নোবেল শান্তি পুরস্কারের কোনো গ্রহণযোগ্যতা আর আছে কি
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী১৫ জানুয়ারী, ২০১৭ ইং
নোবেল পুরস্কার, বিশেষ করে শান্তি পুরস্কার তার সকল গৌরব হারিয়েছে। নোবেল পুরস্কারের প্রবর্তক আলফ্রেড নোবেল আজ বেঁচে থাকলে হয়তো ঘৃণার সঙ্গে তার নামটি এই পুরস্কারের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে দিতেন না, প্রত্যাহার করে নিতেন। গত ১০ ডিসেম্বর নরওয়ের রাজধানী অসলোতে এই পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট জুয়ান মানুয়েল সান্তোষকে। এ পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল। কিন্তু এর একটি অনুষ্ঠানেও আমেরিকার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারকে শান্তির দূত আখ্যা দিয়ে সম্মানিত অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল নরওয়ের নোবেল শান্তি পুরস্কার ইনস্টিটিউট এবং অসলো ইউনিভার্সিটি।
ফলে বিশ্বের বহু দেশে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত হেনরি কিসিঞ্জারকে শুধু নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া নয়, তাকে পুরস্কার দানের একটি অনুষ্ঠানে শান্তির দূত আখ্যা দিয়ে আমন্ত্রণ জানানোর দরুন দারুণ প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। নরওয়ের নোবেল শান্তি পুরস্কারদানের কমিটি এই প্রতিবাদের পরোয়া করবেন বলে মনে হয় না। তারা জেনেশুনেই এ কাজটি করেছেন। এর আগেও শান্তি পুরস্কারদানে এই ধরনের ভণ্ডামির আশ্রয় তারা নিয়েছেন। প্যালেস্টাইনের মুক্তি সংগ্রামের নেতা ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রীর গলায় একই শান্তি পুরস্কারের পদক তারা পরিয়ে দিয়েছিলেন।
কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট জুয়ান সান্তোষকে ২০১৬ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারে সম্মানিত করা অনেকের কাছেই ভালো লেগেছে। ১৯৬৪ সাল থেকে কলম্বিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলেছে। সরকার ও সামরিক বাহিনীর সঙ্গে প্রধান গেরিলা বাহিনী ফার্ক ও বামপন্থি দলগুলোর সমন্বয়ে গঠিত মোর্চার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলছিল। তাতে গরিব সাধারণ মানুষের জীবনে অশান্তি ও দুর্দশা চরমে পৌঁছেছিল। প্রেসিডেন্ট সান্তোষ এই যুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছেন। গত ২৪ নভেম্বর তিনি কিউবার রাজধানী হাভানাতে গেরিলাদের সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। চুক্তিটি কলম্বিয়ার পার্লামেন্টে অনুমোদন পেয়েছে ১ ডিসেম্বর।
চুক্তিটিতে অনেক ত্রুটি আছে। তবু কলম্বিয়ার বামপন্থিদের একাংশের অসন্তোষ সত্ত্বেও এই শান্তিচুক্তি দেশটিতে শান্তি ফিরিয়ে এনেছে বলে অনেকেই সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। প্রেসিডেন্ট জুয়ান মানুয়েল সান্তোষ এই চুক্তিতে গেরিলা বাহিনীর প্রত্যেক যোদ্ধাকে সম্পূর্ণ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছেন। এই চুক্তি দেশ-বিদেশের অনেক মানুষকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে সম্পাদিত পার্বত্য (চট্টগ্রাম) শান্তি চুক্তির কথা মনে পড়িয়ে দেবে। কলম্বিয়ার শান্তি চুক্তির মতোই এটিও ছিল একটি ঐতিহাসিক চুক্তি। ব্রিটেনের যুদ্ধবাজ সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার পর্যন্ত বাংলাদেশের পার্বত্য শান্তি চুক্তির ঐতিহাসিকতা স্বীকার করে প্রশংসা করেছিলেন।
কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট মানুয়েল নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন, তাতে কারো আপত্তি নেই। আপত্তি হেনরি কিসিঞ্জারের মতো বিতর্কিত ব্যক্তির অতীতে এই পুরস্কার পাওয়ায় এবং আবার এই পুরস্কার দান-সংক্রান্ত অনুষ্ঠানে তাকে শান্তির দূত আখ্যা দিয়ে সম্মানিত অতিথি হিসেবে ডেকে আনায়। নরওয়েরই একটি রাজনৈতিক দল কিসিঞ্জারকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করে দেশের আদালতে মামলা করেছে এবং নরওয়ের মাটিতে কিসিঞ্জার পা দিলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করার দাবি জানিয়েছিল। এই দাবিতে গলা মিলিয়েছে ইউরোপের অন্যান্য দেশেরও শান্তিকামী মানুষ ও সংগঠন।
