বাচ্চু রাজাকার পাকিস্তানে ॥ ফিরিয়ে আনতে সর্বাত্মক চেষ্টা
পরিবারের গ্রেফতার হওয়া সদস্যদের জবানবন্দী, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য
গাফফার খান চৌধুরী ॥ মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের সঠিক অবস্থান জানার চেষ্টা চলছে। বাচ্চু রাজাকার বর্তমানে পাকিস্তানে অবস্থান করছেন বলে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং বাচ্চু রাজাকারের পরিবারের গ্রেফতারকৃতদের জবানবন্দী থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের মাধ্যমে ইতোমধ্যেই রেডওয়ারেন্ট জারি করা হয়েছে। পাকিস্তান থেকে বাচ্চু রাজাকার পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন বলেও তথ্য রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে। পালিয়ে যাওয়ার পর বাচ্চু রাজাকারের দুই ছেলে, শ্যালক, দুই বন্ধুসহ ৫ জনকে র্যাব গ্রেফতার করে। একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার কাছে গ্রেফতারকৃতদের দেয়া জবানবন্দীতে বাচ্চু রাজাকার বর্তমানে পাকিস্তানে রয়েছেন বলে অনেকটাই নিশ্চিত হওয়া গেছে। গ্রেফতারকৃতদের দেয়া জবানবন্দীর একটি কপিও রয়েছে দৈনিক জনকণ্ঠের সংগ্রহে। কোন প্রকার ঝামেলা ছাড়াই পাকিস্তানে পৌঁছে বাচ্চু রাজাকার আত্মীয়স্বজন ও পরিবার পরিজনের সঙ্গে কথাও বলেছেন। পাকিস্তান থেকে বাচ্চু রাজাকার বাংলাদেশে অবস্থানকারী আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন বলেও গোয়েন্দাদের কাছে খবর আছে। বাচ্চু রাজাকারকে দেশে ফিরিয়ে আনতে রেডওয়ারেন্ট জারি, আন্তর্জাতিকভাবে চাপ প্রয়োগ এবং কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত আছে। পাশাপাশি বাচ্চু রাজাকারের পরিবারের সদস্যদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি চলছে। বাচ্চু রাজাকারের অবস্থান নিশ্চিত হওয়ার ধারাবাহিকতার সূত্র ধরে একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার সার্বিক সহায়তায় র্যাবের গোয়েন্দারা ২০১২ সালের ৯ এপ্রিল বাচ্চু রাজাকারের দুই ছেলে আবুল কাশেম মুহাম্মাদ মুশফিক বিল্লাহ ওরফে জিহাদ (৩৫) ও শাহ মুহাম্মদ ফয়সাল আজাদ (৩৭), বাচ্চু রাজাকারের শ্যালক কাজী এহতেশামুল হক লিটনকে আটক করে। পরে বাচ্চু রাজাকারের বন্ধু দিনাজপুরের হিলি সীমান্তের ক্যাপিলা হোটেলের মালিক বাচ্চু রাজাকারের অনুসারী ও তার দোস্ত আবুল কালাম আজাদকে গ্রেফতার করে র্যাব। এছাড়া বাচ্চু রাজাকারকে পালিয়ে যেতে সর্বাত্মক সহায়তাকারী এদেশের একটি প্রতিষ্ঠিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. ইউসুফ আলীকেও গ্রেফতার করে র্যাব।
গ্রেফতারকৃতদের একটি বিশেষ জিজ্ঞাসাবাদ সেলে একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরবর্তীতে গ্রেফতারকৃতদের র্যাবসহ অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা বাচ্চু রাজাকারের পালিয়ে যাওয়া সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। জবানবন্দীতে দেয়া তথ্য ১৬১ ধারায় রেকর্ড করা হয়।
বাচ্চু রাজাকারের ছোট ছেলে আবুল কাশেম মুহাম্মাদ মুশফিক বিল্লাহ ওরফে জিহাদের জবানবন্দী ॥ তিনি বলেন, আমার পিতার কি ধরনের সাজা হবে তা আমরা আগে থেকেই অনুমান করতে পেরেছি। এমনকি আমার পিতাও সাজা সম্পর্কে জানতেন। এরপর আমি ও পিতাসহ পরিবারের সবাই মিলেই পারিবারিক বৈঠকে পিতাকে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে পরামর্শ দেই। পরামর্শে পিতা রাজি হন। সেটি ২০১২ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ের কথা। ওই সময় থেকেই আমার পিতার পালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে যাবতীয় প্রক্রিয়া শুরু হয়।
