ইউকেচিং: এক অকুতোভয় মুক্তিসেনানী
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বান্দরবান: বীরবিক্রম ইউকেচিং মার্মা। মহান মুক্তিযুদ্ধের এক অকুতোভয় মুক্তিসেনানীর নাম। ১৯৩৩ সালে বান্দরবান জেলার উজানী পাড়ায় তার জন্ম। বাবার নাম বাইশাউ মার্মা।
সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর থেকেই বান্দরবান পৌরসভার লাঙ্গি পাড়ায় নিজ বাড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন তিনি। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই ছেলে ও এক কন্যা সন্তানের জনক।
দারিদ্রতার কারণে লেখাপড়ায় বেশিদূর এগোতে পারেননি তিনি। কিন্তু তার মধ্যে দেশ ও জাতির জন্য নিজিকে উৎসর্গ করার প্রত্যয় ছিল ছেলেবেলা থেকেই। সে লক্ষ্যে পাকিস্তান রাইফেলস ব্যাটালিয়ন (ইপিআর) এ যোগ দেন ১৯৫২ সালে।
এরপর ১৯৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ৯ মাস রনাঙ্গণে দেশমাতৃকার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন তিনি। সেই অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়।
বাংলাদেশে আদিবাসিদের মধ্যে বান্দরবানের ইউকেচিং একমাত্র বীর বিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। তিন পার্বত্য জেলায় বসবাসরত সকল নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে তিনি মারমা সম্প্রদায়ভুক্ত।
তিনি একসময় ইপিআর ও বিডিআর এর হকি খেলোয়াড় হিসেবে সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। বিডিআর এর হকি কোচ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন।
তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে বান্দরবান জেলা প্রশাসন দেশের অন্যতম পর্যটন স্পট নীলাচলে ইউকেচিং এর আবক্ষ ভাস্কর্য নির্মাণ করেছেন। বিভিন্ন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন সময়ে নানা উপহার। গোল্ড মেডেল প্রদান করা হয়েছিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে। এছাড়াও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের অর্থায়নে তার জন্য নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছিল সেমিপাকা ঘর। বান্দরবান জেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও বিজিবির পক্ষ থেকেও বীর বিক্রম ইউকেচিংকে সম্মানজনক উপহার দেওয়া হয়েছিল।
সর্বশেষ বান্দরবান পৌরসভা ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের আর্থিক সহায়তায় তার বাড়ির আঙিনা পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়েছিল পাকা সড়ক। যার নামকরণ করা হয়েছে সুবেদার ইউকেচিং বীর বিক্রম সড়ক।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ইউকেচিং এর স্মৃতিচারণ
মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তিনি বহুবার স্মৃতিচারণ করেছিলেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি রংপুর জেলার সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ করে শত্রুদের পরাজিত করেন। এ বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বপ্ন ছিল- নব প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা।