দেশ-বিদেশের এই প্রতিবাদের মুখেও নরওয়ের নোবেল শান্তি পুরস্কার ইনস্টিটিউট ও অসলো ইউনিভার্সিটি কেন বেছে বেছে হেনরি কিসিঞ্জারকেই বিশ্ব শান্তির দূত হিসেবে বার বার সম্মান জানাচ্ছেন, তা এক বিস্ময়কর ব্যাপার। ফলে এই পুরস্কারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বহু দেশ। তাদের মধ্যে রয়েছে চীন। শুধু চীন নয়, বিশ্বের বেশকিছু দেশ এখন মনে করে, পশ্চিমা শক্তি কর্তৃক তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার ও সাহিত্য পুরস্কার দুটিরই অতি অপব্যবহারের ফলে এই পুরস্কার শুধু গ্রহণযোগ্যতা নয়, তার সকল মর্যাদা হারিয়েছে।
এর একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো, ২০০৯ সালে ৫৯ বছর বয়সী এক ব্যক্তি লিও জিয়াওবো সন্ত্রাসী কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকার অপরাধে চীনের আদালত কর্তৃক ১১ বছরের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। পরের বছর ২০১০ সালে নোবেল কমিটি শান্তি পুরস্কার দানের জন্য তাকে মনোনীত করে। চীন এর তীব্র প্রতিবাদ জানায়। সেবার এই প্রতিবাদে কণ্ঠ মিলিয়েছিলেন নরওয়ে সরকারও। এখন পশ্চিমা দেশগুলোতেই অভিযোগ উঠেছে, আমেরিকার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী জোটের আধিপত্য রক্ষা ও প্রসারের সামরিক বাহু যেমন ন্যাটো, অর্থনৈতিক বাহু বিশ্বব্যাংক, তেমনি সাংস্কৃতিক বাহু হচ্ছে নোবেল শান্তি ও সাহিত্য পুরস্কার।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর নোবেল শান্তি ও সাহিত্য পুরস্কার ধীরে ধীরে তার গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদা হারায় এবং স্নায়ুযুদ্ধে (cold war) পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের উদ্দেশ্য পূরণের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। গত শতকে সোভিয়েট ইউনিয়নকে বিব্রত করার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে রুশ লেখক বরিস পাস্তেরনাককে তার 'ড. জিভাগো' বইয়ের জন্য নোবেল সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হয়। তা নিয়ে রুশ-মার্কিন স্নায়ুযুদ্ধ তুঙ্গে ওঠে। এখন তো প্রমাণিত হয়েছে ড. জিভাগো বইটির সাহিত্য মূল্য তেমন নেই। সোভিয়েত শাসনব্যবস্থার সমালোচনা করাতেই পশ্চিমা ব্লকের কাছে এই বইটির কদর বেড়েছিল এবং সিআইএ'র গোপন অর্থ সাহায্যে ইউরোপে বইটি প্রকাশ করা হয়েছিল।
নোবেল শান্তি পুরস্কার ইনস্টিটিউট বহু যুদ্ধাপরাধী ও মানবতার শত্রুকে এই শান্তি পুরস্কার দিয়ে শুধু পুরস্কারটির নয়, নিজেরাও মর্যাদা হারিয়েছেন। কিসিঞ্জারকে শান্তির দূত বলা ও শান্তি পুরস্কার দেওয়া এই পুরস্কারের গ্রহণযোগ্যতা একেবারেই নষ্ট করেছে। কলকাতায় দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় এক কলামিস্ট লিখেছেন, নরওয়ের নোবেল কমিটি অতীতে যুদ্ধবাজ হেনরি কিসিঞ্জারকেও বিশ্ব নোবেল শান্তি পুরস্কার দিয়ে নিজেদের আবার হাস্যাস্পদে পরিণত করেছিল।
হেনরি কিসিঞ্জারের নামটি বাংলাদেশের মানুষের কাছে অতি পরিচিত। ১৯৭১ সালে আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এই লোকটিই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন এবং পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীকে বাংলাদেশে গণহত্যায় সমর্থন জুগিয়েছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন বঙ্গবন্ধুর সরকার যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনে ব্যস্ত, তখন এই কিসিঞ্জারই বিদ্রূপ করে বলেছিলেন, বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি।
