আমাদের দেশের শিশুরা দারিদ্র্যের কারণে নানান ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হচ্ছে। ফলে দেশে এই শিশুশ্রম মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এমনকি ঝুকিপূর্ণ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত অসংখ্য শিশু শ্রমিকের মৃত্যুও ঘটছে। বিপজ্জনক জেনেও দরিদ্র শিশুদের ঠেলে দেয়া হচ্ছে মৃত্যুর মুখে। এক্ষেত্রে দেশে প্রচলিত আইন উপেক্ষিত হওয়ায় কর্মক্ষেত্রে শিশু মৃত্যুর ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে বলা যায়। এর মধ্যে সিংহভাগ শিশুশ্রম পরিচালিত হচ্ছে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী ১৪ বছরের কম বয়সী কোনো শিশুকে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগবঞ্চিত না করে কাজে নিয়োগ দেয়া যাবে এবং কাজটা হবে ঝুঁকিহীন ও হালকা।
১৮ বছরের নিচে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া দারিদ্র্য দূরীকরণ কৌশলপত্র, জাতীয় পরিকল্পনা, সবার জন্য শিক্ষা, জাতীয় টাইম বাউন্ড কর্মসূচি ইত্যাদিতে শিশুশ্রম প্রতিরোধ ও নিরসনে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট আইন থাকার পরও গুটিকয়েক কারখানা ছাড়া এ আইন মানা হচ্ছে না। রাজধানীতে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে গড়ে উঠা এমব্রয়ডারি, ব্যাটারি ফ্যাক্টরি, ট্যানারি, ভাঙাড়ি, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেট্রনিক্স যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানা, সাবান-শ্যাম্পু তৈরির কারখানা, বিড়ি কারখানা, কয়েল তৈরির কারখানা, মোমবাতি কারখানা, সিরামিক ও টাইলস কারখানায় নিয়োজিত শ্রমিকদের মধ্যে রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশু। এছাড়া হকার, ডাস্টবিনে ময়লা কুড়ানো, কুলি, পরিবহন শ্রমিক, ফুল বিক্রেতা, মাদকদ্রব্য বাহক ও বিক্রেতা হিসেবে কাজ করছে অসংখ্য শিশু। এক জরিপে দেখা গেছে, দেশে ৭৪ লাখ শিশু শ্রমিক রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৫০ ভাগ শিশু পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস। আর অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা ১৪ লাখ।
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছে, বর্তমানে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা আরো অনেক বেড়েছে। সাধারণত পাঁচ থেকে ১৪ বছরের শিশুরা যখন ১৮ থেকে ৪৮ ঘণ্টা কাজ করে তখন একে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম হিসেবে ধরা হয়। রাজধানীতে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে অসংখ্য শিশু শ্রমিক। এর প্রধান কারণ দারিদ্র্য। পরিবারে অর্থের যোগান দিতে বা নিজেদের জীবিকার তাগিদে তাদের করতে হচ্ছে এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। গত ১০ বছরে রাজধানীতে ভয়ঙ্করভাবে শিশুশ্রমের প্রবণতা বেড়েছে।
সরেজমিন প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, শিশুশ্রমের করুণ চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের চারুকলা ইনস্টিটিউটের বিপরীত পার্শ্বের গেট দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে একদল শিশু। তারা হাতে জুতো পালিশের উপকরণ নিয়ে বসে থাকে। তারা মুচির কাজ করে। তাদের একজনের নাম সুমন (১০)। মাদারীপুরে তার বাড়ি। মা-বাবার সঙ্গে গত ৫ বছর ধরে পুরান ঢাকায় থাকে। আর্থিক কারণে লেখাপড়ার সুযোগ হয়নি। সে দৈনিক ২শ' থেকে ৩শ' টাকা আয় করে। তবে অনেক সময় দিনের খাবারের টাকাও জুটে না বলে জানায় সুমন। রাজধানীর ফার্মগেট এলাকার একটি খাবার হোটেলে থালাবাসন ধোয়ার কাজে ব্যস্ত ১১ বছরের শিশু মোহাম্মদ হাবীব। সকালে নাশতা বানানোর কাজে সহায়তা করা থেকে শুরু করে বাসন মাজা, ঘর ঝাড়ু দেয়া, বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত থাকে সে প্রতিদিন। টাঙ্গাইল থেকে আসা ১১ বছর বয়সী এই শিশুটি জানায়, ৪ ভাইবোনের সংসারে সে দ্বিতীয় সন্তান। দরিদ্র বাবা-মায়ের কষ্ট একটু ঘোচাতে ৪ বছর আগে সে ঢাকায় আসে। নেত্রকোনার ১২ বছরের শিশু মাসুম মগবাজার পেয়ারাবাগ কাঁচাবাজারের পাশের একটি চা দোকানে কাজ করে। তার মালিক কাশেম চা তৈরি করে। আর লোকজনের হাতে চা তুলে দেয় মাসুম। আশপাশের দোকানে দোকানে গিয়েও তাকে চা দিয়ে আসতে হয়। শিশু মাসুম জানায়, মা রাহেলা বেগম অন্যের বাসায় কাজ করে। বাবা সবুজ মিয়া রিক্সা চালায়। তিন ভাইবোনের মধ্যে সে সবার বড়। অসচ্ছলতার কারণেই সে লেখাপড়া করতে পারছে না বলে জানায় শিশু মাসুম।
