ছোটবেলায় অনেক রাজনীতিবিদের সম্পর্কে সমালোচনা শুনতাম যে তাঁরা 'সান ডে পলিটিশিয়ান'। তাঁদের বিরুদ্ধে সমালোচনা এই যে তাঁরা শখের রাজনীতিবিদ। সবার ধারণা ছিল যে তাঁদের অনেকেই সারা সপ্তাহ আইন ব্যবসা করে অর্থ উপার্জন করেন আর সপ্তাহান্তে একঘেয়েমি দূর করার জন্য রাজনীতি করেন। একঘেয়েমি দূর করার সঙ্গে সঙ্গে বেশ একটু নামধামও হয়। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী ও পরে একজন সেনানায়কের মন্ত্রী হয়েছিলেন এমন একজনকেও রবিবারের রাজনীতিবিদ বলা হতো। সাধারণের ধারণা ছিল যে তাঁরা কোনো সংগ্রামে আগ্রহী নন। আমাদের বড় ভাইয়েরা বলতেন যে রাজনীতির গুণগত উন্নতির জন্য দরকার সার্বক্ষণিক রাজনীতিবিদ ও পেশাদার রাজনীতিবিদ। এখন আমরা বহু বছর পেরিয়ে এসেছি। অনেক কিছু বদলে গেছে। মানুষ বদলে গেছে। রাজনীতির চরিত্র বদলে গেছে। দেশ বদলে গেছে। আমরা এখন বয়সের কারণে পরিত্যক্ত। তাই অনেক কথা মনে আসে। ছাত্রজীবনে দেখেছি কিছু ছাত্ররাজনীতিবিদ বছরের পর বছর ছাত্র থেকেছেন রাজনীতি করার জন্য। রাজনীতি করে পয়সা উপার্জন করতে কাউকে দেখেছি বলে মনে হয় না। তারপর এলো সেনাশাসন। লম্বা-চওড়া ফরসা আইয়ুব খান দেশ উদ্ধার করে ছাড়বেন- এমনটা ভাবল কেউ কেউ। দেশ উদ্ধার হলো কি না জানি না, তবে ছাত্ররাজনীতিতে একটা নতুন জিনিসের আমদানি হলো, যার নাম এনএসএফ। এর নেতাদের বয়স বেশি ছিল। তাঁরা পড়াশোনার ধারেকাছে ছিলেন না। তাঁদের কাজ ছিল ছাত্ররা যারা জাতির জন্য আন্দোলন করত তাদের সঙ্গে মারামারি করা। খোকা, পাঁচপাত্তুরা রাজনীতিতে একটা নতুন জিনিস নিয়ে এলো আর তা হচ্ছে টাকার বিনিময়ে সরকারের পক্ষে গুণ্ডামি করা। বাংলাদেশের জন্মের পর দেখা গেল সেনানায়কের অধীনে গাড়ির লাইটে কালো রং লাগানোর জন্য অর্থ উপার্জনের ব্যবস্থা হলো ছাত্রদের। কিছু রাজনীতিবিদ আইয়ুব খানের অর্থে সার্বক্ষণিক পেশাদার রাজনীতিবিদ হয়ে গেলেন। রাজনীতির কিছু উন্নতি হলো কি? দেশ ও জাতির কিছু মঙ্গল হলো কি? আমরা সবাই এসব প্রশ্নের উত্তর জানি।
আমাদের আজকের রাজনীতির অঙ্গনে কী দেখি? ছাত্ররাজনীতির অঙ্গনে বড় জিনিসটি হচ্ছে টেন্ডারবাজি। অন্য আরো জিনিস নিশ্চয়ই আছে, যা আমরা জানি না। তবে দেখা যাচ্ছে যে পেশাদার সার্বক্ষণিক ছাত্ররাজনীতিবিদদের হাতে অবস্থার কিছু উন্নতি হয়নি। এখন দেখা যাক বয়স্ক রাজনীতিবিদদের অবস্থা। তাঁরা অবশ্য বিভিন্ন ধরনের। তবে মনে হয়, তাঁদের মধ্যে অনেকে আছেন পেশাগতভাবে তাঁরা কী করেন সেটা আমরা জানি না। পত্রপত্রিকায় দেখেছি যে তাঁদের আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো। তাঁদের পেশাদার সার্বক্ষণিক রাজনীতিবিদ বলে বর্ণনা করলে ভুল হবে না।
আরেক শ্রেণির রাজনীতিবিদ আছেন, যঁাঁদের দৃশ্যত একটা পেশা রয়েছে। কিন্তু তাঁদের তো সব সময় রাজনীতি সম্পর্কিত কাজেই ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। তাঁরা হয় বক্তৃতা দিচ্ছেন, না হয় গভীর রাতে টিভির টক শোতে অংশ নিচ্ছেন। না হয় নেত্রীদের কাছাকাছি থাকছেন। এককথায় নিজ পেশার কাজ ছাড়া আর সব করছেন। তাঁদের কেউ কেউ বেশ সিনিয়র। তাঁরা হয়তো অপেক্ষাকৃত জুনিয়রদের কাজে লাগিয়ে নিজেরা রাজনীতির কাজ করছেন। কিন্তু সবার তো এমন অবস্থা নয়।
অনেক রাজনীতিবিদ আছেন যাঁরা চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। শুনেছি, তাঁদের আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো। আমাদের দেশের চাকরিতে বেতনের পরিমাণ এমন ভালো নয় যে সে টাকা দিয়ে এত ভালো থাকা যায়। পেনশনের টাকা তো আরো কম। মনে প্রশ্ন জাগে, তাঁদের অর্থের উৎস কী?
