নির্বাহী আদেশেই জামায়াত নিষিদ্ধ করা সম্ভব রাশেদ মেহেদী/ওয়াকিল আহমেদ হিরন বর্তমানে হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসযজ্ঞ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট, ধর্মকে ব্যবহার করে মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে সংঘাত সৃষ্টির মতো অপকর্ম চালানোর কারণে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার গণদাবি উঠেছে। প্রজন্ম চত্বরের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে প্রতিদিন এ দাবি উঠছে। সর্বশেষ গত রোববার সংসদের অধিবেশনে দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ মহাজোটের একাধিক সংসদ সদস্য সংবিধান ও আইন অনুযায়ী নির্বাহী আদেশের মাধ্যমেই জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা সম্ভব বলে মত দিয়েছেন। এর আগে সংশোধিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত দল হিসেবে জামায়াতেরও বিচারের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। অন্যদিকে আইনমন্ত্রী আদালতের মাধ্যমে আইনগতভাবে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার কথা জানিয়েছিলেন। তবে সংসদে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার দাবি ওঠার পর এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম সমকালকে বলেন, আইনগতভাবেই জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করা সম্ভব। তবে আইনের কোন পথে নিষিদ্ধ করা হবে, তা এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। স্বরাষ্ট্র সচিব সি কিউ কে মোস্তাক সমকালকে বলেন, নির্বাহী আদেশে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে তারা কোনো নির্দেশনা পাননি। এ ব্যাপারে আইনগত পদক্ষেপ কী কী হতে পারে, সে বিষয়টিও তারা এখন পর্যন্ত পর্যালোচনা করেননি। সংবিধান এবং আইনে যা আছে :সংবিধানের সর্বশেষ সংশোধনীর পর ৩৮ ধারায় সংগঠনের স্বাধীনতা অংশে কী কী কারণে একটি রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা যায়, তা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। ৩৮ ধারায় বলা হয়, 'কোনো ব্যক্তির সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার কিংবা উহার সদস্য হইবার অধিকার থাকিবে না যদি (ক) উহা নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়, (খ) উহা ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ, জন্মস্থান বা ভাষার মধ্যে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়, (গ) উহা রাষ্ট্র বা নাগরিকদের বিরুদ্ধে কিংবা অন্য কোন দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী বা জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনার উদ্দেশ্যে গঠিত হয় বা (ঘ) উহার গঠন বা উদ্দেশ্যে এই সংবিধানের পরিপন্থী হয়।' নির্বাহী আদেশে কিংবা আদালতে বিচারের মাধ্যমে কোন পথে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করা সম্ভব, তা নিয়ে সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক নেতা এবং আইনজীবীরা পৃথক মত দিয়েছেন। জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার উপায় হিসেবে রাজনীতিক ও আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সংবিধানের ৩৮(গ), ২০০৯ সালের সন্ত্রাস দমন আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২০ ধারা প্রয়োগ করে নির্বাহী আদেশে এবং সংশোধিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত সংগঠন হিসেবে আদালতে বিচারের মাধ্যমে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা যেতে পারে। সংবিধানের এই ধারা উল্লেখ করে রোববার সংসদের অধিবেশনে দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে এখনই জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা সম্ভব বলে মত দেন। পরে সমকালের সঙ্গে আলাপকালে তিনি আরও বলেন, সংবিধানের ৩৮(গ) ধারা অনুযায়ী জামায়াত-শিবির এরই মধ্যে রাজনীতি করার অধিকার হারিয়েছে। কারণ, তারা সারাদেশে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে_ যা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়, জঙ্গি