নীতিহীন ডাক্তারদের বহুমুখী নির্মম বাণিজ্য সেন্টার।দেখার কেউ নেই।
চিকিৎসা সেক্টরে টেস্ট বাণিজ্য চরমে। সেবার উদ্দেশ্য ছাড়াই নিছক বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যাঙের ছাতার মতো যত্রতত্র গড়ে উঠেছে ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হাসপাতাল। মনগড়া রিপোর্ট তৈরির মাধ্যমে নিরীহ মানুষকে প্রতারিত করা হচ্ছে অহরহ। একই রোগ পরীক্ষায় একেকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে একেক রকম রিপোর্ট দেয়া হয়। এসব রিপোর্ট নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনেরা চরম বিভ্রান্তিতে পড়ে থাকে। তা সত্ত্বেও একশ্রেণীর কমিশনখেকো ডাক্তাদের সহায়তায় ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকদের রমরমা টেস্ট-বাণিজ্য চলছে বছরের পর বছর ধরে। অথচ সেদিকে ভ্রƒক্ষেপই করছে না সরকারি কর্তৃপক্ষ।
ডাক্তাররা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সরবরাহকৃত সিøপে টিক মার্ক দিয়ে দেয় কোন্ কোন্ টেস্ট করাতে হবে। রোগী তার পছন্দমতো ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সেই টেস্ট করালে চলবে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ওই ডাক্তার এ রিপোর্ট গ্রহণ করে না। নির্ধারিত সেন্টার থেকে পুনরায় একই টেস্ট করিয়ে আনতে হবে, কমিশন নিশ্চিত হলে পরেই বাকি চিকিৎসা। পরীক্ষার ফি বাবদ ইচ্ছে মাফিক টাকা-পয়সাও আদায় করা হয়। একই ধরনের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য একেক প্রতিষ্ঠানে ধার্য আছে একেক ধরনের ফি। স্বাস্থ্য অধিদফতর কর্তৃক রেট চার্ট মানে না রাজধানীর কোনো ডায়াগনস্টিক সেন্টারই। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের রয়েছে নিজস্ব রেট চার্ট। অনেক ক্ষেত্রে টেস্টের টাকা পরিশোধ করেই সর্বস্বান্ত হয়ে চিকিৎসা না নিয়েই বাসায় ফিরতে হয় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর রোগীদের। আবার বেশি টাকা দিয়ে টেস্ট করিয়েও সঠিক রোগ নির্ণয়ের নিশ্চয়তা পাচ্ছে না ভুক্তভোগীরা। এভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে অতিরিক্ত হিসেবেই হাতিয়ে নেয়া হয় কোটি কোটি টাকা। এ টাকার মোটা অংশ হিসেবে কমিশন চলে যায় ডাক্তারদের পকেটে। এসবের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের দায়িত্বশীল বিভাগটি অজ্ঞাত কারণে বরাবরই চরম উদাসীন। এসব প্রতিষ্ঠানের সামনে ডাক্তার, বিশেষজ্ঞদের দীর্ঘ তালিকার সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়া হলেও সরেজমিন কাউকে পাওয়া যায় না। রোগী আকর্ষণের জন্যই শুধু বিশেষজ্ঞদের নাম সাইনবোর্ডে লেখা হয় এবং নাম ব্যবহার বাবদ মাসিক ফি দেয়া হয় ওই সব ডাক্তারদের। বেশিরভাগ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত দক্ষ টেকনিশিয়ান পর্যন্ত নেই। যেখানে জটিল রোগ নিয়ে মানুষের জীবন-মরণ সমস্যা, সেখানে অদক্ষ টেকনিশিয়ানের মাধ্যমেই ডায়াগনস্টিক রিপোর্ট তৈরি হচ্ছে আর ভুলভ্রান্তিও ঘটছে অহরহ। ফলে রোগীর জীবন বিপন্ন হওয়ার পাশাপাশি প্রায়ই রোগী মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।
হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ওষুধ কোম্পানির মতো সংশ্লিষ্ট সব খাতও নিজেদের ব্যবসায়িক লাভজনক কৌশলের অংশ হিসেবে এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত আছে। এ প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্যই চালু রয়েছে কমিশন বাণিজ্য। আর আর্থসামাজিক-নৈতিক অবক্ষয়ের চক্রে পড়ে একশ্রেণীর চিকিৎসক গা ভাসিয়ে দিচ্ছে এ কমিশনের জোয়ারে। এ কমিশন বাণিজ্যের প্রভাবে চিকিৎসা ব্যয় বহুগুণ বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে গরিব মানুষ চিকিৎসা নিতে গিয়ে আরো নিঃস্ব হয়ে পড়ছে।
তবে বর্তমানে ডাক্তাররা আগের মতো কেবল ডায়াগনস্টিক বা প্যাথলজিক্যাল ল্যাবে ছোট, বড় ইস্তিঞ্জা বা কফ-রক্ত পরীক্ষা থেকেই কমিশন নেয় না, এর পাশাপাশি নতুন নতুন প্রযুক্তিনির্ভর সব ধরনের পরীক্ষাই এসেছে কমিশনের আওতায়। ডিজিটাল এক্সরে, ইসিজি, আল্ট্রাসনোগ্রাম, ইকো, কালার ডপলার, সিটি স্ক্যান, এমআরআইয়ের মতো নতুন প্রযুক্তি যুক্ত হয়েছে। এসবে কমিশনের হারও বেশি। রোগের বিভাজন অনুসারে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি বা পরীক্ষার ভিত্তিতে ভাগ হয়ে থাকে কমিশন। এছাড়া আছে হাসপাতালে রোগী পাঠানোর জন্য কমিশন। এক্ষেত্রে আইসিইউ বা সিসিইউয়ে রোগী পাঠানোর জন্য রয়েছে বিশেষ কমিশন। আছে অপারেশনের কমিশনও। আরো আছে ক্যান্সার রোগীদের জন্য কেমোথেরাপি, অর্থোপেডিক রোগীদের জন্য ফিজিওথেরাপি, কিডনি রোগীদের জন্য ডায়ালিসিসের কমিশন। অর্থোপেডিক রোগীদের দেহে সংযোজন করা বা হাড় জোড়া লাগানোর কাজে ব্যবহৃত নানা উপকরণ; হৃদরোগীর দেহে সংযোজন করা বাল্ব, রিং বা অন্য উপাদান, চোখের রোগীর চোখে সংযোজন করা লেন্সের মতো উপকরণ; দাঁতের চিকিৎসার ক্ষেত্রে নকল দাঁত প্রতিস্থাপন বা অন্যান্য সংস্কারের কাজে ব্যবহৃত উপকরণ এবং কানের নানা ডিভাইস থেকেও নিয়মিত কমিশন জোটে সংশ্লিষ্ট বেশির ভাগ ডাক্তারের। এমনকি ওষুধ লেখার জন্য আগে থেকেই বহুল প্রচলিত ওষুধ কম্পানির কাছ থেকে কমিশনের নামে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা নেয়ার পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশী বা চোরাইপথে আসা দামি ওষুধ থেকেও কমিশন পেয়ে থাকে প্যাকেজের আওতায় চিকিৎসা করা বেশির ভাগ চিকিৎসক।
উল্লেখ্য, চিকিৎসা তথা স্বাস্থ্যসেবা মানুষের মৌলিক অধিকার। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, "জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলে গণ্য করিবে।"
বলাবাহুল্য, স্বাধীনতাউত্তর সব সরকারই সংবিধানের এই অনুচ্ছেদ কার্যকর করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। জনগণের প্রতি সব সরকারের দায়িত্বহীনতা এবং দুর্নীতি প্রবণতাই এর মূল কারণ।
এক্ষেত্রে জনগণ শুধু শোষিত আর বঞ্চিতই হয়ে আসছে। অথচ পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, "তোমরা যালিমও হয়ো না এবং মজলুমও হয়ো না।"
কাজেই সরকারের উচিত- প্রতিটি নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, তেমনি জনগণেরও উচিত নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়া। চিকিৎসা বাণিজ্য সেন্টার বা তথাকথিত ইসলামী হাসপাতালে না নিয়ে সত্যিকারের শরয়ী হাসপাতলে যাওয়া। সত্যিকারের চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করা।
__._,_.___