শহরে বেরিয়ে স্তম্ভিত বগুড়াবাসী
শরিফুল হাসান, মিলন রহমান ও আনোয়ার পারভেজ, বগুড়া থেকে | তারিখ: ০৭-০৩-২০১৩
বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলা পরিষদ ভবনে গত রোববার ভাঙচুর ও হামলার পর আগুন ধরিয়ে দেন জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। পুড়ে যাওয়া ভবনের একটি কক্ষের এই দৃশ্য গতকাল দুপুরে তোলা
ছবি: প্রথম আলো
তিন দিনের সহিংস হরতাল ও ১৪৪ ধারা উঠে যাওয়ার পর বগুড়ার সাধারণ মানুষ গতকাল বুধবার ঘর থেকে বের হয়ে স্তম্ভিত। তারা দেখেছে ক্ষতবিক্ষত বগুড়া রেলস্টেশন, আজিজুল হক কলেজের বিধ্বস্ত নামফলক। শহরের ইয়াকুবিয়া মোড় ও শহীদ জব্বার সড়কের দুটি কুরিয়ার সার্ভিসের অফিস, একটি বেসরকারি টেলিভিশন ও একটি ইলেকট্রনিকসের দোকানের পোড়া ক্ষত। কালীতলায় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির বাসভবন বিধ্বস্ত। বিক্ষত সাবেক এক সাংসদের বাড়িঘর। শাজাহানপুরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও উপজেলা আওয়ামী লীগের লন্ডভন্ড কার্যালয়।
বগুড়া শহরের এই ধ্বংসযজ্ঞ পেছনে ফেলে শাজাহানপুর হয়ে নন্দীগ্রামে পৌঁছার পর বিধ্বস্ত উপজেলা প্রশাসন কার্যালয় দেখার পর থমকে দাঁড়াবেন যে কেউ। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়, উপজেলা কৃষি অফিস, উপজেলা প্রকৌশল অফিস, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যালয়, উপজেলা মৎস্য অফিস, উপজেলা যুব উন্নয়ন অফিস ও উপজেলা নির্বাচন অফিস—সরকারের ১৬টি দপ্তর পুড়ে একাকার। উপজেলা কার্যালয়ের পাশে উপজেলা চেয়ারম্যান রেজাউল আশরাফের কার্যালয়, বাড়িও আগুনে পোড়া।
চারপাশে পোড়া গন্ধ। উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্সে থাকা দোতলা ভবনের প্রতিটি কক্ষের আসবাব আর নথিপত্র পুড়ে ছাইয়ের স্তূপ হয়ে আছে। দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে। গত রোববার ভোরে এখানকার সবকিছু জ্বালিয়ে দিয়েছে জামায়াত-শিবির।
বিভিন্ন কক্ষে গিয়ে দেখা গেল, সব কটি টেবিল, টেলিভিশন, কম্পিউটার, টেলিফোনসেট, ফ্যাক্স মেশিন, সরকারি সব নথিপত্র পুড়ে ছাই হয়ে আছে। উপজেলা কার্যালয়ের কর্মচারীরা দিনভর বিধ্বস্ত এসব কক্ষ পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন।
পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ইউএনওর সরকারি জিপসহ কয়েকটি গাড়ি। নন্দীগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসিফ আহসান প্রথম আলোকে বলেন, 'হামলাকারীরা ভবনের প্রতিটি কক্ষের প্রতিটি দপ্তরে আগুন দিয়েছে। সরকারি সব নথিপত্র তারা পুড়িয়ে ফেলেছে।
উপজেলার সব উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কাগজপত্র, কর্মচারীদের চাকরিসংক্রান্ত রেকর্ড বই, বিভিন্ন সরকারি মামলা, ঋণ, নকশা, ভাউচার সব পুড়িয়ে দিয়েছে। আর্থিক ক্ষতির হিসাব করলে তা ১০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। তিনি বলেন, 'আগুনে যেসব নথিপত্র ছাই হয়ে গেছে, সেগুলোর কী হবে, আমরা এখনো জানি না। তবে একটি কথা বলতে পারি, স্বাধীনতার আগে-পরে গত ১০০ বছরে এ দেশে এমন বীভৎস ঘটনা কোথাও ঘটেছে বলে আমার জানা নেই।'
থানার পুলিশ ও স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, রোববার দিবাগত রাত তিনটা থেকে বিভিন্ন মসজিদের মাইক থেকে গুজব ছড়িয়ে 'জিহাদে নামতে' আহ্বান জানানো হয়। দীর্ঘক্ষণ চলে এই মাইকিং। তারপর ভোররাতে কয়েক হাজার লোক জড়ো করে জামায়াত-শিবির লাঠিসোঁটা ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে উপজেলা কার্যালয়ে হামলা চালায়। তারা পেট্রল ঢেলে একের পর এক দপ্তর জ্বালাতে থাকে। গাছ কেটে ও বিদ্যুতের খুঁটি ফেলে বগুড়া-নাটোর মহাসড়কের দীর্ঘ পথ অবরোধ করে, যাতে ফায়ার সার্ভিসের কোনো গাড়ি আগুন নেভাতে আসতে না পারে। দিনভর আগুন জ্বলে। সব পুড়ে ছাই হয়ে পরদিন বিকেলে নেভে সেই আগুন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী উপজেলা কৃষি অফিসের নিরাপত্তা প্রহরী শাহজাহান আলী জানান, তারা লোহার রড, শাবল, হাঁসুয়া, কুড়ালসহ দেশি অস্ত্র নিয়ে এসে উপজেলার চারপাশের সীমানাদেয়াল গুঁড়িয়ে দেয়। এরপর তারা সরকারি সব অফিসে গিয়ে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। উপজেলা কার্যালয়ের আরেক কর্মচারী সাজ্জাদ হোসেনও একই বর্ণনা দিয়ে বলেন, হামলাকারীদের মধ্যে একটি দল কনটেইনারে করে পেট্রল নিয়ে এসেছিল। তারাই তা ছিটিয়ে আগুন দেয়।