কার্যক্রম। এ ছাড়া তারা ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উপাসনালয় ও বাড়িঘরে আগুন দিয়ে এবং মিথ্যা গুজব রটিয়ে ধর্মপ্রাণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টেরও চেষ্টা চালিয়েছে। ফলে তারা সংবিধানবিরোধী কর্মকাণ্ড করে সংগঠন করার স্বাধীনতা হারিয়েছে। বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২০(১) ধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, 'ঘড় ঢ়বৎংড়হ ংযধষষ ভড়ৎস, ড়ৎ নব ধ সবসনবৎ ড়ৎ ড়ঃযবৎরিংব ঃধশব ঢ়ধৎঃ রহ ঃযব ধপঃরারঃরবং ড়ভ, ধহু পড়সসঁহধষ ড়ৎ ড়ঃযবৎ ধংংড়পরধঃরড়হ ড়ৎ ঁহরড়হ যিরপয রহ ঃযব হধসব ড়ৎ ড়হ ঃযব নধংরং ড়ভ ধহু ৎবষরমরড়হ যধং ভড়ৎ রঃং ড়নলবপঃ, ড়ৎ ঢ়ঁৎংঁবং, ধ ঢ়ড়ষরঃরপধষ ঢ়ঁৎঢ়ড়ংব.' এর বাংলা অর্থ দাঁড়ায়, ধর্মীয় নামে কিংবা ধর্মীয় সম্প্রদায় ভিত্তিতে কোনো রাজনৈতিক দল বা সংঘ প্রতিষ্ঠা কোনো ব্যক্তি করতে পারবেন না কিংবা এর সদস্য হতে পারবেন না। ২০০৯ সালের সন্ত্রাস দমন আইনেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট, সন্ত্রাস সৃষ্টি, জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনা কিংবা জনজীবনে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী সংঘ, সমিতি বা দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে। আইনের এ দুটি ধারা উল্লেখ করে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক বলেন, সরকার এর যে কোনো আইনে জামায়াত-শিবিরের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে পারে। সবকিছু নির্ভর করছে সরকারের সদিচ্ছার ওপরে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম বলেন, সরকারের জন্য সংবিধান, সন্ত্রাস দমন আইন এবং একই সঙ্গে বিশেষ ক্ষমতা আইন রয়েছে। সরকার এর যে কোনো প্রক্রিয়ায় জামায়াত-শিবিরের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে পারে। এ ছাড়া সংশোধিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের মাধ্যমেও সরকার একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার করতে পারে। সে ক্ষেত্রে আদালত অপরাধ বিবেচনায় জামায়াতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিকল্প নেই, এটা করতে হবে। এটা আইনগত প্রক্রিয়ায় এমনভাবে করতে হবে যেন ভবিষ্যতে কেউ এ নিয়ে আইনের ব্যত্যয় হয়েছে, এমন প্রশ্ন তোলার সুযোগ না পায়। পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবেও যেন কোনো সমালোচনা না ওঠে, সেটাও মাথায় রাখতে হবে। এ কারণে হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নয়, আইনের স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করতে হবে এবং তার জন্য আইনের যথেষ্ট বিধান রয়েছে। রাজনীতিবিদদের বক্তব্য :মহাজোটের এমপি ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, নির্বাহী আদেশে অবশ্যই জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা যায় এখনই। এর আগে যে প্রক্রিয়ায় জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ, হিযবুত তাহ্রীর, জেএমবি নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেই প্রক্রিয়ায় জামায়াত-শিবিরের রাজনীতিও নিষিদ্ধ করা যায়। কারণ, এখন জামায়াত-শিবির যা করছে তা কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়, সুস্পষ্টভাবে জঙ্গি এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা এখন গণদাবি। এ দাবি সরকারকে মানতে হবে। কিন্তু এর সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে, শুধু জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করলেই হবে না। তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উৎস নির্মূল করতে হবে, তাদের বিভিন্ন ধরনের যোগাযোগের যে প্রক্রিয়া আছে, তা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক এবং আদর্শগত সংগ্রাম সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে দিতে হবে। তাহলেই কেবল জামায়াত-শিবিরের মতো ভয়ঙ্কর অপশক্তিকে সমূলে উৎপাটন করা সম্ভব হবে। ( এই লেখাটি পড়েছেন : ৮০৬ জন ) |