প্রতারণা করে শেষ রক্ষার চেষ্টা সাকার
মুক্তিযুদ্ধকালের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের প্রক্রিয়াকে বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য শুরু থেকে নানা অপচেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী। গতকাল বুধবার বিচারিক প্রক্রিয়ার শেষ দিনেও সর্বোচ্চ আদালতের সঙ্গে প্রতারণার চেষ্টা করেন তিনি।
ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে সাকা চৌধুরী যে আবেদন করেছিলেন, তার সঙ্গে পাকিস্তানের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি 'সনদ' ও 'প্রশংসাপত্র' জমা দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালে সাকা চৌধুরী যে পাকিস্তানের লাহোরে ছিলেন, তা প্রমাণ করতেই ওই নথি দেওয়া হয়েছিল। তবে পুনর্বিবেচনার আবেদন শুনানির সময়ই প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের বেঞ্চ ওই 'সনদ ও প্রশংসাপত্রের' বিষয়ে গুরুতর সন্দেহ পোষণ করেন।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার সত্যায়িত করা পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের 'সনদ'-এর প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, 'সার্টিফিকেটে ১৯ সংখ্যাটি বড় আর ৭১ সংখ্যাটি ছোট। ট্রাইব্যুনালে এর আগে দেওয়া ডকুমেন্টের সঙ্গে এগুলোর কোনো মিল নেই। একটা মিথ্যা ধামাচাপা দিতে শতটা মিথ্যা কথা বলছেন তিনি।' প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, 'যখন এই বিচার শুরু হলো, তখন পাকিস্তান এই বিচারের বিরোধিতা করেছে। তারা এই বিচারের বিরুদ্ধে রেজল্যুশন (প্রস্তাব) পাস করেছে। সেখান থেকে যেসব নথি আসছে, প্রতিটিতে আমাদের সিরিয়াস ডাউট (গুরুতর সন্দেহ) আছে।'
একপর্যায়ে খন্দকার মাহবুবের কাছে প্রধান বিচারপতি চারটি প্রশ্ন তোলেন। প্রথমত, ট্রাইব্যুনাল ও আপিল বিভাগে নথিগুলো জাল প্রমাণিত হওয়ার পরও নতুন করে কেন নথি দেওয়া হয়েছে? দ্বিতীয়ত, লন্ডন-ওয়াশিংটন থেকে হলফনামা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু পাঞ্জাব থেকে দেওয়া হয়নি কেন? তৃতীয়ত, কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্রেডিট ট্রান্সফার করে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন? চতুর্থত, ২০১২ সালের নথি এখন কেন দিচ্ছেন?
জবাবে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, 'আপনাদের ডাউট হলে আমাদের বেনিফিট হবে। আপনারা তদন্ত করেন। রায় দিতে গেলে সন্দেহের ঊর্ধ্বে উঠে রায় দিতে হবে।'
সাকা চৌধুরীর পক্ষ থেকে যে 'সনদ ও প্রশংসাপত্র' দেওয়া হয়েছে, তাতে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ধরনের লোগো ব্যবহার করা হয়েছে। ওই ডুপ্লিকেট সার্টিফিকেটে সেশন লেখা ১৯৭১, তবে প্রশংসাপত্রে সেশন ১৯৭০-৭১। সনদে ১৯৭১ লেখার মধ্যে ১৯ সংখ্যাটি অনেক বড়, ৭১ সংখ্যাটি খুব ছোট। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামেও পার্থক্য রয়েছে। সনদে লেখা 'দ্য ইউনিভার্সিটি অব দ্য পাঞ্জাব', প্রশংসাপত্রে লেখা 'ইউনিভার্সিটি অব দ্য পাঞ্জাব'। আবার সনদ ও প্রশংসাপত্রে পাঞ্জাব বানান দুই ধরনের। এমনকি খোদ সাকা চৌধুরীর নামের বানান দুটিতে দুই ধরনের। সনদে নামের বানানে 'এইচ' থাকলেও প্রশংসাপত্রে 'এইচ' নেই।
