মোদীময় বাংলাদেশ
মোদী আসছেন। চারিদিকে সাজ সাজ রব। বাংলাদেশে এমুহুর্তে সবাই মোদী ভক্ত হয়ে গেছেন।
একদা পুরো বাংলাদেশ এন্টি মোদী ছিলো, সময়ের ব্যবধানে এখন পুরো বাংলাদেশ মোদীময়।
অনেকে তার সাক্ষাত প্রার্থী। মোদীকে অভ্যর্থনা জানাতে প্রতিযোগিতাও লক্ষ্যনীয়। সুষমা স্বরাজ এলেও আমরা তাই দেখেছিলাম। সুষমার মত মোদিও কাউকে অখুশি করতে রজি নন, অনেকের সাথে দেখা হবে, এমনকি
গোলাপীর সাথেও দেখা হতে পারে, আবার নাও পারে।
অনেকগুলো চুক্তি হবে, সহযোগিতার নয়াদিগন্ত উন্মোচিত হবে, দু'দেশে বাস-ট্রেন চলবে, ট্রানজিট হবে। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। সবই ভালো। সীমান্ত চুক্তিতে বাংলাদেশ লাভবান হবে। বঙ্গবন্ধু আমলে ভারতীয় সৈন্য ফেরত পাঠানোর পর এতবড় সাফল্য ৪৩ বছর পর এই প্রথম। এজন্যে জননেত্রী শেখ হাসিনা গনসম্ভর্ধনা পেয়েছেন এবং তিনি 'দেশরত্ন' উপাধিতে ভুষিত হয়েছেন। তবে নিউইয়র্কে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের তেমন খুশি বলে মনে হলোনা! মমতা তো তিস্তার ৮০% পানি চেয়ে বসে আছেন। মোদী
অনেক কিছু
দিয়ে দিচ্ছেন, এর কারনটা কি? মোদী সম্ভবত: শুধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়ে খুশি নন, তিনি গোটা ওই অঞ্চলের গ্রহনযোগ্য নেতা হতে চান। একই সাথে তিনি ভারতকে ঐ অঞ্চলের একচ্ছত্র শক্তি হিসাবে প্রতিষ্টিত করতে চান। আমেরিকা ভারতকে মেনে নিয়েছে, প্রতিবেশীরা তো মানতে হবে! মোদী তাই শুধু বাংলাদেশ নয়, আশেপাশের প্রতিবেশীদের সাথেও সখ্যতা বজায় রাখতে চাচ্ছেন। এমনকি তিনি চীনও গেছেন। তাছাড়া আরো কিছুটা সময় পরে মোদী হয়তো পাকিস্তানের সাথেও একটা বোঝাপড়ায় যেতে চাইবেন; তাই আগে অন্যদের সাথে রাখতে চাইছেন। তাছাড়া মুজিব-ইন্দিরা বা আওয়ামী লীগ-কংগ্রেস সখ্যতার আদলে তিনি হাসিনা-মোদী বা আওয়ামী লীগ-বিজেপি সখ্যতার নজির স্থাপন করতে চাচ্ছেন। শুনেছি মোদী 'লিপ সার্ভিস'-এ বিশ্বাস করেন না; তিনি 'গিভ এন্ড টেক' নীতিতে বিশ্বাসী। হয়তো তিনি বলতে চাইবেন, আমরা তোমাদের 'সবকিছু' দিচ্ছি, তোমরা আমাদের 'সখ্যতা' দাও। অবশ্য এই 'সবকিছু'-র কেউ ভিন্ন ব্যাখ্যাও দিতে পারেন!মোটামুটি বেশকিছু চুক্তি-টুক্তি হলেও তিস্তা হবেনা বলেই অনেকের অভিমত।
তারপরেও
একটি মহল বলছেন, চমক আসতে পারে। তিস্তা না হবার পেছনে
