজিৎ রায়কে। গুরুতর জখম করা হয়েছে অভিজিতের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকেও।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় আক্রান্ত হন তাঁরা।
ধারালো চাপাতি দিয়ে তাঁদের কুপিয়ে রাস্তায় ফেলে চলে যায় দুর্বৃত্তরা। হাসপাতালে নেওয়া হলে
রাত পৌনে ১১টায় চিকিৎসকরা অভিজিৎকে মৃত ঘোষণা করেন। তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যার
অবস্থাও আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, অভিজিৎ (৩৭) ও তাঁর স্ত্রীর মাথায় গুরুতর
জখম দেখা গেছে। বন্যার হাতের আঙুল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। হাসপাতালে পৌঁছার আগেই তাঁদের
প্রবল রক্তক্ষরণ হয়েছে।
সংবাদ পেয়ে হাসপাতালে পৌঁছেন অভিজিতের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক
অজয় রায়। রাত ১১টা পর্যন্ত তিনি উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটছিলেন হাসপাতালের জরুরি বিভাগের
এপাশ-ওপাশ। টেলিফোনে বিভিন্নজনের কাছে আকুতি জানাচ্ছিলেন, 'ওদের দেশের বাইরে
নেওয়ার ব্যবস্থা করা যায় কি না' তা দেখতে। কিন্তু আশপাশে উপস্থিত অনেকেই ততক্ষণ জেনে
গেছেন অভিজিৎ মারা গেছেন। তবে তখনো বাবা ড. অজয় রায় জানেন না যে তাঁর ছেলে আর
বেঁচে নেই। একপর্যায়ে জরুরি বিভাগ থেকে অজয় রায়কে নেওয়া হয় চিকিসকদের কক্ষে। বার
বার অভিজিতের খবর জানার চেষ্টা করছেন তিনি। কিন্তু কে জানাবে তাঁকে ছেলের মৃত্যুর খবর?
সবাই দ্বিধান্বিত, কেউ কেউ তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। এরই মধ্যে অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত
তাঁকে বলেন, 'অভিজিৎ মারা গেছে'। পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন শব্দটি শোনার পর অজয় রায়
কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ। গুমরে কেঁদে উঠে বলেন, 'অভিজিৎ ইজ নো মোর, অভিজিৎ আর আমাদের
মাঝে নেই।' এ সময় পাশে স্বজন, বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী ও পরিবারের লোকজন- সবার চোখ গড়িয়ে
অশ্রু ঝরছে। কে কাকে সান্ত্বনা দেবে। অন্যদিকে বন্যাকে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউতে)
রেখে চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসকরা স্বজনদের জানিয়েছেন, তাঁর অবস্থা শঙ্কটাপন্ন।
২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে বের হওয়ার পথে বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ুন আজাদ
আক্রান্ত হয়েছিলেন। জঙ্গিরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে একইভাবে জখম করেছিল তাঁকে। পরে
তদন্তে হুমায়ুন আজাদ হত্যার ঘটনায় জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়।
অভিজিৎ হত্যায় একই ধরনের গোষ্ঠী জড়িত বলে ধারণা অনেকের। হামলার কায়দাটিও
একই রকম। গভীর রাতে আনসারুল্লাহ বাংলা-৭ নামে একটি উগ্র গোষ্ঠী টুইটারে অভিজিৎ
হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে।
রাতেই ঘটনাস্থলের কাছে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন ব্লগাররা। আজ শুক্রবার টিএসসিতে
ছাত্র-শিক্ষকদের প্রতিবাদী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।
অভিজিতের ঘনিষ্ঠজন ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রাত ৯টা পর্যন্ত বইমেলায়ই অবস্থান করছিলেন
দুজনে। বাসায় ফেরার জন্য আনুমানিক সোয়া ৯টার দিকে যখন টিএসসি মোড়ে পৌঁছেন তখন
হামলার শিকার হন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার (এডিসি) মো. ইব্রাহিম খান কালের কণ্ঠকে
বলেন, ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করা যায়নি। তবে তদন্তে পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছে।