পরামর্শ মোতাবেক আগ থেকেই পরিচিত পিতার আদর্শের অনুসারী একই নামে নাম দিনাজপুরের হিলি এলাকার হোটেল ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। একই নামে দু'জনের নাম হওয়ায় দু'জন দু'জনকেই দোস্ত দোস্ত বলে সম্বোধন করতেন। দিনাজপুরের হিলি সীমান্তে আব্বার পরিচিত বন্ধু আজাদের ক্যাপিলা নামের একটি চারতলা হোটেল আছে। হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করার আশ্বাস দেন কাকা।
মোটামুটি যাবতীয় পরিকল্পনা সম্পন্ন হয়। এরপর শুরু হয় মাঠ পর্যায়ের কাজ। পরিকল্পনা মোতাবেক ২০১২ সালের ৩০ মার্চ সন্ধ্যার পর আলো আঁধারিতে রাজধানীর উত্তরখানের নিজ বাড়ি থেকে বের হই। আগে থেকেই বাড়ির গেটে কালো কাচের একটি মাইক্রোবাস রাখা ছিল। মাইক্রোবাসের পেছনের সিট ভেঙ্গে সমতল করা হয়। যাতে বাইরে থেকে দেখা না যায় বা দেখা গেলেও শুয়ে থাকা ব্যক্তিকে রোগী হিসেবে চালিয়ে দেয়া যায়। সেখানেই শুইয়ে দেই পিতাকে। মাইক্রোবাসটি সোজা চলে আসে রাজধানীর আগারগাঁও এলাকায়। ইতোমধ্যেই অন্ধকার আরেকটু ঘনীভূত হয়।
আগারগাঁওয়ে অধ্যাপক ড. ইউসুফের বাড়িতে নামাজ, খাওয়া-দাওয়া সেরে নেয়া হয়। এ বাড়িতেই রাস্তায় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আগে থেকেই প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। এরপর রাত ৮টায় আমরা দিনাজপুরের উদ্দেশে রওনা হই। গাড়িটির চালাক হিসেবে ছিলেন দক্ষ চালক অধ্যাপক ইউসুফ ভাইয়ের চালক আলীম। মধ্যরাতে আমরা বগুড়ার শেরপুরের ফুড ভিলেজে নেমে খাই। বাবাকে গাড়ির ভেতরেই খাওয়াই। রাত প্রায় ২টার দিকে আমরা জয়পুরহাট পৌঁছলে গাড়ির চালক আলীমকে বদল করে আমি (জিহাদ) নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করি। রাত সাড়ে ৩টার দিকে বাবার বন্ধু আবুল কালাম আজাদের হিলির ক্যাপিলা হোটেলের সামনে যাই। সেখানে তিনতলার একটি রুমে বাবা ওঠেন।
২ এপ্রিল বাবা এসএমএস করে জানান, তার মোবাইলে (বাসায় থাকা) ডাক্তার এমরান নেপাল নামে একটি নম্বর সেভ করে রেখেছে। সেই নম্বরটি দেবার জন্য বলেন। আমি নম্বরটি বাবাকে এসএমএস করে দেই।
জিহাদ তার জবাবন্দীতে আরও বলেছেন, ডা. এমরান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ছিলেন। আমার মামা এহতেশামের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে আমার বাবার সঙ্গে এমরানের ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। বর্তমানে তিনি নেপালে থাকেন। ঢাকায় মাঝে মধ্যে আসলে আমাদের বাসায় আসতেন। ৩ এপ্রিল বেলা ১১টায় ওয়ারেন্ট ইস্যুর খবর টিভিতে শুনলে আমি বাবাকে এসএমএস করে জানাই। এর আগে বাবাকে রেখে আসার সময় গোপনীয়তা রক্ষার জন্য একটি নতুন সিটিসেল ফোন সেট বাবার জন্য নেই। সেই সিটিসেল নম্বরটি হচ্ছে, ০১১৯৩১৭৯২৭২।
বাবাকে ওই সময় প্রায় সাত হাজার ইউএস ডলার দেই। আমার এবং বড় ভাইয়ের জন্য আরও দুটি সিটিসেল ফোনসেট কিনি। বাবা আমাদের সঙ্গে দুই নম্বরে এসএমএসের মাধ্যমে তথ্য আদান প্রদান করতেন। কিন্ত যেদিন ওয়ারেন্ট ইস্যু হয় সেদিন বিকেলে বাবা এহতেশাম মামাকে ফোন দিয়ে জানান, তিনি ভাল আছেন। তিনি যে ফোন নম্বর দিয়ে কল দিয়েছিলেন-সেটি ভারতের। তখন আমরা নিশ্চিত হই বাবা দিনাজপুর সীমান্ত পার হয়ে ভারতে ঢুকে পড়েছেন।
র্যাব মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, যুদ্ধাপরাধ মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি আবুল কালাম আজাদকে দেশে ফিরিয়ে আনতে সব ধরনের আইনী প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
পুলিশ মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার জনকণ্ঠকে জানান, পলাতক বাচ্চু রাজাকারকে গ্রেফতারে সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। তবে বাচ্চু রাজাকার কোন্ দেশে কি অবস্থায় পলাতক আœে তা কৌশলগত কারণে জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন তিনি।
http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=15&dd=2013-01-22&ni=123131Related:
মানবতাবিরোধী অপরাধ: মাওলানা আযাদের ফাঁসির আদেশ
প্রাইম রিপোর্ট
__._,_.___