বোঝা যাচ্ছে, মমতা দিদি এখনো ঝামেলা পাকাচ্ছেন! তাই তিনি একদিন আগে এসে আগেই ফিরে যাচ্ছেন। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি-তৃনমূল সম্পর্কটা মোটেই ভালো যাচ্ছেনা। সারদা কেলেঙ্কারী ও বর্ধমান বোমা ঘটনায় মোদী-মমতা সম্পর্কের ব্যারোমিটার ঘনঘন ওঠা-নামা করছে। শেষ পর্যন্ত কয়টি চুক্তি হয়
তা দেখার বিষয়। কথায় বলে 'ব্রাহ্মণের বাড়ীতে নিমন্ত্রণ খাওয়া হাত না ধোয়া পর্যন্ত বিশ্বাস নেই'; তাই একজন বললেন, ৮ই জুনের আগে চূড়ান্তভাবে কিছুই বলা যাবেনা। আমাদের হয়তো আরো ক'টা দিন আশা-নিরাশার দোলাচলে থাকতে হবে। তবে গ্রামের মাতব্বর বাড়ীর সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রেখে যতটা সম্ভব সুবিধা নেয়াই ছোট্ট বাড়িটির কাজ। বঙ্গবন্ধু দেশের সন্মান বজায় রেখে তাই করেছেন; কন্যা শেখ হাসিনাও তাই করছেন এবং দেশের জন্যে জলেস্থলে সুবিধা আদায় করে আনছেন। সমদ্র বিজয় এবং সীমান্ত জয় শেখ হাসিনার দু'টি বিরাট সাফল্য। পক্ষান্তরে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত আমরা দেখেছি উলফা, অনুপ চেটিয়া, পরেশ বড়ুয়া বা সেভেন সিস্টারের বিদ্রোহীদের মদত দেয়া, রোহিঙ্গা ও সন্ত্রাসীদের লালন-পালন করা, অস্ত্রচালান বা দশট্রাক অস্ত্রের মহড়া, সবই আমরা দেখেছি। জিয়া-এরশাদ-খালেদার ভারত বিরোধী সাম্প্রদায়িক রাজনীতিও আমরা দেখেছি। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, ওরা এখন বলছে, বিএনপি নাকি কখনো ভারত বিরোধী রাজনীতি করেনি, এখনো করেনা, ভবিষ্যতেও করবেনা! এটা কি 'নাকে খত' দেয়া? একেই বলে 'ঠ্যালার নাম বাবাজী'। বিএনপি'র রাজনীতির ভিত্তি হচ্ছে, ভারত বিরোধিতা এবং সাম্প্রদায়িকতা। 'বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ' হচ্ছে, হুমায়ুন আজাদের ভাষায় 'জাতীয়তাবাদের মোড়কে সাম্প্রদায়িকতা'। সুতরাং সাম্প্রদায়িকতা, উগ্র ভারত বিরোধিতা ও সন্ত্রাস লালন না করলে বিএনপি টিকবে কি? একদা বিএনপি সেভেন সিস্টারের বিদ্রোহী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে, বাংলাভাই, হরকাতুল জ্বিহাদ ও অন্যান্য সন্ত্রাসীদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদত দিয়েছে; সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করেছে; পার্বত্য শান্তি চুক্তি হলে নোয়াখালী পর্যন্ত ভারত হয়ে যাবে বলেছে; আওয়ামী লীগ জিতলে মসজিদে উলুধ্বনি হবে বলেছে এবং এখন বলছে 'আমরা ভারত বিরোধী নই'। সত্যি সেলুকাস, কি বিচিত্র এই বিএনপি!