ঘটনার সময় আশপাশে অনেক লোক ছিল। পাশেই পুলিশ সদস্য ছিলেন। ঘটনার পরপরই তারা
আহতদের হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করে। তবে হামলাকারীদের সম্পর্কে তাৎক্ষণিক কোনো
ধারণা পাওয়া যায়নি।
শাহবাগ থানার এসআই সোহেল রানা জানান, সংবাদ পেয়েই পুলিশ ঘটনাস্থলে গেছে এবং
হামলাকারীদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। ঘটনাস্থল থেকে দুটি রক্তমাখা চাপাতি উদ্ধার
করা হয়েছে।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, অভিজিৎ ও তাঁর স্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। দুজনেই লেখালেখিতে সিদ্ধহস্ত।
মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ লেখক হিসেবেও সুনাম কুড়িয়েছেন। এরই মধ্যে তাঁর প্রায় ১০টি
বই প্রকাশ পেয়েছে। এবার বইমেলায় তাঁর দুটি বই প্রকাশ হয়েছে। বইমেলা উপলক্ষেই সস্ত্রীক ঢাকায় এসেছিলেন তিনি।
আহত বন্যা হাসপাতালে সাংবাদিকদের বলেন, 'এক সপ্তাহ আগে আমরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছি।
রাজধানীর ইন্দিরা রোডে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আছি। আজ আমরা বইমেলায় এসেছিলাম। মেলা
থেকে বের হওয়ার সময় টিএসসির বটতলায় পৌঁছালে সন্ত্রাসীরা আমাদের ওপর হামলা চালায়।'
অভিজিতের এক নিকটাত্মীয় বলেন, 'অভিজিৎ বরাবরই উগ্র-মৌলবাদের বিরোধী ছিল। লেখালেখি
নিয়ে আগে থেকেই অভিজিৎকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল জঙ্গিবাদীরা। এই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের
সঙ্গে উগ্র মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী জড়িত থাকতে পারে।' র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মুফতি
মাহমুদ খান বলেন, ঘটনার পরপরই হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করতে র্যাব কাজ করছে। তবে
প্রকৃতপক্ষে কে বা কারা কেন তাঁদের ওপর হামলা চালিয়েছে সে বিষয়টি নিশ্চিত হতে সময় লাগবে।
অভিজিতের ওপর কারা হামলা চালিয়েছে তা রাত ১টা পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি কোনো সূত্রে।
তবে ঘটনাস্থলে দুটি চাপাতি পেয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া ঘটনাস্থলে রক্তের চিহ্ন, মগজের অংশ
পাওয়া যায়।
ঘটনাস্থলের আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হামলার সময় আশপাশে অনেক
শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, পথচারী ও পুলিশ ছিল। তারা চিৎকার শুনে এগিয়ে গেলেও
হামলাকারীদের সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে পারেনি। ঘটনাস্থলের অদূরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের
গেটে পুলিশের একদল সদস্য ছিল। এ ছাড়া হরতাল-অবরোধ কেন্দ্র করে পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ক্যাম্পাস নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে ছিল। এর মধ্যে দুর্বৃত্তরা কিভাবে তাঁদের চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে
পালিয়ে গেল তার সঠিক তথ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা
বলেও জানা যায়নি।
পিনাক রায় নামে একজন প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকদের জানান, ধারালো অস্ত্রধারী দু-তিনজন সন্ত্রাসী
অভিজিৎ? ও তাঁর স্ত্রীকে কুপিয়ে জখম করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর এম আমজাদ আলী বলেন, বহিরাগত সন্ত্রাসীরা তাঁদের কুপিয়েছে
বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ডিএমপির রমনা জোনের এসি শিবলী নোমান ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, 'এটি পূর্ব পরিকল্পিত।
একটি প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী এ ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে। আমরা অভিযান পরিচালনা করছি।'