উপজেলা কার্যালয়ের পাশেই ছোট একটি ভবনে প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়। ওই দপ্তরের অফিস সহকারী এমদাদুল জানান, হামলাকারীরা সরকারি সব কাগজপত্র, শিশুদের বিনা মূল্যের বই, পরীক্ষার খাতা, কম্পিউটার ও গুদাম—সবকিছু পুড়িয়ে ফেলেছে।
তবে, ওই ভবনের সামনে থাকা বিএনপির উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আহসানুর রহিমের কার্যালয়ে কোনো হামলা হয়নি। ঠিক এর পেছনে থাকা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের সভাপতি রেজাউল আশরাফের কার্যালয় ও তাঁর বাসভবন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
রেজাউল আশরাফ প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলা কার্যালয়ের পর হামলাকারীরা প্রথমে তাঁর কার্যালয়ে আগুন দেয়। এরপর তারা কার্যালয়ের পাশেই তাঁর বাসার দিকে অগ্রসর হয়। প্রতিবেশী কয়েকজন তখন তাঁকে, তাঁর স্ত্রী, মা, বোন ও বোনের ৪০ দিনের শিশুসন্তানকে সরিয়ে নেন। তিনি দাবি করেন, হামলাকারীরা গানপাউডার ছিটিয়ে তাঁর বাড়িতে আগুন দেয়।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, নন্দীগ্রাম উপজেলা জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা এ হামলা চালিয়েছেন। সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে—এই গুজব মাইকে ছড়িয়ে দিলে আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের লোকজন, নারী-শিশু পর্যন্ত রাস্তায় বের হয়ে আসে। পরে হামলার সময় এসব লোকের অনেকেই অংশ নেয়। উপজেলা কমপ্লেক্সের উল্টো দিকে সামান্য দূরেই নন্দীগ্রাম থানা।
স্থানীয় অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, হামলায় বিএনপির অনেক নেতা-কর্মীও অংশ নিয়েছেন। এ ঘটনায় নন্দীগ্রাম থানায় দায়ের করা মামলায় উপজেলা জামায়াতের আমির নুরুল ইসলাম মণ্ডল, সেক্রেটারি মনজুরুল ইসলাম, সাবেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ারুল হকসহ ৩৩০ জনকে সুনির্দিষ্ট আসামি করা হয়েছে। সঙ্গে রাখা হয়েছে অজ্ঞাতনামা আরও পাঁচ-ছয় হাজার জনকে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, তিন ঘণ্টা ধরে উপজেলা কমপ্লেক্সে হামলা ও আগুন দেওয়া হলেও থানার পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে একটি গুলিও ছোড়েনি। কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগে গতকালই অবশ্য ওই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমিনুর রহমানকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
তবে, আমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, 'ভোর সাড়ে তিনটা থেকেই মাইকিং শুরু হয়েছে। আমি ঘটনার পর বারবার স্থানীয় সাংসদ মোস্তফা আলীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। সাংসদকে বলেছি, আপনার বিএনপির লোকজনও হামলায় অংশ নিচ্ছে। তিনি বলেছেন, সেটি হলে তিনি তাদের সরিয়ে নেওয়ার কথা বলবেন। কিন্তু তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি। ছয়টার দিকে হামলাকারীরা আসে। তারা থানায় হামলা করে। আমরা থানার ভেতরে তখন মাত্র ১০-১২ জন পুলিশ। বেশির ভাগই তখন বাইরে ছিল।'
হামলাকারীদের উদ্দেশে গুলি ছুড়েছেন কি না, জানতে চাইলে ওসি বলেন, 'কয়েকটি ফাঁকা গুলি ছুড়েছি।'