এসব দেখেশুনে মনে হচ্ছে যে আমাদের রাজনীতিবিদদের অনেকেই আছেন যাঁদের অর্থের উৎস রাজনীতি। দল ক্ষমতায় থাকলে অর্থের আমদানিটা সহজ হয়। কাজেই যেনতেন প্রকারে নিজের দলকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করাটা লাভজনক। এমনই পরিবেশে রাজনীতির আদর্শিক দিকটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।
আমাদের রাজনীতির অঙ্গনে কী চলছে? রাজনীতির অঙ্গনে আদৌ রাজনীতি চলছে, না অন্য কিছু চলছে সেটা ভেবে দেখার মতো। অবরোধ চলছে। হরতাল চলছে। এসব চালাতে আদেশ দিয়েছে নির্বাচনে অংশ না নেওয়া ২০ দলীয় জোট। গুপ্তস্থান থেকে বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে। অবরোধ আর হরতালের আভিধানিক অর্থ কী? এসব শব্দের প্রচলিত অর্থ কী? অবরোধ আর হরতাল বলতে আমরা যা বুঝি রাজনীতির অঙ্গনে তা চলছে কি? রাস্তায় আমরা কী দেখছি? অবরোধ বলতে আমরা বুঝি অন্যদের ঘেরাও করে রাখা। সেটা হতে দেখিনি। এই কার্যসূচিতে জনগণের অংশগ্রহণ দেখা গেল না। অবরোধ করার জন্য মানুষ লাগে। এই অবরোধ কার্যকর করার জন্য উৎসাহী মানুষকে দেখা গেল না। যেটা দেখা গেল সেটা হচ্ছে অগ্নিকাণ্ড। এই অগ্নিকাণ্ডের প্রধান শিকার হচ্ছে বাসগুলো। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দেখতে গেলে বলতে হয় একটা বিরাট আর্থিক ক্ষতির সৃষ্টি করা হলো। মানুষ নিষ্ঠুরভাবে পুড়ে মরল। কী মর্মান্তিক সে মৃত্যু। বহুজন আহত হলো। প্রশ্নটা হচ্ছে এরা কারা? এটা বিশ্লেষণ করে দেখা উচিত। আমরা সঠিক জানি না, তবে মনে হয় খেটেখাওয়া মানুষরাই এই অমানুষিক অগ্নিকাণ্ডের শিকার। এরা কি আওয়ামী লীগের? কত দিন মানুষ কাজে না গিয়ে বাড়িতে থাকতে পারে মৃত্যুর ভয়ে? বিএনপি সমর্থকরা কি কাজে যায় না? যদি যায়, তবে যে বাসে তারা যায় সেগুলোতে কোনো চিহ্ন আছে কি? যারা বাসে আগুন লাগায় তারা কি কোনো চিহ্ন দেখে আগুন লাগায় বাসে? অন্যান্য ক্ষতি তো আছেই। শিক্ষার ক্ষতি। দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি। অফিস-আদালতের ক্ষতি। এসব ক্ষতির মাসুল জাতিকে দিতে হবে। আমরা ধন্য দেশ নই। গরিব জনগণ চরম আর্থিক বিপর্যয়ের শিকার হবে।
কারা এসব অগ্নিকাণ্ড ঘটাচ্ছে। এটা বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন জরুরি হয়ে পড়েছে। ১৯৭১ সালে যারা স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল আজ তাদের ভূমিকার কথা ভেবে দেখতে হবে। তাদের তথাকথিত রাজনৈতিক কার্যপদ্ধতির কথা ভেবে দেখতে হবে। এটা স্পষ্ট যে তারা ক্ষমতা দখলের অভিপ্রায়ে জনগণের ভোগান্তিকে গ্রাহ্য করছে না। জনগণের নিরাপত্তার দায়িত্ব যাদের হাতে তাদের কিছু করতে হবে। তবে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে করলে সব দিক থেকে ভালো হয়।
লেখক : রয়্যাল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্টের একজন ফেলো
__._,_.___