বাংলাদেশের গণহত্যা ও হেনরি কিসিঞ্জারের বিচার
মফিদুল হক
http://rnawrocki.com/pdfs/Christopher%20Hitchens%20-%20The%20Trial%20of%20Henry%20Kissinger.pdf
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার বিচার অনুষ্ঠিত হচ্ছে চার দশক পর বাংলার মাটিতে, এ এক ঐতিহাসিক তাত্পর্যময় ঘটনা। এই বিচার হচ্ছে গণহত্যার সঙ্গে জড়িত এ দেশীয় দোসরদের। বিলম্বিত বিচার ও কেবল এ দেশীয় সহযোগীদের বিচার সঠিক কাজ নয়, মূল হোতাদের বাদ দিয়ে সহযোগীদের বিচার ঠিক হচ্ছে না—এমন কথা অনেকে বলার চেষ্টা করছেন। তাঁদের বক্তব্যে বাস্তবতার একটি স্বীকৃতি ভিন্নভাবে মিলছে, সেটা হলো জেনোসাইড বা গণহত্যা ঘটে অনেক মানুষ মিলে, বিচার হতে হবে সবার।
অপরাধীদের মধ্যে 'হোতাদের' অবস্থান রাষ্ট্রশক্তির শীর্ষে, সেই সঙ্গে গণহত্যা বাস্তব করে তোলার নিষ্ঠুর কাজে যুক্ত থাকে আরো অনেক মানুষ, মধ্যবর্তী ও মাঠপর্যায়ে যাদের অবস্থান। স্মরণ রাখা দরকার, বিলম্বিত বিচার অর্থ বিচারের অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়া নয়, বরং বিচারের হাত যে কত শক্তিশালী, গণহত্যার জন্য বিচারের অধিকার যে কখনো তামাদি হয়ে যায় না, এ তারই অনুপম প্রকাশ। একাত্তরের গণহত্যার এ দেশীয় দোসরদের বিচারকাজ 'হোতাদের' বিচারের প্রাসঙ্গিকতা ও গুরুত্ব যে বড়ভাবে মেলে ধরেছে সেটাও এক ইতিবাচক ঘটনা।
১৯৪৮ সালে গৃহীত জোনোসাইড কনভেনশনে দৃঢ়ভাবে বলা হয়েছিল যে গণহত্যায় যারা সহযোগিতা করে, পরিকল্পনা প্রণয়নে অবদান রাখে, যোগসাজশ ও উসকানি দেয় তারাও সমভাবে দায়ী। সমভাবে কথাটিই বলা হয়েছে কনভেনশনে এবং পরবর্তী সময়ে সব আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে তা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে ওই ধারণার সম্প্রসারণ লক্ষ করা যায় এবং আন্তর্জাতিক আইনের পরবর্তী এই বিকাশ বাংলাদেশের বিচারের রায়েও আমরা লক্ষ করি। এর এক তাত্পর্যময় দিক হচ্ছে, গণহত্যা সংঘটনে জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজ বা যৌথ অপরাধচক্র; কিংবা বলা যেতে পারে সম্মিলিত অপরাধ-যৌগ গঠিত হওয়ার ধারণা।
একাত্তরের গণহত্যার দায়ভাগ বিশেষভাবে অর্পিত হয় ১৯৫ পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর ওপর, যাদের শনাক্ত ও চিহ্নিত করা হয়েছিল, বিচারের জন্য নেওয়া হয়েছিল বিভিন্ন উদ্যোগ, এমনকি জাতীয়ভাবে প্রণীত হয়েছিল উপযুক্ত আন্তর্জাতিক আইন। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার শুরুর পর ১৯৫ পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবি যে ক্রমে জোরদার হয়ে উঠছে সেটা সুলক্ষণ বটে, তবে জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজকে আরো বড়ভাবে দেখার রয়েছে।
তেমনভাবে দেখলে এখানে নিশ্চিতভাবে উঠে আসে পিন্ডি-ইসলামাবাদে ক্ষমতাসীন তত্কালীন পাকিস্তানি সামরিক ও রাজনৈতিক নেতাদের নাম, অর্থাত্ কেবল ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দি যুদ্ধাপরাধী নয়, আরো নাম এখানে উঠে আসে। গণহত্যা সংঘটনে যোগসাজশ, অনুমোদন, সহযোগিতা ও সহায়তার জন্য আরো এক নাম অপরাধী তালিকাভুক্ত হতে হবে, সেই ব্যক্তি হচ্ছেন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা, পরবর্তীকালের বিদেশমন্ত্রী, মহাশক্তিধর হেনরি কিসিঞ্জার।