শহরে হামলা: শহরের কালীতলা এলাকায় বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিনের তিনতলা বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। গতকাল ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির নিচতলার গ্যারেজে থাকা দুটি গাড়ি ও তিনটি মোটরসাইকেল পুড়ে গেছে। নিচতলায় ড্রয়িং রুমও পুড়ে গেছে।
মমতাজ উদ্দিন বলেন, 'সকাল সাতটার দিকে জামায়াত-শিবিরের কয়েক হাজার লোক এই হামলা চালান। ড্রয়িং রুমে আগুন দিলে চারপাশ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। বাড়িতে আমি, আমার স্ত্রী, দুই ছেলে, তাদের স্ত্রী ও নাতি-নাতনিরা ছিল। সবার নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড়। আমরা বের হতে পারছিলাম না। একপর্যায়ে বাড়ির পেছনের গ্রিল ভেঙে বের হই।'
শহরের শেরপুর সড়কের তিনতলা এসএ পরিবহন কুরিয়ার সার্ভিসের বগুড়া কার্যালয়ে লুটপাটের পর আগুন দিয়েছে হামলাকারীরা। ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক হুমায়ুন কবির বলেন, 'আমার প্রতিষ্ঠানের ২০ লাখ টাকা লুট করে নিয়ে গেছে হামলাকারীরা। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের আসবাব, ১০টি ওষুধ কোম্পানির ওষুধ, পার্সেলের মালামালসহ দুই কোটি টাকার মালামাল পুড়ে গেছে।'
শহরের জলেশ্বরীতলার করতোয়া কুরিয়ারের কার্যালয়ও লুটপাট করে পুড়িয়ে দিয়েছে হামলাকারীরা। করতোয়ার বগুড়া অঞ্চলের ব্যবস্থাপক জাহিদুল ইসলাম জানান, হামলাকারীরা প্রতিষ্ঠানের চার লাখ টাকা লুট করেছে। আগুনে পুড়েছে কোটি টাকার জিনিসপত্র।
শহরের শেরপুর রোডের বেসরকারি টেলিভিশন এটিএন বাংলা এবং তাদের প্রতিষ্ঠান এটিএন ইলেকট্রনিকসে লুটপাট করে পুড়িয়ে দিয়েছে হামলাকারীরা। এটিএন ইলেকট্রনিকসের দায়িত্বে থাকা ইকবাল মোরশেদ জানান, তাঁদের ১৫ লাখ টাকার সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
বগুড়ার পুলিশ সুপার মোজামেঞ্চল হক প্রথম আলোকে বলেন, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলে যে কেউ বুঝতে পারবে, জামায়াত-শিবির শুধু পুলিশ ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে নয়; রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু করেছে। নন্দীগ্রামে উপজেলা পরিষদে যে বর্বরতা চালিয়েছে, তা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকেও হার মানিয়েছে। তারা জাতীয় পতাকা, মানচিত্র ও স্বাধীনতার দলিলপত্রের ২৬টি খণ্ড পুড়িয়ে আবারও প্রমাণ করেছে যে তারা বাংলাদেশকেই বিশ্বাস করে না। পুলিশ সুপার বলেন, ইতিমধ্যে হামলাকারীদের গ্রেপ্তার শুরু হয়েছে।
বগুড়ার জেলা প্রশাসক সারোয়ার মাহমুদ বলেন, এটি চরম বর্বরতা। কোনো সভ্য যুগে এ ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ কেউ চালাতে পারে, সেটা ধারণায় ছিল না। তিনি বলেন, 'পুড়িয়ে দেওয়া কাগজ ও নথিপত্রের অনুলিপি যেখানে যা আছে, তা আমরা সংগ্রহের চেষ্টা করছি। ঘটনা তদন্তে একটি কমিটিও গঠন করে দেওয়া হয়েছে।'
আবার আতঙ্ক, ১৪৪ ধারা জারি: গতকাল বিকেলে শহরে বিক্ষোভ করেছে বিএনপি। এ সময় বেশ কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরিত হলে আবার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। জামিলনগরে একটি সিএনজিতে আগুন দেওয়া হয়। এরপর প্রশাসন সদরসহ সাতটি উপজেলায় রাত ১২টার পর থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করেছে। উপজেলাগুলো হলো শাজাহানপুর, নন্দীগ্রাম, দুপচাঁচিয়া, কাহালু, শিবগঞ্জ ও গাবতলী।
http://prothom-alo.com/detail/date/2013-03-07/news/334498
বাঁশখালীতে জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব
তারা এসে পানি চেয়ে খেল, পরে আগুন দিল ঘরে
প্রণব বল, বাঁশখালী থেকে ফিরে | তারিখ: ০৫-০৩-২০১৩
http://prothom-alo.com/detail/date/2013-03-05/news/334027
তারা এসে পানি চেয়ে খেল, পরে আগুন দিল ঘরে
নাগরিক সমাজের আহ্বান
সাম্প্রদায়িক হামলা, সহিংস তৎপরতা রুখে দাঁড়াও
বিশেষ প্রতিনিধি | তারিখ: ০৫-০৩-২০১৩
__._,_.___