ভুল গন্তব্য ভুল পথ
গত আড়াই মাস ধরে ২০ দলীয় জোট মানুষ পুড়িয়ে মারছে। যানবাহনসহ যেখানে সেখানে আগুন লাগিয়ে বেড়াচ্ছে। ভাঙচুর করছে। এক কথায় সন্ত্রাসী নাশকতায় মত্ত রয়েছে। এ সব করে তারা আশা করছে তারা মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে সরকারকে বাধ্য করবে। নির্বাচনের আগে তারা এক বছর ধরে হত্যা আর ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে। কিন্তু নির্বাচিত সরকারের অধীনেই নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করেছে। নির্বাচনের পরে শতকরা কতজন ভোট দিয়েছে তা নিয়ে নানা রকমের পরিসংখ্যান শুনেছি। বিভিন্ন রকমের পরিসংখ্যানের কারণ হচ্ছে বিভিন্ন রকমের উৎস। এ সব শুনে স্ট্যাটিসটিকস সম্বন্ধে একতা চুটকি মনে পড়ে গেল। 'প্রশ্ন-স্ট্যাটিসটিশিয়ান কারা? উত্তর- যারা আপনার মাথা আগুনে এবং পা বরফে দেখে বলেন, গড়ে আপনি আরামে আছেন'।
তা পরিসংখ্যান যাই বলুক নির্বাচনের পরে দেশে সবকিছু সুন্দরভাবে চলতে লাগল। শুধু স্বজনহারা মানুষগুলোর শোকের আগুন জ্বলতে লাগল তুষের আগুনের মতো। নাশকতা থেমে গেছে বলে মানুষ হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। প্রমাণিত হলো ২০ দলের আন্দোলন সফল হয়নি। এই ব্যর্থতার বিশ্লেষণ প্রয়োজন ছিল সবার জন্য। অত্যাবশ্যক ছিল ২০ দলের জন্য। তাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ণয়ের জন্য এই বিশ্লেষণ বিশেষভাবে কাজে লাগত। একটা কথা তাদের মেনে নিতেই হতো আর সেটা হচ্ছে আন্দোলন সফল হয়নি। তা দোষ যারই হোক। এই ব্যর্থতায় তাদের নিজেদের দুর্বলতা কোথায় ছিল সেটা নির্ণয় করাও তাদের ভবিষ্যতের জন্য ভালো হতো।
আমাদের মনে হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথার সময় ও প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। উদ্দিনদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কীর্তিকলাপ মানুষ পছন্দ করেনি। এমনকি ২০ দলও ওই সরকারের নিন্দা করেছে। তবে তারা বলেছে যে শুধু ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারটি খারাপ ছিল। অন্যগুলো ভালো ছিল। সবাই জানে যে তিন উদ্দিন ছিল তাদের নিজের লোক। তবু ওই সরকার খারাপ ছিল। তাদের কথা মেনে নিলেও এ কথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা একটা প্রথা হিসেবে ভালো নয়। কারণ এর মধ্যে সুপ্তভাবে রয়ে গেছে ভয়াবহ বিপদ। এই অনির্বাচিত সরকার প্রথায় সরকারের কোনো জবাবদিহিতা নেই। ক্ষমতা তারা কতদিন ধরে রখবে তার কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা নেই। পৃথিবীর কোনো প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা চালু নেই। এই সরকার প্রথার জন্য আন্দোলন করা ভুল গন্তব্যের জন্য যাত্রা করা।
আমাদের দেশ এখন গণতান্ত্রিক দেশ। আমাদের জীবনযাত্রা প্রণালী গণতন্ত্রসম্মত হবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা। সরকার পরিবর্তন শান্তিপূর্ণভাবে হবে এটাই আমরা আশা করি। গণতান্ত্রিক আন্দোলন হবে শান্তিপূর্ণভাবে। সভায়, মিছিলে ধ্বনিত হবে জনগণের দাবি-দাওয়া। হত্যা, ধ্বংস, অগ্নিকাণ্ড প্রত্যাশিত নয় গণতন্ত্রে। ২০১৩-১৪ সালের আন্দোলনে ৫০০'র ওপর মানুষ নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে অসংখ্য। সম্পত্তি বিনষ্ট হয়েছে কত তার হিসাব নেই। বাস পোড়ানো হয়েছে। রেললাইন ওপর ফেলা হয়েছে। হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। পড়াশুনার