প্রত্যক্ষদর্শী চটপটি বিক্রেতা আবুল কাশেম জানান, অভিজিৎ ও তাঁর স্ত্রী টিএসসির মিলন চত্বর
দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ পেছন থেকে দুই যুবক তাঁদের ওপর হামলা চালায়। পাশ থেকে
অভিজিতের স্ত্রী স্বামীকে বাঁচানোর চেষ্টা করলে তাঁকেও কোপায় দুর্বৃত্তরা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মারুফ হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ঘটনার
তদন্ত চলছে। তবে হামলাকারীদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি।
দুই ভাইয়ের মধ্যে অভিজিৎ ছিলেন বড়। ছোট ভাই অনুজিত রায় তখনো হাসপাতালে বাবার
পাশে কাঁদছিলেন।
শিক্ষাবিদ অজয় রায়ের ছেলে অভিজিৎ শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের স্নেহধন্য ছিলেন। অভিজিৎ রায়ের
প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে 'অবিশ্বাসের দর্শন', 'আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী', '
মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে', 'ভালবাসা কারে কয়', 'স্বতন্ত্র ভাবনা : মুক্তচিন্তা ও
বুদ্ধির মুক্তি' প্রভৃতি।
লেখক দম্পতির ওপর হামলার কারণ সম্পর্কে পরিবারের সদস্যসহ ঘনিষ্ঠজনদের মত, জঙ্গিবাদী
গোষ্ঠী অথবা মৌলবাদী সংগঠন এ ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে। সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী
লেখালেখির জন্য অভিজিৎকে অনেক দিন ধরেই হুমকি দিয়ে আসছিল বিভিন্ন গোষ্ঠী।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতেই ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার খুন হন মিরপুরে। তিনিও
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।
শেষ বক্তৃতা, শেষ ছবি তোলা : শুদ্ধস্বর পাবলিকেসনসের আহমেদ রশিদ টুটুল নিহত অভিজিতের
ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এবারের মেলায় তাঁর প্রকাশনা থেকে বেরিয়েছে অভিজিতের একটি বই। আগে আরো
পাঁচটি বই প্রকাশ করেছেন টুটুল। তাই মেলায় গতরাতের এক মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে সরাসরি
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে অভিজিৎ বলে গেছেন, 'কেউ যখন আমার লেখা ছাপতে রাজি হতেন না,
তখন সাহস করে টুটুল ভাই ছাপা শুরু করলেন। তার পরই আমার পথচলা।' প্রগতিশীল ও
বিজ্ঞানমনস্ক লেখকদের কিছু বই নিয়ে যৌথ মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান ছিল গতকাল সন্ধ্যায়।
সেখানেই সর্বশেষ বক্তা ছিলেন অভিজিৎ। অনুষ্ঠানশেষে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে অভিজিৎ ছবি তোলেন
প্রকাশক আহমেদ রশিদ টুটুলের পাশে দাঁড়িয়ে। তারপর এগিয়ে যান অবসর প্রকাশনীর স্টলের
দিকে। সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করে মেলা থেকে বেরিয়ে যেতেই আক্রান্ত হন অভিজিৎ।
আহমেদ রশিদ টুটুল গতরাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ''আমাদের সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ।
আমেরিকায় চলে গেলেও দূরে ছিলেন না অভিজিৎ। যোগাযোগ হতো। স্ত্রী বন্যাকে সঙ্গে
নিয়ে যখন বেরিয়ে গেল তখন কত হাসিখুশি মুখ ছিল। কিছুক্ষণ পর স্টল বন্ধ করে যখন
টিএসসি পার হচ্ছিলাম তখনই জানতে পারলাম দুর্ঘটনার খবর। ছুটে গেলাম হাসপাতালে।
কয়েক মিনিট দেখতে পেলাম জীবিত অবস্থায়। এরপরই চিকিৎসক বলে দিলেন 'সরি'।
টিএসসি ও বইমেলা ঘিরে এত নিরাপত্তা, এত মানুষ তার পরও ঘটে গেল এমন ঘটনা।
আমরা কোথায় নিরাপত্তা পাব? হুমায়ুন আজাদের পর অভিজিতের একই ধরনের মৃত্যু
আমাদের আতঙ্কিত করে গেল।''
http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2015/02/27/192757
__._,_.___