অপর এক শিশুর নাম হাবীব, জন্মের কিছুদিন পরই দিনমজুর বাবাকে হারিয়েছে। ওই পরিবারে নেমে আসে কালো ছায়া। বাঁচার তাগিদে শিশু থেকেই কাজে নেমেছে সে। এখন তার বয়স ১৪ বছর। যে বয়সে তার স্কুলের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ছোটাছুটি করার কথা, তখন সে মগবাজার রেলগেটের একটি ওয়ার্কসপের ঝালাইসহ রড-টিন কাটা ও হাতুরি পেটানোর মতো অধিক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। শুধু শিশু হাবীব নয়, ১১ বছরের ইকবাল চালায় রিকশা, ৯ বছরের জাফর করছে খাবার হোটেলের কাজ। ১০ বছরের শিশু জয়নাল পরিত্যক্ত শাক-সবজি, ফলমূল কুড়োয় কাওরান বাজারে। এসব কুড়িয়ে সে তার মায়ের কাছে জমা দেয়। আর তার মা সেগুলো পরিষ্কার করে বাজারের এক পার্শ্বে ভাগা সাজিয়ে বিক্রি করে। এসব কুড়োতে গিয়ে অনেক সময় ব্যবসায়ীদের দ্বারা দৈহিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় বলে জানায় শিশু জয়নাল। এভাবে সারাদেশে এ রকম শত শত শিশু এখন জীবনধারণ ও বেঁচে থাকার তাগিদে দৈনিক ২০-৫০ টাকা আয়ে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নেমেছে। অভাবের তাড়নায় বাধ্য হয়ে বাবা-মা শিশুকে সামান্য টাকার বিনিময়েই এসব কাজে লাগিয়ে দিচ্ছে।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, দেশে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে ১৩ লাখ শিশু। এসব শিশুকে শ্রমে নিয়োগের ব্যাপারে ব্যাপক বিধিনিষেধ রয়েছে। তবে পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে শর্তসাপেক্ষে জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতিতে শিশুদের শ্রমে নিয়োগের অনুমতি দেয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে শিশুদের কাজ করার জন্য অনুকূল কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও বাস্তবে সেসব শর্তের সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র লক্ষ্য করা গেছে অনেক কারখানায়। পুরান ঢাকার ট্যানারি কারখানাগুলোতে শিশুরা ভয়াবহ পরিবেশে কাজ করছে। মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের কয়েকটি লোহার কারখানায় দেখা গেছে, শিশুদের দিয়ে ভারি লেদ মেশিনে কাজ করানো হচ্ছে। কর্মঘণ্টা এবং দৈনিক কর্মতালিকার কোনো বালাই নেই সেখানে। সপ্তাহে একদিন ছুটির ব্যবস্থা থাকলেও চাকরিচ্যুত করার আগে কোনো নোটিশ দেয়া হয় না। এছাড়া কর্মস্থলে তারা বড়দের দ্বারা নানাভাবে দৈহিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
সরকার এখনো ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম খাতগুলো চিহ্নিত করতে পারেনি। তবে বিভিন্ন সংস্থা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হিসেবে মোটর ওয়ার্কশপ, ওয়েল্ডিং, গ্লাস কারখানা, বেলুন কারখানা, লেদ মেশিন, রিকশা চালানো, মাদক বাহক, বিড়িশ্রমিক, বাস-ট্রাকের হেলপার, নির্মাণশ্রমিক, গৃহ শিশুশ্রম, এমব্রয়ডারি, জাহাজ শিল্প, চিংড়ি হ্যাচারি, শুঁটকি তৈরি, লবণ কারখানা, কৃষিকাজ, বেডিং স্টোরের শ্রমিক, ইট ভাঙা, কুলি ইত্যাদি খাতকে চিহ্নিত করেছে।
উল্লেখ্য, যে বয়সে শিশুদের ইলম শেখার কথা সে সময়ে তারা জীবিকার জন্য শ্রম দেবে এটি দুর্ভাগ্যজনক। তাদের ইলমমুখী করে তুলতে হবে তাদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্যই। শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে দূরে রাখতে সামাজিক আন্দোলনের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। শিশুশ্রম দূর করতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে অনেক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তারপরও দেশে শিশুশ্রম চলছে এবং এবং মজুরির ক্ষেত্রেও তারা নির্দয়ভাবে নিষ্পেষিত হচ্ছে।
কোনো কোনো মহল দাবি করে যে, মানবিক কারণেই নারী ও শিশু শ্রমিকদের প্রতি নজর দিতে হবে। বলাবাহুল্য, তথাকথিত মানবতাবাদীরা এসব সেøাগান বহু বছর যাবতই আওড়িয়ে যাচ্ছে কিন্তু কাঙ্খিত মূল্যবোধ তারা আদৌ তৈরি করতে পারছে না। এবং পারবে বলেও প্রতীয়মান হচ্ছে না। তার পিছনে কারণ এই যে, মানবতাবোধ, মানবাধিকার মূলত মানুষের অনুভূতি তথা আত্মিক আহবান থেকেই উৎসারিত।
কাজেই মানুষের প্রতি মানুষের আহবান যতটা আবেগ সঞ্চার করতে পারে, মানুষের স্রষ্টা মহান আল্লাহ পাক উনার কালাম এবং উনার হাবীব, আখিরী রসূল, হযরত নবী আলাইহিমুস সালামগণ উনাদের নবী, হযরত রসূল আলাইহিমুস সালামগণ উনাদের রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র হাদীছ শরীফ, মহান আল্লাহ পাক উনার বান্দা তথা উম্মতে হাবীবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম উনাদের উপর অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করে। এ প্রভাব ইহলৌকিক নয়। এ প্রভাব রূহানী। যা শুধু অধিক নিবেদিতই নয়; পাশাপাশি নির্ভেজাল এবং নিখুঁতও। কাজেই শিশুদের প্রকৃত কল্যাণার্থে আমাদের এই রূহানী চেতনারই বিস্তার ঘটাতে হবে।
__._,_.___