এ ক্ষেত্রে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করব খ্যাতনামা সাংবাদিক ক্রিস্টোফার হিচেনসের কথা, ক্যান্সারে অকালমৃত্যু কিসিঞ্জারের বিচার অনুষ্ঠানে তাঁর ক্রুসেডে ইতি টেনেছে, কিন্তু যে প্রয়াস তিনি নিয়েছিলেন, তাঁর প্রাসঙ্গিকতা, যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তা কোনোভাবে ফুরিয়ে যায়নি। ক্রিস্টোফার হিচেনসের গ্রন্থ 'দি ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার' ফিরে ফিরে পাঠ করা দরকার। হিচেনস যেসব দেশে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য কিসিঞ্জারকে দায়ী করেছেন তার মধ্যে রয়েছে ভিয়েতনাম তথা ইন্দোচীন, চিলি, সাইপ্রাস, পূর্ব তিমুর ও বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে গণহত্যা ও পরবর্তীকালের বঙ্গবন্ধু হত্যা এক সূত্রে বিচার করেছেন হিচেনস এবং প্রণয়ন করেছেন তাঁর অভিযোগনামা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে নিক্সন-প্রশাসন অনুসৃত পাকিস্তান-তোষণমূলক নীতির প্রধান প্রবক্তা ছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার। এর ফলে যে পাকিস্তানি শাসকরা বেপরোয়া ও যথেচ্ছভাবে তাদের ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে গেছে সেটা প্রমাণিত সত্য। এর পেছনে কিসিঞ্জারের ব্যক্তিগত স্বার্থও জড়িত ছিল, একাত্তরের সেই ভয়ংকর দিনগুলোতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান চীনের সঙ্গে আমেরিকার গোপন দূতিয়ালিতে পালন করছিলেন পরম বিশ্বস্ত ভূমিকা। জুন মাসে ভারত ও পাকিস্তান সফরে এসেছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার এবং রাওয়ালপিন্ডি থেকে গোপনে বেইজিং গিয়ে চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের সঙ্গে গোপন বৈঠক করেন। এই সাফল্য অর্জনে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের ভূমিকা কিসিঞ্জারকে গণহত্যার এই প্রধান হোতার সঙ্গে হাত মেলাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত করেনি। পরে ডিসেম্বরের যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী যখন দ্রুত পিছু হটছিল তখন তাদের আত্মসমর্পণ ঠেকাতে হেন কাজ নেই কিসিঞ্জার যা থেকে বিরত ছিলেন। নিউ ইয়র্কে চীনা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করে তিনি তাঁকে ভারত আক্রমণের প্ররোচনা দিয়েছেন নির্লজ্জভাবে। পাশাপাশি সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে ধাবিত করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি নিতেও তিনি দ্বিধান্বিত হননি। ১০ ডিসেম্বর যখন পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড আত্মসমর্পণের জন্য বার্তা পাঠিয়েছিল, তখন সেটা ঠেকাতে কিসিঞ্জারের দৌড়ঝাঁপের অন্ত ছিল না। আত্মসমর্পণ পিছিয়ে গেল দিনকয়েক, চীনা আক্রমণের প্রতিশ্রুতি ও সপ্তম নৌবহরের দাপাদাপি পাকিস্তানি সেনানায়কদের কাছে বাঁচার অবলম্বন হয়ে উঠেছিল। সেই সঙ্গে মারারও। ১৪ ডিসেম্বর নিষ্ঠুর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারল মরণাপন্ন পাকিস্তানি বাহিনীকে চাঙ্গা করে তোলার ফলে।
চিলিতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত আলেন্দে সরকারকে উত্খাতের ষড়যন্ত্রকারী এবং জেনারেল পিনোশের সামরিক শাসনের বর্বরতার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কিসিঞ্জারের ভূমিকা পরমভাবে নিন্দিত হয়েছে। চিলির গণতন্ত্রকামী মানুষ নির্যাতনে প্রাণ দিয়েছেন, নিখোঁজ হয়েছেন অনেকে, দেশান্তরী হয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় ছন্নছাড়া জীবন বেছে নিয়েছেন বহু মানুষ, তবে তাঁরা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী হিসেবে পিনোশের বিচারের দাবি নিয়ে সদা ছিলেন সরব। এরই ফল হিসেবে দেখি অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল হিসেবে স্পেনে এসে স্থানীয় আদালতের সমন পেলেন পিনোশে, পালিয়ে লন্ডন গেলেও সেখানে আন্তর্জাতিক অপরাধের দায় এড়াতে পারলেন না। দ্রুত এলেন স্বদেশে, যেখানে শেষ পর্যন্ত তাঁকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হলো।