মাত্র ক'দিন আগে ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মূখার্জী ঢাকা সফরে এলে খালেদা জিয়া তার সাথে সৌজন্য সাক্ষাত পর্যন্ত করেননি। এখন অবশ্য গলায় 'কাদের সিদ্দিকীর গামছা' দিয়ে বলছেন, 'মাফ করে দেন, এ ভুল আর হবেনা'। খালেদা জিয়া তখন কেন দেখা করেন নি? এর কারণ সম্ভবত: তিনি তার সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ভিতটি শক্ত বা নাড়া দিতে চেয়েছিলেন। গল্পে আছে, এক বৃদ্ধের তরুণী ভার্যা তার স্বামীর পুনর্যৌবন প্রাথনা করলে ঈশ্বর তা মঞ্জুর করে বলেন, অমুক দিন অমুক সময় গঙ্গায় গিয়ে এক ডুব দিলে তার স্বামী যৌবন ফিরে পাবে। নির্দিস্ট দিনক্ষণে দু'জনে গঙ্গায় গিয়ে ডুব দেয়ার সাথে সাথে বৃদ্ধ স্বামী যুবক হয়ে যান। যুবক তখন ভাবে, এক ডুবে এমন হলে দুই ডুব দিলে নিশ্চয় তার যৌবন আরো শ্রীবৃদ্ধি হবে! যেই ভাবা সেই কাজ, তিনি আবারো ডুব দিলেন! তরুণী বধু একটি শিশু কোলে ফেরার পথে মানুষে জিজ্ঞাসা করে, শিশুটি কে? বধুয়ার উত্তর, 'আমার স্বামী'। 'অতি লোভে তাতি নস্ট', ম্যাডামেরও হয়েছে তাই, ক্ষমতা থেকে তিনি অনেক দুরে ছিটকে পড়েছেন এবং হয়তো আরো অনেকদিন দুরেই থাকতে হবে।
যাকগে, অনেক তদ্বির করে ম্যাডাম মোদির সৌজন্য সাক্ষাত
প্রায় পেয়ে গিয়েছিলেন। এখন আবার তা অনিশ্চিত হয়ে গেছে। হয়তো
'অধিক ঘি' ঢালতে হবে! দেখা হলে
আপাতত: মান বাঁচবে! নইলে আরো কাফফারা দিতে হবে।
ধারণা করা যাচ্ছিলো
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের স্বার্থে মোদীও চায় বিএনপি টিকে থাকুক, তাই হয়তো দেখা দেবেন।
দেখা না দিলে বিএনপি'র সমস্যা হতে পারে। বলা যায়না, শেষ পর্যন্ত দেখা হতেও পারে! আগামী দিনগুলোতে বিএনপি
ভারত বিরোধী দল নয়, বরং ভারতের বন্ধু হিসাবে আওয়ামী লীগের
প্রতিদ্বন্দী রূপে
আবির্ভুত হবে
। আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাপা ভারতের বন্ধু হয়ে গেলে বাংলাদেশে ভবিষ্যতে ভারত বিরোধী রাজনৈতিক মাঠ ফাঁকা হয়ে যাবে! জাপার এরশাদ অনেক আগে থেকেই 'মিউ মিউ' করছেন। আর জামাত? ওরা সবই পারে, ওদের কাঁছে ইহুদী-নাছারার ডলার ও হিন্দুস্থানী রুপীর কদর অনেক। স্মর্তব্য যে, পাকিস্তান স্বাধীন হবার পর জামাতের মওদুদী বলেছিলেন, ভারতের মুসলমানদের দাযিত্ব তাদের নয়! লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, জামাতের সাথে পশ্চিমাদের সম্পর্ক আওয়ামী লীগ-বিএনপি থেকে নিবিড়। ভবিষ্যতে দিল্লীর সাথেও সম্পর্ক নিবিড় হলে অবাক হবার কিছু থাকবে না! ওরা সবই পারে। তবে ভারত শেখ হাসিনার প্রতি যতটা বিশ্বাস রাখতে পারে, খালেদা বা জামাতীদের ওপর তা রাখতে পারে বলে মনে হয়না, হয়তো তাদের আরো পরীক্ষা দিতে হবে! মোদীর এ সফরে সকল পক্ষের উত্সাহ-উদ্দীপনা দেখে মনে হচ্ছে, এবার বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক কাটা তারের বাইরে বেরিয়ে আসবে। তবে আমাদের নীলুভাই, মানে শেখ শওকত হোসেন নীলু সবাইকে টেক্কা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'হাসিনা সর্বশ্রেস্ট রাষ্ট্রনায়ক', মোদী 'শান্তির দূত'। এরপর আর কথা থাকেনা! পত্রিকায় দেখলাম, মোদী ঢাকেশ্বরী মন্দিরে যাবেন। সুষমাও গিয়েছিলেন। বাইরের দেশের অনেকেই অতীতে ওখানে গিয়েছেন, হয়তো ভবিষ্যতেও যাবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মোদী আসার আগেই ঢাকেশ্বরী-কে জাতীয় মন্দির ঘোষণা করতে পারেন। বিশেষত: সবাই এটাকে জাতীয় মন্দির হিসাবেই জানে, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও বক্তৃতায় 'জাতীয় মন্দির'-ই বলেন, এখন শুধু আনুষ্টানিকতা বাকি। এতে বাংলাদেশের লাভ ছাড়া ক্ষতি কিছু নেই।
শিতাংশু গুহ, কলাম লেখক।
৩রা জুন
২০১৫, নিউইয়র্ক।
__._,_.___