অর্ধেকের বেশি শিক্ষক পদ্ধতিই বোঝেন না
প্রাথমিকে সৃজনশীল শিক্ষা বিষয়ে গবেষণা প্রতিবেদন
ইত্তেফাক রিপোর্ট২৫ জানুয়ারী, ২০১৬ ইং ২৩:৩৭ মিঃ
প্রাথমিক বিদ্যা-লয়ে প্রবর্তিত সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি বোঝেন না অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষক। ২৫ ভাগ শিক্ষার্থী পরীক্ষার হলে প্রশ্নপত্রই বুঝতে পারে না। সৃজনশীল পদ্ধতির কার্যকারিতা নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় এমন তথ্য পাওয়া গেছে। গতকাল সোমবার ধানমন্ডির দৃক গ্যালারিতে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'রিসার্চ ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অফ কমপ্লিট এডুকেশন (রেস)'। এটি রেসের প্রথম গবেষণা প্রতিবেদন।
প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে গবেষকরা বলেন, সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর নামে শিক্ষা ক্ষেত্রে রীতিমত নৈরাজ্য চলছে। সৃজনশীল পদ্ধতি ভাল হলেও এটার সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। এ পদ্ধতি চালুর পর থেকে শিশুদের ওপর বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। কাঁধে দুইটি ব্যাগ নিয়ে তারা নুইয়ে পড়ে। এত বইয়ের অত্যাচারে শিশুদের এক প্রকার নাভিশ্বাস উঠেছে। তাছাড়া সৃজনশীল পদ্ধতিতে ক্লাসে শিক্ষকেরা ছাত্র-ছাত্রীদের ভালভাবে পড়া বুঝিয়ে দেবেন; কিন্তু তার উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা কোনো মতে ক্লাস শেষ করেই কোচিংয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বলা হচ্ছে- তোমরা কোচিং সেন্টারে না গেলে পাস করতে পারবে না। শিক্ষকেরাও এই পদ্ধতি ভালভাবে না বুঝতে পেরে দায়সারা ভাবে ক্লাস নিচ্ছেন। সৃজনশীলের গাইড পাওয়া যাচ্ছে বাজারে। সেই গাইড বইকে আরো সহজ করার জন্য আরো কিছু সাপোর্টিং বই বের হয়েছে। এরকম ভাবে শিক্ষা ক্ষেত্রে একটি ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু হয়েছে।
রেসের সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. শরিফ উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন বিশিষ্ট কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, নৃ-বিজ্ঞানী ড. জহির উদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী, সিনিয়র সাংবাদিক মুস্তাফিজ শফি, ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান, আব্দুল্লাহ আল মামুন প্রমুখ। এছাড়াও সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার বাসাউরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক প্রসেন কান্তি তালুকদার এবং ঢাকার ধানমন্ডির মনেশ্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা স্বপ্না পারভীন আলোচনায় অংশ নেন। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রেসের সদস্য ফৌজিয়া আক্তার রিনি। অনুষ্ঠানের শুরুতেই প্রাথমিক শিক্ষার গবেষণার ওপরে ছয় মিনিটের একটি ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়।
সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতি সমস্যা নয়, সমস্যা হলো এর প্রয়োগে। শিক্ষার নামে বাণিজ্য একটা মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য ও নৈরাজ্য চলছে, এটা সবাই জানে। সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে যদি সরকারের সদিচ্ছা থাকতো তাহলে বেশি বেশি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারতো, এভাবে জরিপ করে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে পারতো।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বইয়ের আধিক্য অস্বাভাবিক। এখনকার শিক্ষার্থীদের যে চাপে রাখা হয় তাতে কেউ-ই সৃজনশীল হতে পারবে না। যদি কোচিংয়েই যেতে হয় তাহলে স্কুলের দরকার কি? সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতিটি চালু বিষয়ে তিনি বলেন, এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংকের অর্থায়নে কিছু ব্যক্তি কিছু দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা পরিদর্শন করে এসে এটা চালু করেন। কিন্তু যে দেশে ৮০ জন শিক্ষার্থীদের জন্য একজন শিক্ষক, শ্রেণিকক্ষ নেই- সেখানে মাল্টিমিডিয়া দিয়ে খুব একটা লাভ নেই।' সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির পেছনে হাজার হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য আছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। সৃজন পদ্ধতি ভাল না মন্দ সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের সেটা নিয়ে মত দেয়ার পরিবেশ নেই উল্লেখ করে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, 'সরকারগুলো রাজনৈতিক কারণে পাসের হারের পেছনে দৌড়ায়। সেই সাথে চলছে ভয়ঙ্কর রকমের শিক্ষা বাণিজ্য। এই প্রবণতা বন্ধ না হলে ভবিষ্যত্ ভাল হবে না।
দেশের গ্রামীণ, শহর, সীমান্ত, হাওর এবং পার্বত্য অঞ্চলের ১৬টি জেলার ২১টি স্কুল নিয়ে জরিপ পরিচালনা করা হয়। গবেষণায় দেখা যায়, শতকরা ১৩ ভাগ শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝেন না, ৪৫ ভাগ শিক্ষক বুঝেন এবং ৪২ শতাংশ শিক্ষক অল্পবিস্তর বুঝতে পারেন। সুতরাং প্রাপ্ত উপাত্ত থেকে দেখা যায় অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতি বিষয়ে বোঝেন না। যদি শিক্ষকদেরই ধারণা না থাকে বা না বুঝতে পারেন তাহলে তারা কিভাবে প্রাথমিক স্তরের শিশুদের শিক্ষা দিবেন। শতকরা ৪৭ ভাগ শিক্ষক বাজারে প্রচলিত গাইড বইয়ের উপর নির্ভর করেন, ৩৫ ভাগ শিক্ষক সহকর্মীদের সাথে আলোচনা করেন এবং ১৮ ভাগ শিক্ষক নিজেদের নিজস্ব ধ্যান ধারণা থেকে পড়ান। প্রায় অর্ধেকের মতো শিক্ষক গাইড বইয়ের সাহায্য নিচ্ছেন। সরকার কর্তৃক কোনো প্রশিক্ষণই দেয়া হয়নি তাদের। শতকরা ২৫ ভাগ শিক্ষক মনে করেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য সৃজনশীল পদ্ধতি উপযুক্ত নয়, ২০ ভাগ মনে করেন প্রচলিত পদ্ধতি আরো উন্নত করতে হবে, কিন্তু ৫৫ ভাগ মনে করেন সৃজনশীল পদ্ধতি কিছুটা কাজ করছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে এক চতুর্থাংশ শিক্ষক মনে করছেন এটা প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার জন্য উপযুক্ত নয়।
গবেষণায় শিক্ষার্থীদের জন্য চারটি প্রশ্ন ছিল। এতে প্রাপ্ত উপাত্তগুলো হলো, ৯২ ভাগ শিক্ষার্থী গাইড বইয়ের সাহায্য নেয়। মাত্র ৮ ভাগ শিক্ষার্থী গাইড বই থেকে দূরে থাকে। সুতরাং শিক্ষার্থীদের গাইড বইয়ের উপর নির্ভরশীলতা প্রধান একটি সমস্যা। তারা নিজেদের সৃজনশীল করার চাইতে গাইড বইয়ে বেশি মত্ত রাখছে। ৬৭ ভাগ শিক্ষার্থী সৃজনশীল পদ্ধতি বুঝবার ক্ষেত্রে গৃহশিক্ষকের সহায়তা নিচ্ছে, যেখানে ৩৩ ভাগ নিচ্ছে না। সুতরাং দুই-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী গৃহশিক্ষকের সাহায্য নিচ্ছে। ফলে প্রাথমিক শিক্ষা গৃহশিক্ষক ও কোচিং নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। পরীক্ষার কেন্দ্রে ২৫ ভাগ শিক্ষার্থী প্রশ্নপত্র বোঝতে পারে না। ৭৫ ভাগ শিক্ষার্থী বুঝতে পারছে। এক চতুর্থাংশ তাদের প্রশ্নই বুঝতে পারছে না।
ইত্তেফাক রিপোর্ট২৫ জানুয়ারী, ২০১৬ ইং ২৩:৩৭ মিঃ
__._,_.___