হেনরি কিসিঞ্জার বাইরে এক বিজ্ঞ পণ্ডিতের ভাব নিয়ে থাকেন, বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে ইতিহাসে নিজের অবস্থান গড়ে নিতে চান, লিখেছেন আত্মজীবনী ও সাম্প্রতিক ইতিহাসবিষয়ক বই, কিন্তু এসব বইয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা এবং এর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ নিয়ে দুই ছত্রও তিনি লেখেননি। উপেক্ষা দ্বারা তিনি আড়াল করতে চান ইতিহাসের সত্য।
চিলির শহীদদের আত্মা, নির্যাতিত নারী-পুরুষের কান্না তাড়িয়ে ফিরছে হেনরি কিসিঞ্জারকে। যত ক্ষমতাধরই তিনি হোন না কেন, তিনি কখনো যাবেন না স্পেনে কিংবা ফ্রান্সে। বন্ধুবর জেনারেল পিনোশের ভাগ্য তাঁর জন্য শিক্ষা বয়ে এনেছে। বাংলাদেশে গণহত্যার শিকার অগণিত মানুষের কান্নাও যেন তাড়িয়ে বেড়ায় কিসিঞ্জারকে, সেই ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব এখন বাংলাদেশের। গণহত্যার যোগসাজশকারী হিসেবে তিনিও সমভাবে দায়ী, এই বার্তা যেন তাঁকে সর্বদা পিছু ধাওয়া করে সেটা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। সে জন্য বাংলাদেশের গণহত্যায় ইন্ধনদাতা হিসেবে তাঁর বিরুদ্ধে আইনি অভিযোগনামা প্রণয়নের এটাই উপযুক্ত সময়।
সেই সঙ্গে এটাও স্মর্তব্য, ক্রিস্টোফার হিচেনসের গ্রন্থ প্রকাশের পরের বছর ২০০২ সালে ব্যক্তিগত কাজে প্যারিসে এসেছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার, উঠেছিলেন বনেদি হোটেল রিজে। সেখানে তাঁর কাছে পৌঁছেছিল ফরাসি আদালতে হাজির হওয়ার সমন, বিচারক রজার লে লয়ের প্রবীণ এই রাষ্ট্রবিদের কাছে জানতে চান 'অপারেশন কন্ডোর' সম্পর্কে এবং সেই সময় সামরিক অভিযানে নিখোঁজ পাঁচ মার্কিনির ভাগ্য বিষয়ে। বলা বাহুল্য, কিসিঞ্জার আদালতে হাজিরা দেননি, কাজ ফেলে সেই রাতেই বিমানে তিনি ফিরে আসেন আমেরিকায়। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের সুযোগ নেননি কিসিঞ্জার, পালিয়ে তিনি বাঁচলেন বটে, তবে ইতিহাসের নিরিখে সেটা যেন হয় আপাতত বাঁচা। আইনের কাঠগড়ায় হেনরি কিসিঞ্জারকে দাঁড় করানোর সুযোগ এখনো হাতছাড়া হয়নি, তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করার রয়েছে 'অপারেশন সার্চলাইট' নিয়ে, পাকিস্তানি বাহিনী পরিচালিত গণহত্যা বিষয়ে। তিনি যদি জেনে থাকেন দূর বাংলাদেশে গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে, তাঁর যদি সুযোগ থাকে সেই গণহত্যা প্রতিরোধের, সেই সুযোগ যদি তিনি না ব্যবহার করেন, তবে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তিনিও গণহত্যার জন্য দায়ী হবেন।
সেই বিচারের অপেক্ষায় এখনো রয়েছি আমরা।
লেখক : মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি
http://www.kalerkantho.com/print-edition/muktadhara/2015/12/16/302279#sthash.v2TmXTit.dpufhttp://rnawrocki.com/pdfs/Christopher%20Hitchens%20-%20The%20Trial%20of%20Henry%20Kissinger.pdf
__._,_.___