ক্ষতি, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি আরো অনেক ক্ষতি হয়েছে দেশের। আন্দোলনের এই পথ সমর্থন করেনি জনসাধারণ। তাই তারা আন্দোলনে অংশ নেয়নি। জনগণ অংশ না নেয়ায় প্রমাণিত হয়েছে যে আন্দোলনের এই সহিংস পথ ভুল ছিল। আগেরবারের আন্দোলনের ব্যর্থতার কি বিশ্লেষণ করেছে ২০ দল জানি না। তবে দেখা গেল যে এবারো তারা একই গন্তব্যের জন্য একই পথে যাত্রা শুরু করল। ফল কি হলো? ১০০'র ওপর মানুষ পুড়ে মরল। এর মধ্যে ছিল অসহায় নারী ও শিশু। আবার সেই সম্পত্তি বিনষ্ট। আবার শিক্ষার ক্ষতি। আবার দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি। আরো অনেক রকমের ক্ষতি। দলনেত্রী টানা অবরোধের আদেশ দিলেন। কিন্তু কোথায় অবরোধ? সন্দেহ হওয়ায় আবার অভিধান দেখে নিলাম। অবরোধ বলতে যা বুঝায় তা কোথাও দেখলাম না। অবরোধ বলতে আমরা বুঝি খারাপ কিছুকে অনেক মানুষের দ্বারা ঘিরে রাখা। প্রথম কথা হচ্ছে খারাপ কথাটার সংজ্ঞা নিরূপণ করা আর তারপর সেই স্থান বা ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা। সে সব কি করা হয়েছিল? ঘেরাও করতে গেলে অনেক মানুষের প্রয়োজন। আর সে সব মানুষকে হতে হবে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। হতে হবে নিজের কর্তব্যের প্রতি নিষ্ঠাবান। অবরোধ করার মানুষ কোথায়? দৃঢ় প্রতিজ্ঞ আর নিষ্ঠাবান মানুষের কথা না হয় নাই বললাম। কিছু কিছু সংবাদ মাধ্যমে বলা হচ্ছে 'টানা অবরোধ চলছে'। টানা অবরোধ? অবরোধই তো দেখছি না। টানা অবরোধ আসছে কোথা থেকে? যা দেখছি তা হচ্ছে ঢিল মেরে পালিয়ে যাওয়া। দেখছি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। দেখছি কাপুরুষতা। সংবাদ মাধ্যমে দেখছি টাকা দিয়ে এইসব ঢিল নিক্ষেপকারীদের ব্যবহার করে নেয়া হচ্ছে। সত্যি হলে চরম লজ্জার কথা। রাজনীতির নামে এ সব কি হচ্ছে?
মাঝে মাঝে 'হরতাল' দেয়া হচ্ছে। হরতাল ঘোষণা করা হচ্ছে গুপ্তস্থান থেকে আত্মগোপনকারী কারো দ্বারা। দলনেত্রী হরতালের ঘোষণা দেন না কেন? বলা হবে হয়তো যে তার কথা সরকার প্রকাশ করতে দেবে না। তার সংবাদ সম্মেলনের কথা তো প্রচারিত হয়েছিল। গুপ্তস্থান থেকে গুপ্ত মানুষের ঘোষণা আজ না হয় বেগম জিয়ার পক্ষে দেয়া হচ্ছে। আন্দোলন সফল হলে বোধহয় এই গুপ্ত ব্যক্তি নিজেকেই 'ঘোষক' বলে ঘোষণা করতেন। হরতাল দাবি আদায়ের শেষ উপায়। জনগণের পূর্ণ সমর্থন নিয়ে একটি জনবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে হরতাল দেয়া হয়। হরতাল আহ্বানের অবস্থা বিরাজ করছিল কি? আমরা কি দেখছি? একের পর এক হরতাল ডাকা হচ্ছে আর জনগণ তা উপেক্ষা করছে।
সাধারণ মানুষ দিনে এনে দিনে খায়। কাজে না যেতে পারলে তাকে আর তার পরিবারের সবাইকে না খেয়ে থাকতে হয়। তারা তো কয়েকবারের প্রধানমন্ত্রী নয় যে কিছু না করে রাজার হালে থাকতে পারবে আর সন্তানরা বিদেশে যুবরাজের মতো থাকতে পারবে। কতদিন চলবে রাজনীতির নামে অরাজকতা? কতদিন চলবে রাজনীতির নামে প্রজাদের দুর্ভোগ? ২০ দলকে এখন বুঝতে হবে যে তারা ভুল গন্তব্যের লক্ষ্যে ভুল পথে চলছে। তাদের এই সব ভুলের জন্য খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। মানুষ শুধু মার খেয়ে যাবে এটা আশা করা ভুল। মানুষ শুধু মরবে সেটা হতে পারে না।
ওয়াহিদ নবী : চিকিৎসক, কলাম লেখক; রয়াল কলেজ অফ সাইকিয়াট্রিস্টের একজন ফেলো।
http://www.bhorerkagoj.net/print-edition/2015/03/20/24292.php
__._,_.___