স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব যেন তরুণরা মর্যাদার সঙ্গে পালন করে এ প্রত্যাশা রেখে গেছেন সবার কাছে। বর্তমান সরকারের সময়ে স্বাধীনতা বিরোধী, যুদ্ধাপরাধী, কুখ্যাত রাজাকারদের বিচার কার্য সম্পাদন হচ্ছে। জীবদ্দশায় তিনি তা দেখে যেতে পেরে খুশি এবং গর্বিত হয়েছিলেন।
রনাঙ্গণে ইউকেচিং
স্বাধীনতা সংগ্রামে ইউকেচিং প্রথম শত্রুর মুখোমুখি হন লালমনিরহাট জেলার তিস্তা নদীর কুলাঘাটে (খেয়াঘাট)। ২৪ জন বাঙালি সৈনিককে সঙ্গে নিয়ে পূর্ব সিদ্ধান্তক্রমে শত্রুর ঘাঁটি চিহ্নিত করে ডিফেন্স নেন। সেখানে একাধিক বাংকার ও মরিচা খনন করা হয়। ৩দিন বাংকারে অবস্থান নেওয়ার পর পাঞ্জাবিরা চতুর্থ দিন রাতে ফায়ার শুরু করে।
রাতভর ভারী অস্ত্র দিয়ে ফায়ার করলেও বাঙালি সৈনিকরা ফায়ারের জবাব দেননি। ফায়ার চলাকালীন অবস্থায় ইউকেচিং একটি স্ট্যানগান ও ৯টি গ্রেনেডসহ দুই সৈনিককে নিয়ে বাংকারগুলো পরিদর্শন করতে যান। কিন্তু তিনি দেখেন, কোনো বাংকারেই সৈনিকরা নেই। তারা সবাই পালিয়ে গেছেন। ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন তিনি।
এ অবস্থায় ফায়ারের মধ্যে তিনি একটি বাংকারে আশ্রয় নিয়ে রাত কাটান। পরদিন ভোর ৪টার দিকে পাঞ্জাবিরা ফায়ার বন্ধ করে। এসময় বৃষ্টি হচ্ছিল। পাঞ্জাবিদের ফায়ার বন্ধের কিছু সময় পর ইউকেচিং বাংকার থেকে উঠে লক্ষ্যহীন ভাবে চারিদিকে এসএমজি রাইফেল দিয়ে ফায়ার করতে থাকেন। দেখলেন বাংকারের পাশে কোনো শত্রুর উপস্থিতি নেই। এ অবস্থায় দুই সিপাহীসহ প্লাটুন হেডকোয়ার্টারে আসেন ইউকেচিং।
তিনি দেখলেন বাংকার ছেড়ে পালিয়ে আসা সৈনিকরা পরোটা ও চা খাচ্ছেন। তিনি তাদের উপর ভীষণ ক্ষেপে গেলেন। বললেন সামনে কঠিন লড়াই। এজন্য সবার আরও বেশি মনোবল থাকা দরকার।
এ বিষয়টি মিত্রবাহিনীর এক মেজর জেনে ইউকেচিংসহ ওই ২৪ জন বাঙালি সৈনিককে ভারতের একটি ক্যাম্পে ডাকলেন। তিনি তাদের বললেন, এভাবে যুদ্ধ করলে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে না। তিনি সৈনিকদের সাহস যোগান ও ইউকেচিং এর বীরত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও প্রশংসা করেন।
এ অবস্থায় ইউকেচিং তার দল নিয়ে চলে আসেন বাঘাবান্দা বিওপির কাছে। এ বিওপিতে কেউ নেই। তারা আগেই বিওপি ছেড়েছে। বাঘাবান্দা বিওপির দখল নিতে তারা ভারতের ভূখণ্ডে রাতে বাংকার তৈরির কাজ শুরু করেন। পাঞ্জাবিরা মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি টের পেয়ে সন্ধ্যায় বাংকার লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। কিন্তু ইউকেচিংসহ অন্যান্য বীর যোদ্ধারা এসময় কোনো ফায়ার করেন নি।
পরদিন বৌ রঙ্গামারি বাজারের কাছে ডিফেন্স নেন ইউকেচিং এর নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা। এ স্থানটি ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। রাতে বাংকারে অবস্থান নেন তারা। এসময় সম্মুখযুদ্ধে সুলতান নামের এক সৈনিককে হারান তিনি। শত্রুর অবস্থানে খবর দিত এমন এক কিশোরকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে পাঞ্জাবিরা। কিন্তু বাঙালি সৈন্যরা এ অবস্থায় বাংকার ছেড়ে পালয়নি।