পরে এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, 'পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ডুপ্লিকেট সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে, এটা আদালত গোচরে আনেননি। আমরাও বলেছি, এই কথিত সার্টিফিকেট গ্রহণ করা যাবে না। কারণ, এটা ২০১২ সালে ইস্যু করা।...কোনো বিদেশি কাগজ সেই দেশের নোটারি পাবলিকের সামনে সত্যায়িত করতে হয়। সেটা সাইন করেন সেখানে আমাদের দেশের রাষ্ট্রদূত বা অন্য কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি। পাকিস্তানে আমাদের হাইকমিশনার ওই নথিতে সই করেননি। সুতরাং এটাকে কাউন্টার সাইন করার প্রশ্ন আসে না। আইনি প্রক্রিয়ায় এটা গ্রহণযোগ্য নয়।'
অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাকা চৌধুরীর ভর্তি দেখানো হয়েছে ১৯৬৮ সনে, তাঁরা (আসামিপক্ষ) বলেছেন তিনি ক্রেডিট ট্রান্সফার করেছেন। ওই সময় আমি নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগে (রাষ্ট্রবিজ্ঞান) পড়তাম। ওই সময় আমাদের কোনো সেমিস্টার সিস্টেম ছিল না। তাই ক্রেডিট ট্রান্সফারের কোনো নিয়ম ছিল না। সেমিস্টার সিস্টেম চালুর পর আমাদের দেশে ক্রেডিট ট্রান্সফারের বিষয়টি চালু হয়।'
এর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা চালান সাকা চৌধুরী। ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর তাঁর ফাঁসির রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল-১। ওই রায় ঘোষণার আগে রায়ের খসড়া ফাঁস হয়ে যায়। রায় ঘোষণার সময় ট্রাইব্যুনালে সাকা চৌধুরী বলেন, ওই রায় তো এক দিন আগে পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় একটি মামলা এখনো বিচারাধীন, যার আসামি সাকা চৌধুরীর স্ত্রী, ছেলে ও আইনজীবী। আর বিচারের প্রক্রিয়াকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য বিচারক, রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি, এমনকি নিজের আইনজীবীর প্রসঙ্গে অশালীন বক্তব্য বা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করতে ছাড়েননি তিনি।
সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের ফাঁসি
রিভিউ আবেদন খারিজ, রায় বহাল
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার: ৫ বছরে বিচার শেষ
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী
২০১০, ১৬ ডিসেম্বর
সাকা চৌধুরী গ্রেপ্তার
২০১১, ১৪ নভেম্বর
অভিযোগ দাখিল
২০১২, ৪ এপ্রিল
২৩ অভিযোগ গঠন
২০১৩, ১ অক্টোবর
ট্রাইব্যুনালে ফাঁসির রায়
২০১৫, ২৯ জুলাই
ফাঁসির রায় আপিলে বহাল
২০১৫, ১৮ নভেম্বর
পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ
কোন অভিযোগে কী সাজা
১. মধ্য গহিরা গণহত্যা ২০ বছর
২. নূতনচন্দ্র সিংহ হত্যা ফাঁসি
৩. জগৎমল্লপাড়া গণহত্যা ২০ বছর
৪. সুলতানপুর বণিকপাড়ায় গণহত্যা ফাঁসি
৫. ঊনসত্তরপাড়ায় গণহত্যা ফাঁসি
৬. মোজাফফর ও আলমগীরকে হত্যা ফাঁসি
৭. নিজামউদ্দিনকে নির্যাতন ৫ বছর
৮. সালেহউদ্দিনকে নির্যাতন ৫ বছর
আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ
২০১০, ২৯ জুন
মুজাহিদ গ্রেপ্তার
২০১২, ১৬ জানুয়ারি
অভিযোগ দাখিল
২০১২, ২১ জুন
৭ অভিযোগ গঠন
২০১৩, ১৭ জুলাই
ট্রাইব্যুনালের ফাঁসির রায়
২০১৫, ১৬ জুন
ফাঁসির রায় আপিলে বহাল
২০১৫, ১৮ নভেম্বর
পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ
কোন অভিযোগে কী সাজা
১. ফরিদপুরের রণজিৎ নাথকে নির্যাতন ৫ বছর
২. বদি, রুমীদের হত্যায় প্ররোচনা যাবজ্জীবন
৩. বুদ্ধিজীবী নিধনের ষড়যন্ত্র ও সহযোগিতা ফাঁসি
৪. ফরিদপুরের বাকচর গ্রামে হত্যা ও নিপীড়ন যাবজ্জীবন
বাকি শুধু প্রাণভিক্ষা
প্রাণ বাঁচানোর শেষ চেষ্টা হিসেবে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সুযোগ পাবেন
__._,_.___