জার্মানির এক ইহুদি পরিবারে তার জন্ম। ১৯৩৮ সালে অভিবাসী হিসেবে আমেরিকায় আসেন এবং নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। কম্বোডিয়ায় গণহত্যা, ইন্দোনেশিয়ায় সুকর্নের আমলে গণহত্যা, পূর্ব তিমুরে ধ্বংসযজ্ঞ, বাংলাদেশ ও চিলিতে রক্তের প্লাবন সৃষ্টি, আলেন্দে ও মুজিব-হত্যা ইত্যাদি অসংখ্য ঘটনার সঙ্গে কিসিঞ্জারের নাম জড়িত। এজন্যেই এখন প্রশ্ন উঠেছে এমন এক ব্যক্তিকে নোবেল শান্তি পুরস্কার ইনস্টিটিউট কেমন করে একবার শান্তি পুরস্কার দেওয়ার পর আবার এ বছর সসম্মানে আমন্ত্রণ জানাল অসলো ইউনিভার্সিটির প্রধান সভাকক্ষে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিষয়ে ভাষণদানের জন্য? এই ব্যাপারে লন্ডনের একটি বামপন্থি সাপ্তাহিক প্রশ্ন তুলেছেন, হিটলার যদি আজ বেঁচে থাকতেন, তাহলে তাকেও কি আজ এই আমন্ত্রণ জানানো হতো? দুর্ভাগ্য হিটলারের। তিনি ইহুদি ছিলেন না। ছিলেন ইহুদিবিদ্বেষী।
'গরিবের কথা বাসি হলে ফলে', নোবেল শান্তি পুরস্কার যে তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে, একথা আমি বহুদিন আগে লিখেছিলাম, যখন বাংলাদেশের এক স্বনামধন্য ব্যাংকারকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। গরিবকে চড়া সুদে ঋণ দিয়ে অতি মুনাফার ব্যবসা করা ছাড়া বিদেশে দূরে থাক, তার নিজের দেশেও শান্তি প্রতিষ্ঠায় তার কণামাত্র অবদান নেই। তবু তাকে দেওয়া হয়েছিল নোবেল শান্তি পুরস্কার। অবশ্য পুরোটা নয়, অর্ধেকটা। বাঙালি হিসেবে তাতে আমার গর্ববোধ করার কথা। কিন্তু গর্ববোধ না করে আমি এর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে তখনই এই পুরস্কারের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছি। ব্যাংকিং বা অর্থনৈতিক কোনো বিষয়ে তাকে পুরস্কার না দিয়ে শান্তি পুরস্কারে তাকে ভূষিত করা হলো কেন?
বুঝতে বাকি থাকেনি, এর পেছনে ছিল পশ্চিমা শক্তির রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। এই নোবেল জয়ীর ছিল আওয়ামী লীগ ও হাসিনাবিরোধী অবস্থান। তাকে সাহায্য করাই ছিল তখনকার মার্কিন প্রশাসনের এক শক্তিশালী ব্যক্তির উদ্দেশ্য। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরই এই স্বনামধন্য ব্যাংকার নোবেল পুরস্কারের মাদুলি গলায় ঝুলিয়ে রাজনীতিতে ঢোকার এবং নেতৃত্ব গ্রহণের চেষ্টা করেন। তার পেছনে সায় ছিল তখনকার আধা সামরিক সরকারেরও। তখন বাংলাদেশে রাজনৈতিক তত্পরতা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু এই নোবেলজয়ী এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই প্রকাশ্যে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। কিন্তু এই দল বাংলাদেশের রাজনীতিতে অশ্বডিম্ব ছাড়া আর কিছু হতে পারেনি।
কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট মানুয়েল তার দেশের গেরিলাদের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করায় নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিল তাতে আমি আনন্দিত। কিন্তু এই শান্তি চুক্তির পাশাপাশি আমরা যদি বাংলাদেশে শেখ হাসিনা কর্তৃক সম্পাদিত পার্বত্য শান্তি চুক্তির কথা বিবেচেনা করি, তাহলে দেখা যাবে, এই চুক্তি কলম্বিয়ার চুক্তির মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশ্ব শান্তি রক্ষার ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রেখেছে। এ জন্যে শেখ হাসিনারও কি নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া উচিত ছিল না? নাকি তিনি পশ্চিমা স্বার্থ ও আধিপত্যের কাছে নতজানু নন বলেই নোবেল শান্তি পুরস্কার ইনস্টিটিউটের দৃষ্টি তার দিকে পড়েনি? এই পুরস্কার হয়তো একদিন শেখ হাসিনা পাবেন। কিন্তু তখন তার গ্রহণযোগ্যতা আর পুনরুদ্ধার করা যাবে কি?
লন্ডন ১৪ জানুয়ারি, শনিবার, ২০১৭
__._,_.___