পরদিন মিত্রবাহিনীর এক মেজরের নেতৃত্বে মিত্র বাহিনীর এক ক্যাপ্টেন ও এক সিগন্যাল ম্যানের সঙ্গে ইউকেচিং বীর বেশে যুদ্ধ করেন। সারারাত চলে এ যুদ্ধ। সকালে দেখেন পাকিস্তানীরা বৌ রঙ্গামারি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।
মিত্রবাহিনীর প্রধানের সান্নিধ্যে ইউকেচিং
এ যুদ্ধের পর বৌ রঙ্গামারি আসেন মিত্র বাহিনীর প্রধান অরোরা। তিনি রণকৌশল, বাংকার নির্মাণ ও শত্রুর জন্য তৈরি করা ফাঁদসহ সার্বিক বিষয় দেখে ইউকেচিং এর প্রশংসা করেন।
বাংলা ভাষা ছাড়াও, উর্দূ, হিন্দিতে অনর্গল কথা বলতে পারতেন ইউকেচিং। এটি ছিল রনাঙ্গণে বীর বেশে যুদ্ধ করার কাজে তার বাড়তি সুযোগ। মিত্রবাহিনীর প্রধান বুক মেলান ইউকেচিং এর সঙ্গে। দেশকে শত্রুমুক্ত করার কাজে এভাবেই ইউকেচিং স্বাধীনতা সংগ্রামে ৯টি মাস নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন। তিনি কেবল যুদ্ধই করেননি, নিরীহ বাঙালিদের পৌঁছে দিয়েছেন ভারতের শরণার্থী শিবিরে।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, কুলাঘাটস্থ পাখি উড়াল গ্রামে মিটিং রয়েছে বলে গ্রামের সব পুরুষকে একত্রিত করে ব্রাশ ফায়ার করে মেরে ফেলে পাঞ্জাবিরা। এ অবস্থায় গ্রামের মহিলারা বিপাকে পড়েন। তিনি তাদের ভারতের শরণার্থী শিবিরে পৌঁছে দেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার খবর শোনার পর তিনি চলে আসেন রংপুর কারমাইকেল কলেজে। সেখানে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে বুক মেলান তিনি। দাম্ভিক পাকিস্তানিরা মিত্রবাহিনীর কাছে অস্ত্র সমর্পন করেছে জেনে আবেগে কাঁদলেন তিনি। কলেজের বিভিন্ন কক্ষে আটক পাঞ্জাবিদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন ইউকেচিং। এদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন তার পরিচিত ও সহকর্মী।
মাতৃভূমি নিয়ে ইউকেচিং এর প্রত্যাশা
মৃত্যুর আগে এক সাক্ষাৎকারে অশ্রুসিক্ত নয়নে ইউকেচিং বীর বিক্রম সংক্ষিপ্ত ভাবে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, দেশ স্বাধীন হলেও আমরা সেই লক্ষ্যে এখনো পৌঁছতে পারিনি।
বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি আসেনি আজও। এখনো অবিশ্বাস ও অপরের প্রতি হিংসা পোষণ থেকে মুক্ত হতে পারিনি আমরা। বাংলাদেশের সব নাগরিক ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রেখে সুখে শান্তিতে বসবাস করবে এ প্রত্যয় নিয়ে ৯ মাস রনাঙ্গণে ছিলাম। দেশ স্বাধীন ও শত্রুমুক্ত করে বীর বেশে ফিরে এসেছিলাম। কিন্তু আমাদের সে প্রত্যাশা পুরোপুরি পূরণ হয়নি। দীর্ঘকাল ধরেই ইতিহাস বিকৃতি করে মুক্তিযোদ্ধাদের কলঙ্কিত করার পাঁয়তারা চলছে।
তবে যুদ্ধাপরাধীরা এখন বিচারের কাঠগড়ায় এজন্য তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। বলেছিলেন, স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকারদের কুকর্মের বিচার আমার জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারছি এটাই নিজের কাছে বড় সান্ত্বনা। সর্বশেষ বলেছিলেন, স্বাধীনতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজা হবে এটাই আমার প্রত্যাশা।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৯ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০১৪
Bir Bikram UK Ching passes away
বীর বিক্রম উক্যচিং মারমা আর নেই
__._,_.___